শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

তাবলিগ ইসলাম প্রচারের বড় মাধ্যম

মুফতি আমজাদ হোসাইন

তাবলিগ ইসলাম প্রচারের বড় মাধ্যম

আত্তাবলিগ অর্থ পয়গাম পাঠানো বা বার্তা পৌঁছানো। এই তাবলিগের সঙ্গে যখন ইসলাম যুক্ত হবে তখন অর্থ হবে ইসলামের বার্তা পৌঁছানো। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কার কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছাবে? উত্তরে বলতে হবে, আশরাফুল মাখলুকাত তথা আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ইনসানের কাছে। যিনি ইসলামের বাণীগুলো অন্যের কাছে পৌঁছে দেন তাকে ‘দায়ি’ বলা হয়। দায়ির মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে আমি একজন আজ্ঞাবহ, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?’ (সূরা হা-মিম সিজদাহ : ৩৩)। তাফসিরে মাজহারিতে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতের মধ্যে প্রকৃত মুমিনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। মুমিন ব্যক্তি শুধু নিজের ইমান ও আমল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে না। অন্যকেও ইমান-আমলের দিকে দাওয়াত দেয়। ‘যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে তার থেকে উত্তম কথা আর কার হতে পারে?’ এ থেকে বোঝা গেল, মানুষের সেই কথাই সর্বোত্তম ও সর্বোত্কৃষ্ট যাতে অন্যকে সত্যের দাওয়াত দেওয়া হয়। এ দাওয়াতের মধ্যে সর্বপ্রকার দাওয়াত শামিল। যেমন কেউ লেখা লেখনীর মাধ্যমে, কেউ আবার ওয়াজ ও নসিহতের মাধ্যমে, কেউ তালিম-তারবিয়াতের মাধ্যমে, আবার কেউ কেউ খানকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীনের দাওয়াত প্রদান করেন। অর্থাৎ এক কথায় দীনের সহি দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য যে কোনো পদ্ধতি চালু করুক না কেন সবই এ আয়াতের মধ্যে শামিল। এমনকি মুয়াজ্জিনের আজানও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। তাই তো হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এ আয়াতটি মুয়াজ্জিন সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। কারণ মুয়াজ্জিন আজানের মাধ্যমে মুসলমানদের কল্যাণ ও সফলতার দিকে আহ্বান করেন। দাওয়াতের বিভিন্ন শিরোনাম হয়। যেমন দাওয়াত ইলাল্লাহ, দাওয়াত ইলাল খায়ের বা দাওয়াত ফি সাবিলিল্লাহ। এসবের সারমর্ম এক ও অভিন্ন। কারণ আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া দ্বারা তার দীন ও সরল পথের দিকেই দাওয়াত দেওয়া উদ্দেশ্য হয়। তবে সব কাজের পুরস্কার-তিরস্কার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। নিয়ত যেমন হবে ফল তেমন হবে। (বুখারি)। মানুষের ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। জান্নাত পাওয়ার জন্য। জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য। পরস্পর সম্পর্ক রাখবে, একে অন্যকে ভালোবাসবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।  আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সূরা হুজুরাত : ১০)। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ দুটি বিষয় পরিষ্কার ভাষায় আলোকপাত করেছেন। এক. মুমিন সম্প্রদায় পরস্পর ভাই ভাই। তাদের মাঝে কোনো বিবাদ-বিসংবাদ থাকতে পারে না। দুই. আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় অন্তরে স্থান দিতে হবে। যাদের মনে আল্লাহর ভয় নেই, তারা কস্মিনকালেও দীনের ওপর শত পার্সেন্ট টিকে থাকতে পারে না। যারা দীনের ওপর টিকে থাকতে না পারবে, তারা কখনো আল্লাহর বিশেষ রহমত পাবে না। আল্লাহর বিশেষ রহমত মুত্তাকিরা পায়। মানুষ এক আল্লাহর বান্দা। আল্লাহর কাছে মাথা নত করে নিজের সবকিছু অর্পণ করে। নিজের সব চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করে। তিনিও রহমতের ছায়ায় বান্দাদের আশ্রয় দান করেন। আমরা সবাই একই নবীর উম্মত। একই দীনের অনুসারী। মানুষের মাঝে থাকবে পরস্পর মায়া-মহব্বত। তাদের মাঝে থাকবে না কোনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ। যদি কখনো কোনো কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তৃতীয় ব্যক্তি ইনসাফের সঙ্গে মীমাংসা করে দেবে। পক্ষপাতিত্ব করবে না। এ ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনুপম দৃশ্য দেখা যায় টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়। আমাদের দেশে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও হতে যাচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। যেখানে ইখলাস, ইনাবাত ইলাল্লাহ, তাওয়াক্কুল ও সবর, শান্তি ও প্রশান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের বেনজির এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটবে। থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ ও ধনী-গরিবের শ্রেণিভেদ। তাই তো টঙ্গীর ইজতেমায় গেলে দেখা যায় দীনি ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্যের হেদায়েতের জন্য দিনরাতের আহাজারি, নিঃস্বার্থে অন্যের জন্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আমাদের আকাবির ও আসলাফের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আকাবির ও আসলাফরা যেমনিভাবে দরস ও তাদরিস এবং লেখা লেখনীর  মাধ্যমে  নবীর আদর্শ দিয়ে সারা বিশ্বে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করেছেন। অনুরূপভাবে দাওয়াত ও তাবলিগ এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেও দীনের বিশাল খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। সেই খেদমতেরই একটি অংশ টঙ্গীর ইজতেমা। এ ইজতেমার অসিলায় সারা বিশ্বে দেশের সুনাম-সুখ্যাতি ও পরিচিতি বাড়ছে। নিজের দেশের আর্তমানবতার সেবা হচ্ছে। পথহারা মানুষ দীনের দিকনির্দেশনা পাচ্ছে। পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধন অটুট হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষের এ ইজতেমার রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করছেন স্বয়ং আল্লাহ।

ফলে প্রতিটি দীনি ভাইয়ের অন্তরে আছে এক অজানা প্রশান্তি। নেই কারও মনে আক্ষেপ। যেখানে ধনী-গরিব দেশি-বিদেশি সবাই একই ময়দানে, একই প্যান্ডেলের নিচে ওলামায়ে কিরামের বয়ান শুনছেন। আর কায়মনে মাওলার জিকির-আজকারে নিজেদের আবদ্ধ রেখেছেন। আখেরি মোনাজাতে আবালবৃদ্ধসহ সর্বস্তরের মানুষ শরিক হওয়াকে সৌভাগ্যের মনে করছে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দাওয়াত ও তাবলিগের এ পদ্ধতি চালু করেছেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি ইলহামি পদ্ধতি। তার কাজে ছিল ইখলাস। তিনি চিন্তা করে দেখলেন আলেম-ওলামারা তো কোরআন-হাদিস পড়ে দীনের ওপর চলতে পারবেন। কিন্তু আমজনতা যাদের কাছে দীনের কোনো সহি ইলম নেই, তারা কীভাবে জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি পাবে? তাদের কে সহি ইলম শিক্ষা দেবে? তাই বর্তমান দাওয়াত ও তাবলিগের পদ্ধতি তিনি চালু করেছেন।  আল্লাহ বিশ্ব ইজতেমায় আগত দীনি ভাইদের সব ধরনের বালামুসিবত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

            লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর