শিরোনাম
সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মেরাজ শরিফ এলো পবিত্র রমজানকে ডাকতে ডাকতে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মেরাজ শরিফ এলো পবিত্র রমজানকে ডাকতে ডাকতে

আকাশে ভাসছে রজবের চাঁদ। মুমিন হৃদয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে ভাবরাত্রির কথা। মেরাজের কথা। মেরাজ মানে আধ্যাত্মিক উর্ধ্বারোহণ। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) এর জীবনের বিশেষ বাঁকের নাম মেরাজ। যেখান থেকে নতুন করে পথ চলার প্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। যে বাঁক তাকে দেখিয়েছে সফলতার পথ। বানিয়েছে সফলতার রাজা। কী দুনিয়া, কী পরকাল, উভয় জগতেই মেরাজ ছিল নবীজী (সা.)-এর জন্য সফলতার সিঁড়ি। যে সিঁড়ি বেয়ে তিনি উঠেছেন মানবতার সর্বোচ্চ চূড়ায়, আধ্যাত্মিকতার শেষ মনজিলে গিয়ে খোদার খুব কাছে এবং মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেছেন। এ দুই জায়গায় পৌঁছার যে সিঁড়ি তিনি ব্যবহার করেছেন তার নাম মেরাজ।

মেরাজের পেক্ষাপট জানতে পারলে মেরাজের তাত্পর্য জানা সহজ হবে। কালেমার দাওয়াতের পর থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। যার মাত্রা মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও শিআবে আবু তালেবে বয়কটে গিয়ে থামে। তিন বছর খেয়ে না খেয়ে শিআবে আবু তালেবে বন্দী জীবনযাপন করতে লাগলেন নবীজী। ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে চাচা আবু তালেব মারা গেলেন। এর অল্প দিন পর মারা গেলেন খাদিজা (রা.)। আহা! পিতার মতো চাচা আর নিজের জীবনের অর্ধাঙ্গিনীর বিয়োগ ব্যথা যেন নবীজীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিপদের পথে কে দেবে সান্ত্বনা? কে বলবে ‘প্রাণের স্বামী আমার! ভয় পেও না! তুমি তো কারও অমঙ্গল কর না। খোদাও তোমার অমঙ্গল করবে না।’ কে বলবে, ‘আমার ভাতিজার গায়ে একটু আঁচরও আমি সহ্য করব না। ভাতিজা! তুমি তোমার আল্লাহর বাণী প্রচার করতে থাক। আমি আছি তোমার সঙ্গে।’

আপনজনদের এমন বিয়োগ যন্ত্রণা। তার ওপর মক্কার লোকদের সীমাহীন নির্যাতন। মক্কায় থাকাই যেন দায় হয়ে পড়েছে নবীজী (সা.)-এর। এক সকালে গোপনে চলে গেলেন তায়েফে। যদি তারা আমার খোদার বাণী শোনে এই আশায়। তায়েফের নির্মমতার কথা হয়তো পাঠকের জানা আছে। আশার আলো যেন আর জ্বলছে না। হতাশার অন্ধকার ক্রমেই ঘোলা করে দিচ্ছিল নবীজীর চোখ দুটোকে। সামনের পথ চলা যেন থেমেই যাবে- এমন অবস্থা।

কিন্তু, চরম দুঃখেও হতাশ হওয়া চলবে না। নয়তো আঁধারের পরে ভোরের দেখা মিলবে না। এ অবস্থায় আল্লাহতায়ালা নবীজীকে মানসিকভাবে দৃঢ় করার জন্য নিজের কাছে ডেকে নিলেন। প্রিয়জন হারানো ক্ষত হৃদয়ে আল্লাহ দর্শনের মলম মেখে দিলেন যেন হৃদয়ে। মানবজনমে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে? তবে এটাই মেরাজের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। রসুল (সা.) যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, যে সব বিষয়ের দাওয়াত তিনি মানুষকে দেবেন, সেসব বিষয় নিজ চোখে দেখে নেওয়া খুবই জরুরি ছিল। আবার এও জরুরি ছিল, আগে যারা এ মশাল হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ পাওয়া। সৌজন্য সাক্ষাৎও হলো অন্য নবীদের সঙ্গে। তাই তো বিভিন্ন আসমানে নবীদের সঙ্গে দেখার প্রোগ্রাম সূচি রাখা হয়েছে এই রাজকীয় ঐশী মেরাজ সফরে।

অন্য সব নবী থেকে মুহাম্মদ (সা.) দায়িত্ব ও মর্যাদা সবার ওপরে। এর অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ হলো, অন্য নবীদের নবুওয়াতি দায়িত্বের তুলনায় মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়াতি দায়িত্ব যথেষ্ট বেশি ও পরিশ্রম সাপেক্ষ ছিল। তাই অন্যদের ওপর নবীজীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য নবীজীকে ইমামের দায়িত্ব দিয়ে ‘ইমামুল মুরসালিনের’ চেয়ারে বসানো হয়েছে। এ তো গেল এক প্রসঙ্গ। অন্য সব নবীর পক্ষ থেকে আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাতের যে ওয়াদা রুহের জগতে নিয়েছিলেন সে ওয়াদার বাস্তবায়নও করা হয়েছে এ মজলিসে।

রাজকীয় এ ঐশী মেরাজ সফর বিভিন্ন প্রোগ্রামে আল্লাহতায়ালা সাজিয়েছেন। তারপর নিজের বন্ধুকে ‘কাবা কাওসাইনি আও আদনা’ কাছের চেয়েও আরও কাছে নিয়ে গেলেন। জান্নাত-জাহান্নাম দেখালেন। নবীদের সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যবস্থা করলেন। এভাবেই শেষ হয়েছে ঐশী সফর। এ সফর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘মহাবিশ্বের ত্রুটিহীন মহাপরিচালক তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসার দিকে, যার চারপাশের পরিবেশকে আমি করে দিয়েছিলাম বরকতময়। এ ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানো। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা ইসরা : ১।)

এ ভ্রমণের পর রসুল (সা.)-এর দাওয়াতি মিশনে নতুন জোয়ার আসে। অন্য নবীরা শত শত বছর মেহনত করেও যা পারেননি, আমাদের নবী (সা.) মাত্র ২৩ বছরের পরিশ্রমে সফলভাবে নিজ দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। অল্প সময়ে বিশ্বজুড়ে তার প্রচারিত ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল। হাজার বছর মানুষ এ ধর্মের পতাকা হাতে প্রতিনিধিত্ব করবে খোদাতায়ালার। চাঁদ ওঠে, চাঁদ ডোবে, ফিরে ফিরে আসে মেরাজের মাস। এ রজনী থেকেই মুসলমান প্রস্তুতি নিতে থাকে রমজানের। হে আল্লাহ পবিত্র মেরাজের বরকতে আমাদের ভাগ্যে রমজান নসিব করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর