বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য

আমিনুল ইসলাম মিলন

গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ও মাধুর্য হচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জনগণের মিত্রতা এবং সংগঠনের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থন। প্রাথমিক পর্যায়ে জনগণ ব্যক্তিকে নয়, প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করে, সমর্থন করে এবং ভালোবাসে। সেই সমর্থনের জোরে একটি রাজনৈতিক সংগঠন নির্দিষ্ট মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। সংগঠনকে ভালোবাসা ও সমর্থনের জেরে জনগণ সংগঠনের নেতা-নেত্রীকেও ভালোবাসতে শুরু করে। জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করে এ সংগঠনটি তার, তার পরিবারের; সর্বোপরি দেশের সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত প্লাটফরম।

সংগঠনের কর্তাব্যক্তির ওপর জনগণের ভালোবাসা, আনুগত্য, সমর্থন মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সেই কর্তৃত্বের বা নেতার আহ্বানে জনগণ নিজ নিজ জীবন-সম্পদকে তুচ্ছজ্ঞান করে নেতার নির্দেশিত পথে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গোটা বাঙালি জাতির অংশগ্রহণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। জনগণের সমর্থনে নির্বাচনে জয়লাভ করে একটি রাজনৈতিক সংগঠন যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেওয়া-নেওয়ার পর্যায়ে চলে আসে। দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষিসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, চাল-ডাল-তেল-নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজার জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিতকরণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বহুবিধ সরকারি কার্যক্রম যখন জনগণের কাছে গ্রহণীয় ও সহনীয় পর্যায়ে থাকে তখন জনগণ সরকারের প্রতি তাদের পূর্ব-প্রদত্ত আস্থা, আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রমাণ পায়। জনগণ সরকারের প্রদত্ত এসব সেবা বা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে প্রদেয় এসব কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। জনগণ পুনরায় এ সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ব্যক্ত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটিই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্য।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় নির্বাচনকালীন জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে বর্তমান সরকার অনেকাংশে সফল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বিরামহীন কর্মযজ্ঞে সরকারের সাফল্য জনগণের কাছে স্বীকৃত। এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। চাল-ডাল-তেল-নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য ২০০৮ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই রয়েছে, মাঝে মাঝে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া। অতিদরিদ্রের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশ পর্যন্ত টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববাসী এখন বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিবিধ বিষয়ে অভিজ্ঞতা গ্রহণে আগ্রহী। সরকারের এসব সাফল্য নিঃসন্দেহে আগামীতে সরকার গঠনের মূলযজ্ঞ নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, কিন্তু তার পরও কথা থেকে যায়। উন্নয়ন কি এককভাবে মানুষের সমর্থন আদায়ের চাবিকাঠি? ইতিহাস বলে, না, তা নয়। উন্নয়নের পাশাপাশি জনশান্তি ও জনতুষ্টি একটি বড় বিবেচ্য বিষয়। মধ্যরাতে কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে যদি দরিদ্র পেশাজীবী মানুষ দেখে ঘরে তার স্ত্রী, যুবতী কন্যা নিরাপদে আছে— তবেই তার কাছে সরকার তার রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি নিরীহ মানুষ দেখে তার জমি-জিরাত জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মী-নেতা ক্ষমতার দাপটে অন্যায়ভাবে গ্রাস করে না, তখন তার কাছে সরকারের উপস্থিতি ও সমর্থন ইতিবাচক। যদি জনগণ দেখে রাজনৈতিক পরিচয়ে কোনো কোনো নেতা-কর্মী জনগণের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করছে, অন্যদিকে তার বিচারের পথও রুদ্ধ, তখন জনগণ ক্ষুব্ধ হয়-আতঙ্কিত হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব ওই রাজনৈতিক দলটির ওপর পড়ে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক সংগঠনের ওপরের স্তরের নেতা-নেত্রী বা সমষ্টিগতভাবে সরকারের দুর্নীতি-অনিয়মে আম-জনতার কোনো ক্ষোভ না থাকলেও দলের মধ্য ও নিম্নস্তরের নেতা-কর্মীর আচার-আচরণে, ক্রিয়াকর্মে জনগণের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য শুভ হয় না। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। প্রথম দফায় পাঁচ বছর এবং দ্বিতীয় দফায় তিন বছরের শাসনামলে সরকারের অদক্ষতা, দুর্নীতি, অপচয় সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোনো ক্ষোভ বা হতাশা না থাকলেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ প্রান্তিক পর্যায়ে একশ্রেণির নেতা-কর্মীর সীমাহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল রাজনীতি জনগণের মধ্যে ভীতি, অসন্তোষ, ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সরকারদলীয় ছাত্র/যুব/শ্রমিক সংগঠনের নেতিবাচক কার্যক্রমের সমালোচনা করে জনগণ। সংসদীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে সরকার গঠন করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে ৩০০ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। এর সঙ্গে আছে দলীয় কাঠামো। তাদের কার্যক্রমের প্রতি জনগণের সতর্ক দৃষ্টি থাকে। তদুপরি বাংলাদেশের জনগণের শিক্ষার হার বাড়ছে, আর্থিক সংগতিও বাড়ছে। ১৬ কোটি লোকের ১২ কোটির হাতে মোবাইল ফোন। প্রায় ৪ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সোশ্যাল মিডিয়া খুবই সক্রিয়। গ্রাম বাংলায় ঘুরলে দেখা যায় ছেলেদের চেয়ে স্কুল-কলেজে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। বিদ্যুতের ব্যাপক প্রসারে এবং জনগণের আর্থিক সক্ষমতা অর্জিত হওয়ায় গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে টেলিভিশন। জনগণ শিক্ষিত হচ্ছে, সচেতন হচ্ছে। বাবা অশিক্ষিত মূর্খ হলেও ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পারিপার্শ্বিকতার আঁচ তাদের গায়ে লাগে। সমালোচনার দ্বার নীরবে হলেও উন্মুক্ত থাকে।

কেন আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এই অবক্ষয়? খুনের দায়ে এমপি কারাগারে! চোরাচালানের দায়ে এমপির সাজা হয়! তাও যদি স্বর্ণ-রৌপ্য বা কোনো ভোগ্য বা বিলাসী পণ্য কিংবা অন্য কোনো মূল্যবান বস্তু চোরাচালান হতো, যা দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় বা নিত্য ব্যবহারে লাগে, তবে না হয় কথা ছিল। কিন্তু ‘ইয়াবা’র মতো সমাজ ও জীবন ধ্বংসকারী কোনো মাদক চোরাচালানে যদি কোনো জনপ্রতিনিধির নাম জড়িয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখ এবং লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে সেই জনগণের গায়ে হাত তুলছেন! সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করছেন। এর চেয়ে ন্যক্কারজনক অরাজকতা আর কী থাকতে পারে। নির্বাচনের তিন মাস পরই কোনো জনপ্রতিনিধির নামের শেষে যদি ‘টেন পার্সেন্ট’ (১০%), ‘নগদে খান’ প্রভৃতি খেতাব যুক্ত হয়, তাহলে মূল রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের আস্থায় সংকট দেখা দিতেই পারে। একই সঙ্গে সংগঠনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। এখানেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতা, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরাজয়। তাই রাষ্ট্র পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। গুটিকয় নেতা-কর্মী বা জনপ্রতিনিধির অপকর্মের কারণে সরকারের বিশাল অর্জনকে কোনোমতেই হুমকির সম্মুখীন হতে দেওয়া যায় না। তাই সময় থাকতেই এদের ব্যাপারে কঠোর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আখেরে জনগণই রাজনৈতিক দলের ভরসা—সব শক্তি জনগণের কাছে এবং জনগণের হাতেই।

 

লেখক :  সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর