সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রূপকল্প বাস্তবায়ন

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

রূপকল্প বাস্তবায়ন

ভারতের মধ্যপ্রদেশের চিত্রকুটের একটি বিবরণ আমি পড়েছিলাম। যিনি ওই এলাকার ৮০টি গ্রাম মামলা ও নালিশ পুলিশিমুক্ত করেছিলেন। তিনি হলেন সেই বিখ্যাত সমাজকর্মী ড. নানাজী দেশমুখ। তিনি দীনদয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পণ্ডিতদের, শিক্ষাবিদদের, সমাজকর্মীদের, মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে আন্তঃপারিবারিক এবং গ্রামীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন এবং সেই ৮০টি গ্রাম থেকে কেউ কোনো মামলা কারও বিরুদ্ধে কখনো করেনি। এমনকি দীর্ঘ সময়ের জন্য পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে থাকেননি। উন্নয়নশীল দেশগুলো, উন্নত দেশ বা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছতে না পারার পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া যে দুটি কারণে ব্যর্থ হয় তার একটি হলো আকস্মাৎ পরিবারের চিকিৎসা ব্যয়, যা দেশের বাইরে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয়িত হয়ে থাকে। যা কিনা হঠাৎ করে বিশাল আঘাত হিসেবে পরিবারের কর্তাকে আহত করে। কোনো কারণে অপচিকিৎসায় বা চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়ার কারণে, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির যদি অকালে মৃত্যু হয় তাহলে তো আর শেষ নেই।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো সমাজের একশ্রেণির লোকের পরামর্শে ভাইয়ে ভাইয়ে, পরিবারে পরিবারে মামলাবাজিতে লিপ্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চিকিৎসা ব্যয়, মামলা-মোকাদ্দমা ছাড়াও আরও একটি বিশেষ কারণ ভূমিখেকোদের দ্বারা দরিদ্রের ভূমি গ্রাস, উচ্ছেদ এবং বাঁচার তাগিদে তাদের শহরমুখী হওয়া। দুটো কারণে পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে বাধ্য হয়। তার একটি হলো চিকিৎসাজনিত কারণে ‘Out of pocket expenditure’-এর জন্য। অসুখ কোনো সতর্ক সংকেত দিয়ে আসে না। পারিবারিক বাজেটে কখনো চিকিৎসার জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ আমরা রাখি না। এমনকি সামান্য অসুখ থেকে কঠিন চিকিৎসার জন্য আমরা প্রাইভেট চিকিৎসাব্যবস্থাকেই অগ্রাধিকার দেই, যদিও এ ব্যাপারে সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে রয়েছে। নানাবিধ কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতালবিমুখ, সরকার এবং হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সবাই যদি আমরা আন্তরিক হই তাহলে এটা রোধ করা সম্ভব। নোবেল জয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাবনায় উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা সরকারের হাতেই থাকা উচিত।

শত্রুতা মেটানোর জন্য বহুল প্রচলিত তিনটি পদ্ধতি এ দেশে প্রচলিত আছে। যার একটি হলো, কাউকে পরামর্শ দিয়ে আপনজন কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে লাগিয়ে দেওয়া। ঘরে একজন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বিয়ে দিয়ে দেওয়া। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামিয়ে দেওয়া। আমি এখানে প্রথমটি নিয়েই আলোচনা করব। ছোট ভাইকে দিয়ে বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করিয়ে দেওয়া। একই বাড়িতে বসবাস করা সত্ত্বেও এক পরিবার অপর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে শুধু পারিবারিক দ্বন্দ্বই সৃষ্টি করে না, বরং ভ্রাতৃঘাতী হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে মদদ জোগায়। এখানে বিবেক কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না এবং মামলাটি সর্বশেষ জেদে পরিণত হয়। আর উকিল আপনাকে জিতিয়ে দেবেন, এই আশ্বাস তো আছেই। মামলা-হামলার ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিস্তৃতি লাভ করে ২০০১ সালের পর থেকে। ২০০১ সালের পরের মামলাগুলো হলো ভয়াবহ। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য অজামিনযোগ্য সব মামলা, যার পেছনে কোনো সত্যতা নেই। যেমন— ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, মহাসড়কে ডাকাতি মামলা ইত্যাদি। এমন সব মামলা এমন সব সম্মানিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা হলো যা জনগণের কাছে কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মামলার ভয়াবহতা আমাদের সবারই জানা। বাদী-বিবাদীর কঠোর পরিশ্রমের অর্জিত টাকা গ্রাম্য টাউট থেকে শুরু করে থানার পুলিশ, সর্বশেষ উকিলদের পকেট ভর্তিতে ব্যয় হয়। পাঁচ বছরের আগে কোনো মামলাই নিষ্পত্তি পায় না। প্রতি মাসে মাসে মামলার তারিখ নির্ধারিত হয়। মামলার এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে জন্ম নেয় দুর্নীতি এবং বিচার বিভাগে যদি দুর্নীতি হয় সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনোভাবেই সুশাসন থাকে না। তারপরে দুই পক্ষই যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এবং বিত্তবান বা সামর্থ্যবান হন তা হলে তো মামলা অবশ্যই নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে হাই কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়াবে। স্বাস্থ্য খাতের Out of Pocket Expenditure-এর মতো মামলাবাজির বহুমুখী ব্যয়, মধ্যবিত্ত পরিবারকে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে পারে। সরকারের উন্নয়ন, মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি কোনো কিছুই এটা ঠেকাতে পারবে না রাষ্ট্রীয়ভাবে।

শহুরে সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ সার্বিক সুবিধা গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়াও উন্নয়নের একটি পূর্বশর্ত। যেমন গ্রামে খাদ্য ও কৃষি প্রসেস করা, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ, গুণগত শিক্ষা ও আধুনিক চিকিৎসাসেবা, সর্বাধুনিক তথ্য ও আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা গ্রামীণ জনগণের প্রত্যেকের ঘরে পৌঁছে দেওয়া। আর এসব সুযোগ-সুবিধা সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারলেই একটা দুর্নীতিমুক্ত সুষম সমাজ গড়ে উঠবে আর তখনই নিম্ন আয়ের দেশগুলো মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। শহুরে সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিয়ে গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য একটা হালকা সরল রেখার বেশি যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। অর্থাৎ গড় হিসাব করলে গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য দৃশ্যমান হতে পারবে না।

ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া বরং বিদেশে পাচার করে দেওয়াটা একটি বিশাল ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া যা দেশকে সাইপ্রাস বা গ্রিসের মতো মধ্যম আয়ের দেশ থেকে নিম্ন আয়ের দেশে পরিণত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী ‘Wealth Without Work’ রাষ্ট্রকে যেমনি দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দেয় তেমনি এটা একটা মৃত্যুসম পাপ (Deadly sin) হিসেবে গণ্য করেছেন। আমার এই প্রিয় মাতৃভূমির জন্য মানুষ নামের কিছু কীট কর্তৃক ব্যক্তি শোষণের নব্য ধারা যা ব্রিটিশদের সমাজ শোষণের এক বাণিজ্যের মতো অকস্মাৎ ঘটিয়ে দেয়। সেটা হলো স্টক মার্কেটের শেয়ার বাণিজ্য। গত তিনবারের ঘটনায় মধ্যবিত্ত সন্তানদের শেয়ার মার্কেটে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া এমনকি আত্মহত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবার দরিদ্রসীমার নিচে পৌঁছে গেছে। সর্বতোভাবে সব দেশপ্রেমিক নাগরিক স্ব স্ব ক্ষেত্রে সততার সঙ্গে কাজ না করলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন কঠিন হবে না বৈকি?

দুর্নীতির ক্ষীর যদি সবাই খেতে চায় (যেটা শুধু সুবিধাভোগীদের হওয়া উচিত ছিল এবং যার শতকরা হার কোনোক্রমেই ২-৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়) তাহলে আমাদের নেতৃত্ব যতই বহুমাত্রিক দর্শনের অধিকারীই হোক না কেন কোনোভাবেই উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে ২০২১ সালে এবং উন্নত দেশে ২০৪১ সালে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আমরা শুধু দুর্নীতির ক্ষীর খাচ্ছি না। এমন কি উচ্ছিষ্ট খেতে ব্যস্ত হয়ে আছি। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে যা প্রতিধ্বনিত হয় তা হলো শুধু সততা। আন্তরিকতা, সুউচ্চ নৈতিকতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেই রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ সম্ভব। একই সঙ্গে সুশাসন, কর্ম ও অর্থের হিসাবও কঠিনভাবে প্রয়োজন, যাকে আমি একথার অডিট হিসেবে বুঝাতে চাচ্ছি।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর