শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মুহাজিরদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মুহাজিরদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে

ইয়াসরিবের ইতিহাসে আজকের দিনটি অন্য দিনের চেয়ে খুব আলাদা। একটু পরই ইয়াসরিবের নাম বদলে হয়ে যাবে মদিনাতুর রসুল বা নবীজীর শহর।  ঘরে ঘরে তাই সাজ সাজ রব বইছে। দুধের শিশুও আনন্দে খিলখিল করে হাসছে। মদিনার ধুলাবালু খুশিতে নাচছে। রসুলের পদচারণায় ধন্য হওয়ার প্রথম অধিকার যেন তাদেরই। এ মনোভাব জীব-জড় প্রতিটি সৃষ্টির মাঝেই বিরাজ করছিল। রসুল (সা.) এলেন। সঙ্গে মুহাজিরদের বিশাল বাহিনী। আবুবকর, ওমর, আলী এবং হজরত উসমানের মতো সাহাবিরাও সঙ্গে রয়েছেন। শূন্য হাতে পৃথিবীর বাদশাহ মদিনার আনসারদের মেহমান হয়েছেন। আনসাররা কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? যার যা আছে তা নিয়েই হাজির হয়েছেন নবীজীর দরবারে। কেউ জমি দিলেন, কেউ ঘর দিলেন, কেউ খাবার দিলেন, আবার কেউবা রান্না করার লাকড়ি দিলেন। এভাবে আনসারদের ছোট ছোট উপহার দিয়ে নবীজীর সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল। হয়ে গেল মসজিদুননববীও। আনসার-মুহাজিরদের সঙ্গে মিলেমিশে মসজিদ ও ঘর তৈরিতে শ্রম দিয়েছেন বিশ্বনবী নিজেও। সাহাবিরা বারবার এসে বলছেন, আপনি আমাদের নবী! আপনি কেন কাজ করবেন? রসুল (সা.) বললেন, আমি তো তোমাদের মতোই মানুষ। কাজ না করে অলসের মতো তোমাদের থেকে আলাদা বসে থাকা আমার পছন্দ নয়।

 

 

নতুন ঘর হলো। মসজিদ হলো। রসুল (সা.) যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটু জিরিয়ে নেবেন। ঠিক এই মুহূর্তে মলিন মুখে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন হুজুর (সা.)-এর সামনে। মহিলার মাথা অবনত। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। সঙ্গে ছোট এক শিশু। রসুল (সা.) বললেন, ‘মা! তোমার কি দুঃখ? আমাকে বল।’ মহিলার কান্না যেন আরও বেড়ে গেল। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল!

মদিনার এমন কোনো ঘর নেই যে ঘর থেকে আপনার নামে কোনো হাদিয়া আসেনি। সবাই তাদের সামর্থ্য মতো আপনাকে দান করেছে। হতভাগ্য ও পোড়া কপাল শুধু এ অবলা নারীরই। কেবল আমিই এখনো আপনার জন্য কিছুই সংগ্রহ করতে পারিনি। হুজুর! আমার এ কোলের শিশুটি আপনাকে উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছি। আপনি একে গ্রহণ করুন। এ শিশু আপনার খাদেমের প্রয়োজন পূরণ করবে।’ রসুল (সা.) শিশুটিকে রাখলেন। আদর আর ভালোবাসা দিয়ে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেন।  শিশুটি এক সময় গৌরবের অধিকারী হলেন। পাঠক! কেউ কি জানেন এ শিশুটি কে? বলছিলাম আনাস (রা.)-এর কথা। আনাসের মায়ের নবীজীর জন্য আবেগ, মদিনার আনসারদের অভাবনীয় সাহায্য, পরকে ভাই করে নেওয়ার দৃশ্য যেন আবার ফিরে এসেছে সোনার বাংলায়। প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, এলাকা এবং মাদ্রাসা, মসজিদ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন মুসলমানদের জন্য সহযোগিতার হাতের সঙ্গে দেড় হাজার বছর আগের আনসারদের হাতের যেন অনেক মিল। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা না থাকলে মদিনার আনসারদের মতোই বাংলার আনসাররাও নিজেদের মালামাল মুহাজির ভাইর সঙ্গে ভাগ করে নিত।

বাংলার অসংখ্য আনসার মায়ের কথা জেনেছি, যাদের আত্মায় গভীর ক্ষত। মুহাজিরদের কিছু দিতে পারলেই যেন এ ক্ষত সারবে। এ বেদনা নিয়ে এক মহিলা এসেছে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে। এক বোন থেকে শোনা ঘটনা বলছি। ওই মহিলা বলল, আমার স্বামীর খোঁজ নেই। ছেলের চাকরি নেই। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। গত এক সপ্তাহ বাজার করতে পারছি না। তাই বলে তো আর মুহাজিরদের সাহায্য না করে থাকতে পারি না। তাই গহনা বিক্রি করেই তাদের জন্য এ টাকাটা সংগ্রহ করলাম। আরেকজন মহিলার আবেগ দেখুন। একটি পত্রিকা অফিসে বসে আছি। সম্পাদকের সঙ্গে খোশগল্প করছি। এমন সময় মধ্য বয়সের এক মহিলা হন হন করে ঢুকে সম্পাদকের হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলল, আমি কোনো লেখিকা নই। তাই আমার লেখা অত উঁচু মানের হয়নি। তা সত্ত্বেও আমার অনুরোধ, আপনার কাগজে এ লেখাটি ছেপে দিন। লেখাটি মিয়ানমারের মুসলমানদের সাহায্য করার বিষয়ে। এতটুকু বলতেই চোখে জল এলো মহিলাটির। মহিলা চলে যাওয়ার পর সম্পাদক লেখাটি পড়লেন। লেখায় দাঁড়ি, কমা কিছু ঠিক নেই। বাক্য ও শব্দ গঠন হয়নি। সম্পাদক বলল, ভাই! এ লেখাটি আমি ছাপতে পারব না। তবে মহিলার আবেগের কারণে এ লেখাটি দীর্ঘদিন আমার আত্মায় যন্ত্রণা দেবে। ওই মহিলার লেখা থেকে পাঠকদের জন্য কিছু তুলে ধরছি। ‘নাফ নদীতে ভাসছে মুহাজিররা। এদের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে মুহাজিরদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। হে আল্লাহ! এখনো যেসব মানুষের ঘুম ভাঙেনি তাদের কানে আরাকানের মুসলানদের কান্না পৌঁছে দিন। ওদের কান্নায় জেগে উঠুক বিশ্ববিবেক।’ 

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর