মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

কর্মজীবী নারী

শাওলী সুমন

তিন সপ্তাহ আগে ৭ মার্চ সন্ধ্যায় টিভির এক চ্যানেলে একটি গবেষণার তথ্যমতে জানলাম, বাংলাদেশে ৩৩%  মাত্র কর্মজীবী নারী-জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর অবস্থান উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। ‘কর্মজীবী নারী’— সংজ্ঞা এবং কর্মজীবী নারীর জন্য— দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ বিশ্লেষণ গবেষকরা করছেন। আমি নিজ দৃষ্টিকোণে দেখতে চাইলাম— প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছরের কর্মজীবনের আলোকে। দেশের সংবিধানসহ বহু আইন, বিধি, নির্দেশনা সরকারি আদেশের পাশাপাশি বাঙালি লালিত ঐশ্বর্যময় সামাজিক পারিবারিক কৃষ্টি ‘নারীকে’ সমৃদ্ধ রেখেছে। আমার ভাষা ‘মায়ের ভাষা’ আমার দেশ দেশমাতৃকা বহু বিশেষণে নারীকে নিয়ে বহমান বাংলাদেশ প্রতিদিন। ‘মা দিবস’ বা নারী দিবস— উপনিবেশকারী ব্যবসায়ী মননের পৃষ্ঠপোষকদের ‘সীমাবদ্ধ’ দৃষ্টিকোণ মনে হলেও— ‘আকাশ সীমাহীন’— এ কারণে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সীমান্তরেখা অতিক্রম করে সব নারীকে একটি এককে আনার সাফল্য হিসেবে দিবসগুলোর গুরুত্ব অনুভব করি। ‘কর্মজীবী নারী’-এর সংজ্ঞা- পরিসংখ্যান গ্রহণে যে উপাত্ত সংগ্রহের প্রক্রিয়া বা পরিসীমার সূচক কী বোঝার চেষ্টা করি। এভাবেই কর্মক্ষেত্রে সংজ্ঞা কী হতে পারে? সাধারণভাবে একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে একটা লক্ষ্য বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ নারী তার সমগ্র সত্তা নিয়ে জীবন শুরু করে। শৈশবের শিশুকন্যা— তার ছোট ভাই-বোনের পরিচালনা-পরিচর্যা, মায়ের ঘরকন্না সহায়তাসহ বাড়ির হাঁস-মুরগি, ছাগল, গরু, কবুতর উঠান নিকানো, আঙিনায় চারা গাছ রোপণসহ সন্ধ্যার কুপি জ্বালানোর কর্মযজ্ঞ থেকে কিশোরী-যৌবনে পুরুষের সঙ্গী হিসেবে তার সন্তানের মা- পরিচর্যাকারী, রান্না, প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে সামাজিক সব কাজ করে চলে। কৃষিজীবী পরিবারের মাঠের ফসল তোলার পর শুকানো, মাঠে নিড়ানো, শস্যের প্রক্রিয়াকরণ সবই নারী করে। জেলের মাছ সংরক্ষণ, শুঁটকিতে রূপান্তর, তাঁতির বুনন শেষে আয়ের উৎস সৃষ্টি করে নারী অথচ নারীর জন্য কোনো কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত না হয়ে— নারী মাতৃত্ব লালন বুকে পিঠে কর্মের বিশাল বোঝা নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে চলছে— পথটা এখনো কেউ আবিষ্কার করতে পারল না। সপ্তাহখানেক আগে আমার কন্যা উল্লসিতভাবে বলে মা, বিজ্ঞানীরা আরও ছয়টা পৃথিবী আবিষ্কার করেছেন। অথচ অতি সাধারণ সৃষ্টির সহায়ক অবস্থান নর-নারীর কর্মক্ষেত্র আবিষ্কার আজও বিকাশিত হলো না। আমি সাধারণভাবে যাপিত জীবনের নারী। আমি হয়তো ‘গবেষণার’ জন্য গবেষকের মতো আবিষ্কারের সূচক চিহ্নিত করতে পারব না। ‘কর্মক্ষেত্রে— আমি সরকারি চাকরি করি— তাই নিজ ‘কর্মক্ষেত্র’— এ সূচকে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে চাই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে সেখানে আমি শিশু একাডেমিতে পাঁচ বছর কাজ করেছি। কর্মক্ষেত্রের বরাতে আমি দেশের বিভিন্ন আইন ও নির্দেশনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কাজ করি। বাজেটে ‘নারীর জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দ ও সূচক রয়েছে, সরকারি বাসা বরাদ্দের ক্ষেত্রে মহিলারা তিন বছর সিনিয়রিটি পান, নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০% কোটা রাখা আছে। বিভিন্ন সময় সরকারপ্রধানের নারীর প্রতি সংবেদনশীল মন ও অংশগ্রহণের অঙ্গীকার মনকে প্রসন্ন করে। শুরু হয়েছে চলা... কর্মক্ষেত্র আবিষ্কারের আলোকে নারীর কর্মক্ষেত্র উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবেই।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৩ কোটা বিভাজন সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদগুলো ৬০% মহিলা প্রার্থীদের জন্য পূরণ করার উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি মহিলা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার ন্যূনতম দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণের সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রকৃতির শিক্ষা ও আশীর্বাদে নারীর স্বকীয়তা, ধৈর্য, মমতা ও পরিচর্যার সহজাত ব্যক্তিত্ব প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনে অবস্থান করার সুযোগ বাংলাদেশকে প্রতিদিন আলোকিত পথে নিয়ে যাবে। যদিও বাস্তবতার অনেক সীমাবদ্ধতা উপসর্গ আছে। আজ আমি সেখানে যাব না। গত ৭ মার্চ নারী দিবসের আগের কর্মদিবসে নিজ কর্মস্থলে দিকভ্রান্ত হয়ে যাই। পূর্বসূত্র নিয়ে বলি, আমি যুগ্ম-সচিব হওয়ার পর সরকারি গাড়ি ও সহকর্মী হিসেবে গাড়িচালক আনন্দ সরকারকে পাই। রাস্তায় বেদনাদায়ক দীর্ঘ সময় চলাচল পথে তার সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখের কথা হয়। আনন্দ এক পুত্রের বাবা, রুদ্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ছয় তলার জানালার শিকে রুদ্র বিরূপ হয়ে ওঠে। আমি তাকে শিশু একাডেমিতে অঙ্কন, গানে ভর্তি করে দিই। রুদ্র এবার সৃষ্টির অপার আনন্দে বিহ্বল। লিটল অ্যাঞ্জেলস শিশু ক্লাসে পড়া রুদ্রকে প্রথম শ্রেণিতে ২০১৫ সালে ভর্তি করতে গিয়ে ব্যর্থ হই। ক্ষমতাধর আমলাদের কাছে গিয়ে বুঝতে পারি তারা নিজ লক্ষ্য ছাড়া প্রয়াসহীন। এ অভিজ্ঞতা আমার চিরচেনা ও সহনীয়। ‘নিজভূমে পরবাসী আমি’ এই অনুভব আমাকে পীড়িত করে না, করে অতিক্রমের পথ খোঁজার নেশা। ২০১৬ সালে রুদ্রকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আত্মার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত কনিষ্ঠ সহকর্মী সরোজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আকুলতায় সরোজ বিব্রত, কিন্তু সহযোদ্ধা হলো। জয়ী হয়েছি রুদ্র উদয়ন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। শুরু হলো তার যাত্রা। রুদ্রের সহপাঠীর মা কেরানীগঞ্জ শুভাঢ্যা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১১ থেকে শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করছে। দুই সন্তানের মা স্বামী ব্যবসায়ী। সন্তানের নিরাপদ শিক্ষার জন্য ঢাকায় থাকেন। শিক্ষিকা হিসেবে প্রতিদিন সকাল ৭টার আগে বের হয়ে রাতে ফেরেন। ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ যাওয়ার যে ব্যবস্থা টেম্পো, রিকশা, লোকাল বাস সব পেরিয়ে নিজ কর্মক্ষেত্রে শিক্ষাদানের মহান দায়িত্বে থাকেন। সন্তানরা মায়ের সাহচর্য ছাড়া বিবর্ণ পৃথিবীতে রয়ে যায়। সরকারি শিক্ষকদের বদলি বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। আমার অভিজ্ঞতায় এখানে যাওয়ার কোনো ম্যাপ আমি পাব না। কিন্তু ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পত্রিকায় দেখি এই বদলি সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে ন্যস্ত করা হয়েছে এবং অবাক করে দেয় মহাপরিচালক হিসেবে এসডিসিতে পরিচিত স্বজন সহকর্মী ড. আবু হেনা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমি সময় নষ্ট করি না। তত্ক্ষণাৎ ফোন করি ফেসবুকে অভিনন্দন জানাই। ফোনে আলোচনার সূত্র হিসেবে ঢাকায় বহু শূন্যপদের তথ্যসহ বদলির প্রস্তাবটি অগ্রায়ন করি।

‘এই কর্মক্ষেত্রে’ নারীর জন্য রয়েছে নোকতা, রয়েছে নির্দেশিকায় বদলির জন্য... তবে ক্যান্সার, কিডনি ফেইলুর হলে বিবেচনার সুযোগ থাকবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের বিনয়ী আশ্বাস। অথচ নির্দেশিকাটিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আমি দেখি না। বদলিসংক্রান্ত নির্দেশনা তার বদলির সহায়ক অথচ নারীর কর্মক্ষেত্রের এ হুঙ্কার বড় শক্তিশালী। আমি ‘কর্মক্ষেত্রে’ এই নারীর কিডনি ফেইলুর বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থেকে  গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন করলাম।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর