মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

কঠিন পাথরে বাঁধা জীবন

শাইখ সিরাজ

কঠিন পাথরে বাঁধা জীবন

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমান্তে মহানন্দা নদী। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম দিক দিয়ে ভারত থেকে এসে বাংলাদেশে ঢুকে ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুরাতন তেঁতুলিয়া বাজারের দক্ষিণ দিক দিয়ে আবারও ফিরে গেছে ভারতে। বাংলাদেশ-ভারত সীমানা নির্ধারণ করেছে এই নদী। নদীর মধ্যস্থল থেকে পূর্বে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে ভারত। বর্ষায় ভারত থেকে আসা পানিতে দুই কূল ছাপিয়ে আবাদি জমি তলিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের পর প্রায় সারা বছরই খরস্রোতা থাকত এই নদীটি। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও এখানে এসে দেখেছি অনেক পানি। অথচ এখন ওই নদীটি দেখতে সরু খালের মতো। যদিও মহানন্দাকে নদী বলেই চিনি আমরা সবাই। এখন চারদিকে শুধুই ধু-ধু বালুচর। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মহানন্দা বয়ে আনে প্রচুর ছোট-বড় পাথর। নদীর পানি কমে গেলেই বহু মানুষ দল বেঁধে নেমে পড়ে পাথর তুলতে। পাথর তোলার দৃশ্যটি কেমন হতে পারে তা আমরা কেউ কেউ জানলেও নিজ চোখে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মানুষের অসম্ভব পরিশ্রমের এক চিত্র ফুটে ওঠে মহানন্দায়। পাথর উত্তোলনের কায়িক পদ্ধতি একেবারেই ভিন্ন। যুগ যুগ ধরে মহানন্দা নদী থেকে পাথর তুলছেন এখানকার পাথরশ্রমিকরা। এখানকার সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার এক বড় উৎস পাথর উত্তোলন। ঝুড়িতে ভরে পাথর ঘাড়ে নিয়ে তা ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে সুখ খোঁজেন। ভোর থেকে শুরু করে বিকাল অবধি পাথর তোলেন তারা। এক অদ্ভুত জীবন তাদের। কী ভয়ানক কায়িক শ্রমের চিত্র দেখেছি, তা সত্যিই ভাষায় বলে প্রকাশ করা কঠিন। আমি জানতে চেষ্টা করেছি আমাদের নদীগর্ভের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা। এর পাশাপাশি জানার চেষ্টা করেছি এই পাথরশ্রমিকরা আসলে কেমন আছেন?

বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পুরাতন বাজার পর্যন্ত সড়কপথে ১৮ কিলোমিটার হলেও মহানন্দা নদীটি প্রায় ৩২ কিলোমিটার। নদীপাড়ের বাংলাবান্ধা, ঝাড়ুয়াপাড়া, জায়গীরজোত, পাগলিডাঙ্গী, সন্ন্যাসীপাড়া, উকিলজোত, কাশিমগঞ্জ, দক্ষিণ কাশিমগঞ্জ, জামাদার গছ, ভক্তিডাঙ্গী, খয়খাটপাড়া, দৌলতপাড়া, দরগাসিং, রণচণ্ডী, ইসলামপুর, কালারামজোত, বুড়িমুটকি, সর্দারপাড়াসহ আশপাশের প্রায় ৫০টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা ভূগর্ভের পাথরনির্ভর। এই মানুষগুলোর কাছে পাথর হলো প্রকৃতির এক অন্যরকম দান। কঠিন পাথরের সঙ্গেই বাঁধা এই মানুষগুলোর জীবন। তাই এদের কাছে মুখস্থ যেন পাথরের জীবনরহস্য। পাথরশ্রমিক মকবুলের কাছ থেকে জানলাম তিনি ২০-৩০ বছর যাবৎ এই কাজ করছেন। এক বেলা পাথর উঠিয়ে আয় করেন ৪০০ টাকা। মারাত্মক কঠিন এই কায়িক শ্রমের মূল্য খুবই স্বল্প বলে মনে হলো। আমি নিজেও পাথরের ঝুড়ি তোলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সে এক অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয়। কীভাবে এত ভার বহন করা যায়, তার উত্তর খুঁজে পেলাম না। অথচ নদী থেকে পাথর তুলে তা ঝুড়িতে ভরে পাশের মাঠে জমা করছেন এক বেলায় বহুবার, বহু শ্রমিক, অবলীলায়। কল্পনার বাইরে যে শ্রম। অন্য শ্রমিকরাও বললেন একই কথা। দিনে কেউ কেউ হয়তো সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। এর চেয়ে বেশি কেউ নয়।

 

 

মহানন্দার টলটলে স্বচ্ছ পানি, নিচে বালি আর বালির গভীরেই পাথর। নদীর এই তলদেশ খুঁড়ে পাথর তুলে আনা সত্যিই এক কঠিন কাজ। যারা এই কাজগুলো করেন, আপাতদৃষ্টিতে তাদের স্বাধীন পাথর আহরণকারী মনে হলেও মূলত এরা পাথর তোলা শ্রমিক। কোনো না কোনো ব্যবসায়ী ও ইজারাদারের অধীনে তারা পাথর তোলার কাজটি করছেন। এখানেই পাওয়া গেল এমন একজন ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলামকে। তিনি জানান, পাথর তোলা এবং তা মেশিনে ভাঙানো ছাড়া তার আর তেমন কোনো খরচ নেই। বলা চলে, একরকম বিনিয়োগ ছাড়াই এই পাইকার বা তার মতো আরও ২০-২২ জনের মতো পাইকার এ অঞ্চলে নিরঙ্কুশ লাভ করে যাচ্ছেন। নদীর যে জায়গাগুলোয় পাথর রয়েছে তা পরীক্ষা করার জন্য রয়েছে স্থানীয় এক কায়দা। একটি সরু রড যার ওপরটি হাতলের মতো। সেই সরু রড তারা শুকনো নদীর বুকে ছিপছিপে পানিতে ঢুকিয়ে দেন এবং বুঝতে পারেন পানির নিচে কতটুকু পাথর পাওয়া যেতে পারে। পানির নিচে রড ঢুকে যেখানে আটকে যায়, বুঝতে হবে সেখানে পাথর আছে। যেখানে পাথর পাওয়া যায় সেখানে খোঁড়া হয় গর্ত। কিন্তু কীভাবে পাথর তোলা হয়?

প্রিয় পাঠক! এরপর পাথর তোলার যে দৃশ্য দেখলাম, তা সত্যিই আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমনও হতে পারে? সংগ্রামের এমন কোনো দৃশ্যপট বা বাস্তবতা আমার এই সুদীর্ঘ ৪০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে চোখে পড়েনি। এই একবিংশ শতকে, এমন কোনো দৃশ্য যে আমাকে দেখতে হবে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। কাকে বলে জীবনসংগ্রাম? জীবন-জীবিকার জন্য এ রকম নিত্যকার কাজ থাকতে পারে? গর্তে নেমে দীর্ঘক্ষণ ডুব দিয়ে থেকে একজন ঝুড়িতে পাথর পূর্ণ করে আনলেন। পাথরের সঙ্গে এলো বালি। শ্রমিকদের বালি সরাতে সময় লাগবে ১৫ মিনিটের মতো। পাথরশ্রমিকের সঙ্গে কথা হলো। জানলাম প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ তিনি এভাবে ক্রমাগত ডুব দিয়ে পাথর তুলে আনছেন। জানলাম আরও আধঘণ্টা এভাবেই ডুব দিয়ে যাবেন তিনি। পাঠক! এই পাথরশ্রমিক ১২ বছর ধরে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা এভাবে ডুব দিয়ে মহানন্দার বুক থেকে পাথর তুলে আনছেন। ভাবতে পারেন? এভাবে পালাক্রমে নতুন নতুন পাথরশ্রমিক ডুব দিয়ে পাথর তুলে আনেন স্থানীয় একটি চালায়, স্থানীয়রা যাকে বলেন ‘দাখলা’। এদের অধিকাংশেরই ধারণা পাথরেরও প্রাণ আছে। পাথর বাচ্চা দেয়। তাদের ধারণা বালির তল থেকে পাথর বাচ্চা দেয়। অবশ্য খনি প্রকৌশলী ড. কামরুজ্জামান বলছেন, এই ধারণা মোটেই বৈজ্ঞানিক নয়, একেবারেই ভ্রান্ত লোকবিশ্বাস। একটি পাথর যখন আর একটি পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খায় তখন অন্য একটি টুকরো হয়। সেই টুকরোগুলোকে স্থানীয়রা ভাবছেন পাথরের বাচ্চা, এমনটাই বলছিলেন ড. কামরুজ্জামান।

পাঠক! যে কথা না বললেই নয়, ভারতের একতরফা বাঁধের কারণে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে মহানন্দার বাংলাদেশ অংশ। বছরের বেশির ভাগ সময়ের বিশুষ্ক এই নদীতে কমবেশি সারা বছরই চলে পাথর সংগ্রহের কাজ। মহানন্দার বুকে কোথাও হাঁটুপানি কোথাও কোমরপানিতে গা ভাসিয়ে পাথর সংগ্রহ করে পুষ্টিহীন এই মানুষগুলো। কষ্টার্জিত এই সম্পদের মালিক তারা নন। তারা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন ঠিকাদার বা ইজারাদারের। একেবারে বাল্যবয়স থেকে পাথর তোলার এই কঠিন শ্রমে নিয়োজিত, এদের একেকজনের শরীরই যেন পরিণত হয়েছে পাথরে। নিখাদ শরীর। প্রতিদিনের পরিশ্রমে পরিণত হয়েছে যেন খাঁটি সোনায়।

পাঠক! আবারও বলছি, এখানে আজকের দিনের যাবতীয় আধুনিক আয়োজন, প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরতা নেই, আছে শুধু শরীরের শক্তি আর কঠিন মনোযোগ। শত বছর আগেও এই মানুষগুলোর পূর্বপুরুষ এভাবেই পাথর তুলেছে। এখানে পৃথিবী যেন থেমে আছে। সাত-আট থেকে ১২-১৪ জনের একেকটি দল ছোট বাঁশের তৈরি হোঁচা দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে পাথর তুলে আরেকটি ডালিতে ঢেলে দেয়। ডালিভর্তি পাথরের বাঁক কাঁধে নিয়ে আবার নদীর পানিতে হেঁটে এসে নদীর পাড়ে পাথরগুলো জমা করে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে পাথর তোলা। এ নিয়ে আমি কথা বলেছি পঞ্চগড় প্রেস ক্লাবের সভাপতি এ রহমান মুকুলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এখানে ১৮টি পাথরমহাল আছে, কিন্তু পাথরশ্রমিকরা মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যের শিকার। এই প্রাকৃতিক সম্পদ ঘিরে বিভিন্ন মহলের অর্থ উপার্জনের তত্পরতাও রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে পাথর তোলা মানুষগুলোর কঠিন জীবন-জীবিকার দিকেই দৃষ্টি চলে যায়। মনে করিয়ে দেয়, নদী কতভাবে বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। যত কঠিনই হোক পাথর তোলা এই মানুষগুলোর জীবন, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে এর মাঝেই সে খুঁজে পায় জীবনের সুখ, তৃপ্তি ও স্বাধীনতা। আমাদের শহুরে জীবনের বিত্ত-বৈভবের ভিতর যেটুকু তৃপ্ত আমরা হতে শিখিনি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর