শিরোনাম
সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেদিন আমি না থাকলেও ক্ষতি নেই

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

সেদিন আমি না থাকলেও ক্ষতি নেই

সার্বক্ষণিক লেখক কথাটি কার জন্য প্রযোজ্য তা নিয়ে কিঞ্চিৎ ভাবনাচিন্তা করলাম। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশংকর এরা তো সারা দিন লিখতেন। এদের বাড়ি ঘুরে এসেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখার জন্য একটি ঘর তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে একটি তাকিয়া, তার ওপর কলম ও কালি প্রস্তুত। সামনে একটি কৃত্রিম হ্রদ। সেখানে কয়েকটি হাঁস খেলা করছে। আমি তাকিয়াতে বসলাম, কেউ বাধা দিল না। ভাবলাম যদি ‘বলাকা’র মতো একটি কবিতা লিখে যেতে পারি তা হলে বাংলা সাহিত্যে আমার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। একটু পরেই বুঝলাম যে ওখানে বেশিক্ষণ বসলে বকা খাব। তাই কবিতাটির দিকে আর ধাবিত হলাম না। কবিতাটি আমার মুখস্থ, তাই ওইটির পাশাপাশি কিছু শব্দ জুড়ে দিলেও নেহায়েত মন্দ লিখতাম না। উনি যখন নোবেল পান, তখনকার সাইটেশনটা আমি পড়েছি। তাতে রবীন্দ্রনাথ প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। তার সবগুলো বই তো দূরের কথা, তার দু-চারখানা বইও তারা স্পর্শ করেনি। নোবেল কীভাবে পায়, তা আমি জানি না। তাই কোনো দিন নোবেলের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি। আজ করছি।

যারা আল্লাহ এবং রসুল [সা.]-এ বিশ্বাস করেন এবং যারা এই পথে সাহিত্য অথবা অন্যান্য দিকে ধাবিত হয়েছেন, তারা নোবেল পাবেন কিনা আমার সন্দেহ। কারণ ওরা সবাই ধর্মনিরপেক্ষ এবং কেউ বা ইসলামবিরোধী। যখন শান্তির জন্য কেউ নোবেল প্রাইজ পান, তাদের বায়োডাটা আমাদের সামনেই তৈরি থাকে। যারা অসংখ্য দেশে বোমা মেরে মানুষ মেরেছেন, তারাও শান্তির পুরস্কার পান। কাজেই আমার মতো একজন হতভাগ্য লেখকের এই বলে সান্ত্বনা পাওয়া উচিত যে পৃথিবীর বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা নোবেল পাননি। তাদের মধ্যে : কালিদাস, শেকসপিয়ার, জালালউদ্দিন রুমি। নাম করলে পাতা ভরে যাবে। অন্যদিকে যারা নোবেল পেয়েছেন তাদের সাহিত্যকীর্তির দিকে ধাবিত হয়ে যা পেলাম তার তুলনা নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য এরা চয়ন করেছেন আমাদের জন্য। জয়তু নোবেল। বাংলার কতিপয় সাহিত্যিক যেহেতু অনেক বেশি চেনা, তাদের নোবেল না পাওয়ায় আমি বিশেষভাবে মর্মাহত। নামের তালিকা দীর্ঘ। ঘটনাক্রমে যদি নোবেল কমিটির সদস্য হতাম, তা হলে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি ও প্রবন্ধকারদের নোবেলের তালিকায় ঘন ঘন নাম দেখা যেত। কারণ এরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।

সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক লেখক। কয়েকটি বই লিখেছি। সেগুলোর আলোচনা খবরের কাগজে বেরিয়েছে বলে মনে হয় না। যারা খবরের কাগজে সার্বক্ষণিক কাজ করেন, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রশংসায় ক্লান্ত। নিজের বই কীভাবে বিক্রি করতে হয়, টেকনিকটা সুচারুরূপে তাদের আয়ত্তাধীন। বইয়ের দোকানে গিয়েও তারা নিজেরাই বই বিক্রি করছেন। প্রচ্ছদ কোনটা ভালো হবে এ নিয়ে চলছে নানা ভাবনা। হায় রে রবীন্দ্রনাথ! তোমার সবগুলো প্রচ্ছদই এত সাদামাটা কীভাবে হলো? নজরুলের প্রচ্ছদগুলো কেমন যেন সামঞ্জস্যবিহীন। শরত্চন্দ্রের বইগুলোর প্রচ্ছদ সবচেয়ে সাধারণ। ওদের বইগুলোর কোনো মোড়ক উন্মোচন হয়েছিল কিনা জানা নেই। তখনকার মুখ্যমন্ত্রীরা অথবা নিদেনপক্ষে বয়স্ক কোনো ব্যক্তি সেগুলোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন কিনা তার খবর সেদিনকার খবরের কাগজে স্থান পায়নি। আজ একটি পুস্তকের মোড়ক উন্মোচন হলে তার দাপট পত্রিকাজুড়ে, টেলিভিশনজুড়ে। এতে আমাদের মতো পাঠকদের সুবিধে হয়েছে। আমরা একদিনেই সেই লেখককে আবিষ্কার করতে পেরেছি। জীবনে যেমন তারা সার্থক, লেখক হিসেবেও তাদের অজর অমর কীর্তি একদিনেই ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেল নির্ঘাত। আমার কোনো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে বলে মনে পড়ে না। যার কীর্তি ক্ষণস্থায়ী, দুই দিনেই দুনিয়া তাকে ভুলে যাবে। আমার বইগুলো যারা ভালোবাসে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘উইপোকা’। ওরা বই পছন্দ করে, বিশেষ করে আমার মতো লেখকের। নিজের কথা বলা অনেকের অপছন্দ, আমার পছন্দ। এই কারণে যে আমি অন্যের কথা কেন বলতে যাব? নিজের কাছেই যখন অভিজ্ঞতার বিরাট সম্ভার। সত্যি কথা বলতে কী আমি দুই দিনেই একটি বই লিখতে পারি। আমার মনের মধ্যে এত কিছু সম্ভার জমা হয়েছে। একদিন নজরুল ইসলাম দেখা করতে গেলেন দার্জিলিংয়ের প্ল্যান্টার্স ক্লাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাকে চা-বিস্কিট কিছুই খাওয়ালেন না। বললেন, তোমাকে আমার শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে শোনাব, যা এক্ষুনি লিখেছি। নজরুল কী করবেন, বুঝতে পারছেন না, শুধু তার পদস্পর্শ করে বললেন হে মহান, তোমার কাছে আমি অনেক বড় কিছু প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এত বড় প্রত্যাশা স্বপ্নেও ভাবিনি। রবীন্দ্রনাথ ধীরকণ্ঠে বলে চললেন তার কবিতা। সেখানে উপস্থিত নই। লেখক হিসেবে সেই স্বপ্নের দেশ থেকে উদ্ধার করেছি তার মর্মবাণী। যারা বইটি পড়েছেন তারা জানেন, যাতে এমন কিছু ছিল, যা অপার্থিব। বইটির নাম : ‘পুড়িব একাকী’, নজরুলের জীবন নিয়ে প্রথম উপন্যাস। হুমায়ূন আহমদ [শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক] ঢাকা ক্লাবে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, আব্বাসী ভাই, বইটি পড়িনি। কিন্তু পদে পদে উপলব্ধি করেছি এর প্রতিটি বাণী সত্যি। একমাত্র আপনি এই বইটি লিখতে পারতেন। আর কেউ নয়। এতদিন পরে বলছি। হুমায়ূনের এ কথাটি আমার কাছে নোবেলের চেয়ে বড়। আরেক দিন কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে বললাম, আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। কতদিন ধরে বলছি আমার নতুন বাড়ির জন্য একটি পাখি উপহার দিতে। পাখিটির ছবিও দিয়েছি আপনাকে। কিন্তু এতই আপনার ব্যস্ততা যে আপনি আমার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। কাইয়ুম অপ্রস্তুত হলেন না। আমার হাতটি তার হাতে নিলেন। বললেন, আব্বাসী, তুমি জান না, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তোমার আত্মজীবনী : ‘জীবন নদীর উজানে’ বইটিতে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছি। আমার চোখে পানি। আমি তার পা ধরে সালাম করলাম। বললাম, কাইয়ুম ভাই, আমি দুঃখিত। আপনার এই কথাটি আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

যারা সার্বক্ষণিক লেখেন, তারা কী করেন এখন বলছি। আমি সারা দিন পড়ি এবং সারা দিন লিখি। অর্ধেক পড়া, অর্ধেক লেখা। ড. মুস্তাফা নূরুল ইসলাম কিছুদিন আমার ঘরের পাশেই ভাড়া থাকতেন। রাত তিনটে ওঠে উনি বাতি জ্বালিয়ে লিখতে বসতেন। একদিন জিজ্ঞেস করাতে বললেন, যারা লেখক, তাদের রোজই লিখতে হবে। তাই আমি এত রাতে লিখতে বসি।

একদিন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি রোজ ছাত্রদের গান শিখিয়ে নিজের রেয়াজের সময় কীভাবে বের করেন? উনি বললেন, আব্বাসী চাচা, আপনাকে একটি গোপন খবর দিচ্ছি। কেউ জানে না। রাত দুটোয় উঠে রেয়াজ করি, যার ফলে গলাটি এখনো ভালো আছে।

একদিন ফিরোজা বেগম আমাকে ফোন করলেন। তখন শিল্পকলা একাডেমিতে কাজ করি। বললেন, পদটি তোমার জন্য ক্ষতিকর হবে। রেয়াজ করতে পারবে না। আমার প্রশ্ন : আপনি কতক্ষণ করেন? বললেন, ১০ ঘণ্টা। দুই দিন পরেই আমি সেখান থেকে চলে আসি। যদিও আসাটা সুখকর ছিল না। এক ভদ্রমহিলা শাড়ির ব্যবসা করতেন, উনি ছিলেন আমার মন্ত্রী। আর ছিল ঝাঁকড়া চুলওয়ালা লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ান কতগুলো ছেলে। ওরা ছিল সংস্কৃতির অপর প্রান্তের লোক। শিল্পকলা ছাড়লাম। তাই চুয়ান্নটি বই। কোনটা ভালো হলো? এইটাই।

সার্বক্ষণিক হতে হবে। মফস্বলে থেকে যারা সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের নজর সাহিত্যের দিকে। তাই তাদের লেখা অনেক ভালো। শহরে প্রতিপত্তি নেই বলে ওরা পুরস্কার পান না। স্বয়ং জসীমউদ্দীন বাংলা একাডেমির পুরস্কার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কারণ নিয়ম হলে বই জমা দিতে হবে। উনি কেন বই জমা দেবেন? রবীন্দ্রনাথ হলেও তাকে বই জমা দিতে হতো। আমিও দি’ নি’। কোনো দিন দেব না। ওদের পুরস্কার কোনো দিন নেব না। ওরা নিজেরাই নিক। আর ধমক দিয়ে পুরস্কার নেওয়াটা সাহিত্যিকদের সাজে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরত্চন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, সুনীল, কখনো ধরনা দেননি। যারা পুরস্কার দেবে, তারাই ধরনা দিয়েছে। পুরস্কার দেবে শতাব্দী পেরিয়ে গেলে সাধু পাঠকরা। সেদিন আমি না থাকলেও ক্ষতি নেই।

     লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর