বুধবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিয়ন্ত্রণবাদ জঙ্গিবাদের জন্ম দেয়

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

নিয়ন্ত্রণবাদ জঙ্গিবাদের জন্ম দেয়

বাংলাদেশে এখন নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের মহোৎসব চলছে। সরকার সবকিছু একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কার্যক্রমে মেতে উঠেছে। সরকার এখন সারা জাতিকে তার কব্জার ভিতরে আবদ্ধ করার নেশায় মেতেছে। সরকার মনে করছে তার জন্য যা ভালো বা মঙ্গলকর রাষ্ট্রের জন্যও বুঝি তা ভালো এবং মঙ্গলময়। সরকার জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে রাষ্ট্র্রের স্বীকৃত মৌলিক সংজ্ঞাগুলো। যেখানে আইনের ভাষায় রাষ্ট্রকে বলা হয় : ‘A body politic or society of men united together for the purpose of promoting their mutual safety and advantage, by the joint efforts of their combined strength.’ অথচ বর্তমান সরকার জনগণের পারস্পরিক স্বার্থ বা নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কাই করছে না।  যৌথ প্রয়াসের কোনো সুযোগ এই সরকার রাখছে না। বরঞ্চ শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিরোধী পক্ষের ওপর নির্বিচারে দমন পীড়ন চালাচ্ছে। সরকার রাষ্ট্র্রের কোনো সংজ্ঞাই মানতে চাচ্ছে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো। ষোল শতাব্দীর শেষ দিকে ফরাসি দার্শনিক জিন বোদিন রাষ্ট্রকে ‘Republic’ নাম দিয়ে বলেছেন ‘the State possessed sovereign power’ এবং তিনি আরও বলেছেন ‘A state is an association of families and their possession governed by supreme power and by reason। সতের শতকে ইংরেজ দার্শনিক থমাস হবস যুক্তি দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের ক্ষমতা অপরিসীম এবং তিনি তার বিখ্যাত বই ‘Theory of complete soveignty’ তে আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, ‘The State is a union of families and villages and having for an ends a perfect and self-sufficing life by which we mean a happy and honorable life|’ myBm AvBb welvi` Johann Kaspar Bluntschli eGjGQb, ‘state is a politically organized people of a definite territory.’ খ্যাতনামা ইংরেজ রাজনৈতিক বিষারদ হ্যারোল্ড লাস্কি বলেছেন, ‘a territorial society divided into government and subjects claiming within its allotted physical area, a supremacy over all other institutions’। একইভাবে আমরা দেখি বিখ্যাত জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওপেনহেমকে উচ্চারণ করতে ‘The state exists when a people is settled in a country under its own sovereign government.’|

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার বিনীত উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র যে কারও একক সম্পত্তি নয় তা সংশ্লিষ্ট সবার সামনে তুলে ধরা। আমাদের ধর্ম, চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, ভাবনা, ধারণা, প্রত্যাশা ইত্যাদি সবকিছু যার যার। এগুলো নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধ থাকা বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। আমরা একক জনগোষ্ঠী। আমরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সনাতন ধর্মাবলম্বী, ধর্মভীরু, ধর্ম বিশ্বাসী, ধর্ম বিদ্বেষী, মৌলবাদী, নাস্তিক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের-বিপক্ষের সবাই বাংলাদেশি। রাষ্ট্র আমাদের সবার। আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম। রাষ্ট্র আমাদের সবাইকে তার নিজ নিজ ধর্ম, চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, ভাবনা, ধারণা, প্রত্যাশা ইত্যাদি সবকিছু যার যার মতো করে ভোগ করার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পছন্দের সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধান আছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন করতে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ আছে এবং যে সংসদ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজনে সংবিধান পরিবর্তনও করতে পারে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইন আছে, বিচার ব্যবস্থা আছে। দক্ষ প্রশাসন, সুশৃঙ্খল পুলিশ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্র্রের আছে কিন্তু তারপরও দেশে জঙ্গিবাদের হুমকি থেকে কেন জাতি মুক্তি পাচ্ছে না তা সবার সামনে একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

দার্শনিক এরিস্টটলের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র্রে সব মানুষ ও সমাজের নিরাপদ, সুখী ও সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকার কথা ছিল। কোনো রাষ্ট্র্রের নাগরিকের রাষ্ট্র্রের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার শর্ত তো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কখনো দেয়নি। বিলুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভিন্নমতাবলম্বীদের অস্তিত্ব ইতিহাস দেখেছে কিন্তু বিশ্বরাজনীতিতে আজকে নিয়ন্ত্রণবাদীরা বিলুপ্ত। এক সময় ওইসব নিয়ন্ত্রণবাদীই ধর্মকে আফিম বলে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে নতুন মাদক ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেছিল। জনগণের মাঝে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজতন্ত্র নামে আরেক বটিকা চালু করেছিল ওই সময়কার নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। আজকে ইতিহাস সাক্ষী দেয় শেষ পর্যন্ত ধর্মই নিয়ন্ত্রণবাদীদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে মুক্ত করে। সারা বিশ্বে এখন কোনো খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাও আছে তা নামকাওয়াস্তে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র্রেই এখন ধর্মের প্রাধান্য। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েই ছুটে যাবেন গির্জায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তো প্রকাশ্যেই হিন্দু রাষ্ট্র যেখানে ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। আসাম থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে অহিন্দুদের। অপর পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে ধর্মীয় কারণে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রাধান্য নেই। সব রাষ্ট্র্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রাধান্য স্বীকার করেই সব ধর্মের সহাবস্থান। কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। তবে ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু ধর্মান্ধকে কেউ নিষিদ্ধও করে না। রাষ্ট্র ধর্মহীন নাস্তিক ও ধর্মান্ধতাকে একসঙ্গে তাদের অধিকার ভোগ করা নিশ্চিত রাখে। যার ফলে রাষ্ট্র নিরাপদ থাকে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে।

সমাজতন্ত্র আজকের বিশ্বে বিলুপ্তির পথে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর যে লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অর্থনৈতিক প্রয়াস চালানো হয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারণে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। আজকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মানুষের স্বাধীন সৃজনশীল মনন ও প্রচেষ্টা ছাড়া জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ বা তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন করা যায় না। তাই বিশ্ব আজকে সমাজতন্ত্রকে পরিহার করে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বর্তমান সময়ের চাহিদা হিসেবে মেনে নিয়েছে।

মানুষ বনের তোতা পাখি নয় যে তাকে যা শেখানো হবে তা-ই শেখবে। বিশ্বের অনেক নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র তার জনগণকে শিক্ষার নামে তোতা পাখির বুলি শেখাতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি। অনেক শাসক ও শাসকগোষ্ঠী তাদের মতবাদে শিক্ষিত করার জন্য মগজ ধোলাই করার প্রচেষ্টা কম করেনি কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় ওই শাসক বা শাসক দলরা কেউই টিকে থাকতে পারেনি। জনগণ যা শেখতে চায় তা জনগণের নিজের তাগিদেই শিখে নেয়। রাষ্ট্র সেখানে নিমিত্ত মাত্র। এরিস্টটলের ভাষায়— রাষ্ট্র সম্মানজনক পরিবেশ সৃষ্টি করবে যেখানে জনগণ তার নিজের সম্মান অর্জনের শিক্ষা নিজের তাগিদেই গ্রহণ করবে। জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিবেশ আধুনিক রাষ্ট্র ধারণ করে না। শিক্ষা কখনই সুনির্দিষ্ট হতে পারে না। শিক্ষা হতে হবে সর্বজনীন, মুক্ত, অবাধ ও চিরন্তন। মানুষের শিক্ষার আগ্রহ অফুরন্ত তাই আধুনিক রাষ্ট্র্রে শিক্ষার দ্বার থাকবে সবার জন্য উন্মুক্ত। আধুনিক রাষ্ট্র্রে জনগণের আত্মতৃপ্তি অর্জনের সব উপাদান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। এরিস্টটল বলেছেন ‘having for an ends a perfect and self-sufficing life|’

জনগণ গরুর খামার নয় যে তাকে খাওয়ানো-পরানো হবে আর সে অনেক পরিমাণে দুধ দেবে অথবা মোটাতাজা করা হবে কোরবানির মাংসের জন্য। জনগণ তো খাঁচায় রাখা মুরগির পাল নয় যে উন্নত আধুনিক পরিবেশে রাখা হবে যাতে অনেক বেশি ডিম বা মাংস পাওয়া যায়। অনেক নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র চেষ্টা করেছে জনগণকে খাঁচায় বন্দী রেখে উন্নয়নের সাগরে ভাসিয়ে দিতে কিন্তু ইতিহাস বলে, কালের করাল গ্রাসে ওই নিয়ন্ত্রণবাদীরাই ভেসে গেছে। আইনের ভাষায় যা শুরুতেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক কাঠামো বা সমষ্টিগত জনগণের সমাজ যারা জনগণের সম্মিলিত শক্তি দ্বারা জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় জনগণের পারস্পরিক নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কাজেই জনগণের ঐক্য, সম্মিলিত শক্তি ও যৌথ প্রয়াস ছাড়া জনগণের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা তথা কোনো উন্নয়ন করার সুযোগ আধুনিক রাষ্ট্র্রের নেই। একক কোনো গোষ্ঠী বা পক্ষের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কখনই টিকে থাকেনি।

বিশ্বে স্বীকৃত মতবাদ হলো ‘state is a politically organized people of a definite territory.’। রাষ্ট্র হলো একটি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণ। জনগণের রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংগঠনিক কাঠামো নিশ্চিত হয় জনগণের প্রণীত সংবিধান দ্বারা। তাই আধুনিক রাষ্ট্র্রের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। যেহেতু রাষ্ট্র মানেই রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনগণ, তাই রাষ্ট্র কখনই বিভাজন সৃষ্টি করাতে পারে না। এতে রাষ্ট্র্রের সংহতি বিনষ্ট হয়, কাঠামো দুর্বল হয়, জনগণের মাঝে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়, বিদেশি শক্তিকে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দেয়, সর্বোপরি রাষ্ট্র্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে থাকে। যার ফলে জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং জনগণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি তথা উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই জনগণকে বিভাজন করার সব প্রকার প্রচেষ্টা নিরুৎসাহিত করা আধুনিক রাষ্ট্র্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমরা একটি আন্তর্জাতিক মতবাদে দেখি ‘The state is a community of persons, more or less numerous, permanently occupying a definite portion of territory, independent (or nearly so) of external control and possessing an organized government to which the great body of inhabitants render habitual obedience.’। এই মতবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘possessing an organized government to which the great body of inhabitants render habitual obedience.’। অর্থাৎ রাষ্ট্র্রের একটি সংগঠিত বা নির্বাচিত সরকার থাকবে যাদের ওপর বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য থাকবে। এখানে গভর্নমেন্টের আগে অর্গানাইজড শব্দটি জুড়ে দিয়ে সরকারের গঠন প্রক্রিয়াকে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। জনগণ দ্বারা সরকার সংগঠিত হতে হবে এবং সরকারের প্রতি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য থাকতে হবে। এখানে একপেশে নির্বাচন বা নিজেকে নিজেই নির্বাচিত বা জনগণ দ্বারা সংগঠিত বা জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের একক ঘোষণা বলে কোনো সরকার গঠনের সুযোগ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র সম্বন্ধে আরেকটি মতবাদ আছে, যা প্রথমদিকে উল্লেখ করেছিলাম যে একটি রাষ্ট্র দৃশ্যমান হয় যখন একটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সরকারের অধীনে একটি দেশে বসবাস করে। এখানেও নিজস্ব সরকার বলে জনগণের নির্বাচিত সরকারকেই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। জনগণ বলতে কখনই জনগণের খণ্ডিত রূপ বা কোনো রাজনৈতিক দল বুঝায় না। বিশ্বের যে কোনো সরকারকে বৈধতা পেতে হলে তাকে অবশ্যই জনগণ দ্বারা সংগঠিত হতে হবে এবং তাদের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য থাকতে হবে। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার সম্বন্ধে আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত উক্তি : ‘of the people, by the people, and for the people.’ যা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রে সরকার কোনো একক ব্যক্তিত্ব নয়। এখানে মন্ত্রিপরিষদ সম্মিলিতভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকে। রাষ্ট্র্রের সব সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করে থাকে। সংসদীয় সরকারের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর বহুবচন চরিত্র। একাধিক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ব্যক্তির সিদ্ধান্তের চেয়ে বহুগুণে ভালো এ সর্বজন স্বীকৃত বিশ্বাস থেকেই সংসদীয় সরকার বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সরকার পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যদি মন্ত্রিপরিষদ অযোগ্য না হয় তাহলে কোনো স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। যোগ্য মন্ত্রিপরিষদ হলে কখনই প্রশাসনিক অরাজনৈতিক আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। সংসদীয় সরকার একটি অত্যন্ত উঁচুমানের টিমওয়ার্ক। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে একজন দক্ষ টিম ক্যাপ্টেন তথা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী টিমের অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদের নেতৃত্ব দেন এবং মন্ত্রীরা নিজেদের দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী স্ব স্ব মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন। সেখানে সব কাজে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতিত্ব দেওয়া মন্ত্রীদের অযোগ্যতাই প্রমাণ করে। তাছাড়া সব কাজের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে চাপালে প্রধানমন্ত্রী অহেতুক বিতর্কিত হন, রাষ্ট্র্রে দুর্নীতির সুড়ং তৈরি হয়, সিদ্ধান্তে অচলাবস্থা বাড়ে, আমলাদের প্রাধান্য সৃষ্টি হয়, পারিবারিক হস্তক্ষেপের কলেবর বৃদ্ধি পায়, রাজনৈতিক মাফিয়াচক্র তৈরি হয় এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজের অজান্তে এক অলঙ্ঘনীয় দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হন যার পতন ছাড়া পরিবর্তন হয় না। তাই বিশ্বব্যাপী আধুনিক রাষ্ট্র্রে এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকারকে অনুৎসাহিত করা হয়।

দ্রুত বিকাশমান এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও তারুণ্যনির্ভর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সরকার এখন পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রেই কাম্য নয়। রাষ্ট্র জনগণের জন্য। জনগণ ক্রমবর্ধিত এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। জনগণ সব সময় সর্বকালে তার নিজের সরকার চায়। ৫ বছর বা ১০ বছর অনেক সময়। এ দীর্ঘ সময়ে জনগণের গঠন, চরিত্র, মনন, মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটে যার ফলে সবাই সব কিছুতেই পরিবর্তন চায়। জনগণ সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন চায় শাসক এবং শাসক গোষ্ঠীর। যেখানে পরিবর্তন নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক সেখানে জনগণকে সংগ্রাম করতে হয় না। কিন্তু যখন পরিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় বা আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য ষড়যন্ত্র করা হয় তখনই জঙ্গিবাদের উত্থান হয়। নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র্রে জঙ্গিবাদের জন্ম হবেই যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমনকি নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র্রে যাদের জঙ্গি দমনে নিয়োজিত করা হয় একদিন সময়ের প্রবাহে তারাই রাষ্ট্র্রের জন্য হুমকি হয়ে যায়, যার বহু প্রমাণ বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।  তাই আজকে আধুনিক রাষ্ট্র্রে ক্ষমতার পালা বদলের পথ সুস্পষ্ট, নিয়মিত এবং দৃশ্যমান রাখা হয়েছে। ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পথকে সন্মানিত এবং গৌরবান্বিত করা হয়েছে।  আমাদেরও সেই সুন্দর পথে হাঁটা বিজ্ঞোচিত যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হবে বলেই জনগণ বিশ্বাস করে।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর