বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিএনপির অন্তঃসারশূন্য প্রস্তাব ও স্ববিরোধিতা

ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া

বিএনপির অন্তঃসারশূন্য প্রস্তাব ও স্ববিরোধিতা

মহামান্য রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। আমাদের সংবিধানের চতুর্থ ভাগের ৪৮ অনুচ্ছেদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ওপর প্রদত্ত ও অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের সংবিধানের ৭ম ভাগের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগদান করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০১২ সালে তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। যা অতীতে কোনো সময় ঘটেনি। সংবিধান মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের একক ক্ষমতা দিলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাহায্য নিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান নিয়ে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। অর্থাৎ মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা এককভাবে ব্যবহার না করে তিনি দেশের অপর তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। উক্ত সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজন নির্বাচন কমিশনারসহ মোট পাঁচজনের বিপরীতে দশজন ব্যক্তির নাম মহামান্য রাষ্ট্রপতির বরাবর সুপারিশ করেছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ দশজন ব্যক্তি থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অপর চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করেন। সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তারাই  সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং তারা পবিত্র সংবিধানকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিরপেক্ষভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। অতীতে কোনো সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেননি। যারা এ নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তারা মূলত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন।

আমরা জানি, বিএনপি এবং তার নেত্রী খালেদা জিয়ার মিথ্যাচারের রাজনীতি নতুন নয়। ক্রমাগত ভুল রাজনীতির কারণে খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি দিন দিন একটি গণবিচ্ছিন্ন সংগঠনে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর তাদের কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। তারা শুধু কোন দেশে কোন দল ক্ষমতায় এলো তা নিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নতুন নতুন ছক কষতে থাকে।  আমরা বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করেছি, ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে তাদের নিজস্ব ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা থাকে। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ওপর এ গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলটির কোনোরূপ শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস নেই। কোন দেশের কোন দলের বিশেষ প্রার্থী বিজয়ী হলে বিএনপির রাজনীতির ফায়দা হয়, তারা শুধু এ নিয়েই গবেষণা করে এবং কীভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে সুবিধা হয় বিএনপি শুধু সেই নোংরা হিসাবই করতে থাকে।  আমরা জানি বিএনপিও তার মিত্র জামায়াত-শিবির চক্র হাজার কোটি ডলার খরচ করে ক্রমাগত মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের কেনা পেশাদার লবিস্টদের দ্বারা বাংলাদেশের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এমনকি ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকাতে বাংলাদেশ সারা বিশ্ব থেকে বাণিজ্যে যে সাধারণ সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে, সেগুলো প্রত্যাহারের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, যা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক তথাকথিত নির্বাচন কমিশন সংস্কারের ফর্মুলা অন্তঃসারশূন্য এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। তার তথাকথিত সংস্কারের প্রস্তাব প্রমাণ করে বাংলাদেশের জনগণের ওপর কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির প্রতি তার কোনোরূপ আস্থা বা বিশ্বাস নেই। নির্বাচন কমিশন গঠন ও সংস্কার নিয়ে তিনি এমন কিছু প্রসঙ্গ এনেছেন যা ইতিমধ্যেই আমাদের সংবিধান ও নির্বাচনী আইনে বলবৎ রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানালেও তিনি আবার বলছেন, নির্বাচন কমিশন কিছু না, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ সরকার।

জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন। সংসদ ছাড়া এ আইন সংশোধন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা জানি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন কত নৃশংসভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। আজকে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন, কিন্তু তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে এক ভোটারবিহীন নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। মাগুরা উপনির্বাচন, ঢাকার ৯ ও ১০ আসনের নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। যার স্রষ্টা হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। যিনি ১ দশমিক ২৩ কোটি ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, চিহ্নিত ছাত্রদল ক্যাডারদের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার রাজনীতি স্ববিরোধী এর প্রমাণ বিএনপি জেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করলেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে।

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে সবাই সুষ্ঠু হিসেবে সার্টিফিকেট দিলেও খালেদা জিয়া বলছেন, বাইরে থেকেই নির্বাচন সুষ্ঠু দেখা গেছে, ভিতরে চলেছে নানা ষড়যন্ত্র। দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, জঙ্গিবাদের মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক আন্দোলনের ইস্যু তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় গিয়ে আবারও এথনিক ক্লিনজিং ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল যে কোনো নির্বাচনের সময় প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানায় এবং কোনো কোনো সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদানের কথাও বলেন। আমরা মনে করি, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথা বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে তার অজ্ঞতাকে প্রমাণ করে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, যারা বাংলাদেশের জনগণের রায়ের প্রতি একান্তভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং বরাবরই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটের রায় নিয়ে বার বার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের বাইরে অন্য কোনো উপায়ে অথবা বন্দুকের জোরে কিংবা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের লাশ মাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেনি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল এদেশের জনগণ গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে তারই প্রমাণ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব নেতৃস্থানীয় সংগঠন আজ বারবার বলছে জননেত্রীর বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের একটি রোল মডেল। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ সারা বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ এবং সারা দেশে আজ উন্নয়নের এক মহাজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে নারায়ণগঞ্জবাসীর নিরঙ্কুশ আস্থা ও বিশ্বাস সেই মহাজাগরণের প্রতিধ্বনি।

এ ধরনের একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও কোনো ধরনের গোলযোগবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছার প্রমাণ। আমরা আশা করি, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির স্থাপনকারী নারায়ণগঞ্জের এ নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক বন্ধুদের রাজনৈতিক চেতনা ও উপলব্ধিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করবে। যা আগামীতে বাংলাদেশের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উপযোগী হবে এবং দেশের মানুষের বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

সর্বশেষ খবর