সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মর্যাদা

মুফতি মুহাম্মদ মুহিবুল্লাহিল বাকী

সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য যিনি মানুষকে সৃষ্টি করার পর তাদের স্বভাবজাত বিবেক দান করেছেন, যাতে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাস করতে গেলে অন্যের প্রতি কী দায়িত্ব রয়েছে তা বুঝতে পারেন। তাদের এ স্বভাবজাত বিবেককে শানিত করার জন্য অন্যের হক অনাদায়ের দায়ে এ বিবেক কলুষিত হওয়া থেকে মুক্ত রাখার শিক্ষা দেওয়ার জন্য যুগ যুগ ধরে পাঠিয়েছেন নবী, সালাত ও সালাম শেষ নবীর ওপর যিনি হলেন পরিপূর্ণ আদর্শ, যার আদর্শে রয়েছে প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা। আপনি যদি হোন শ্রমিক, নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার আদর্শ। আপনি যদি হোন মালিক তাহলে তিনি হলেন আপনার আদর্শ। মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিকের মর্যাদা দিয়ে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে মজবুত করতে হবে। শ্রমিকের মর্যাদা দান করার মাধ্যমে শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা ছাড়া কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। প্রথমে আমাদের শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে জানতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা যখন জুমার মতো গুরুত্বপূর্ণ নামাজ আদায় করেছ এখন তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করার জন্য বের হয়ে যাও। অর্থাৎ শ্রম দেওয়ার জন্য বের হয়ে পড়। এরকমভাবে আল্লাহতায়ালা বলেন, প্রত্যেকের জন্য তাদের কাজ অনুসারে মর্যাদার স্তর রয়েছে। কাজের প্রতিফল তাদের দিয়ে দেওয়া হবে। তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।

রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো উত্তম উপার্জন কী? রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন নিজের শ্রমের উপার্জন উত্তম উপার্জন। রসুলে পাক আরও বলেন, এমন কিছু গুনাহ আছে যা নামাজ পড়লেও মাফ হয় না, রোজা রাখলেও মাফ হয় না। শুধু রিজিক তালাশ করার জন্য ঘাম ঝরালেই মাফ হয়। এটা হলো শ্রমের মর্যাদা। কর্মহীনতাকে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, কর্মহীনতা মানুষকে পাষাণ করে দেয়। যারা শ্রম দেয় তারা হলেন শ্রমিক, তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মজদুরের ঘাম শুকানোর আগেই তাকে তার মজুরি দিয়ে দাও। এরকমভাবে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজুরি সঠিকভাবে আদায় না করা কত বড় অপরাধ তা উল্লেখ করতে গিয়ে বললেন, মজদুরকে তার মজুরির ব্যাপারে জুলুম করা অন্যতম কবিরা গুনাহ। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, যে আল্লাহতায়ালা বলেন, কাল কেয়ামতের ময়দানে আমি তিন ধরনের ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব— (১) যে ব্যক্তি আমার নামে কথা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করল (২) যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করল (৩) যে ব্যক্তি কোনো মজদুরকে শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল কিন্তু তাকে তার মজুরি দিল না। এটা হলো শ্রমিকের অধিকার আদায় সম্পর্কিত হাদিস। তবে কোনো শ্রমিক যদি মালিকের কাজ করতে গিয়ে একটু মালিকের কোনো কিছু নষ্ট করে ফেলে তখন মালিক কী করবেন এ ব্যাপারে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চাকর বাকর তোমাদের কাজ করতে গিয়ে কোনো পাত্র ভেঙে ফেললে তার জন্য তাকে শাস্তি দেবে না, কারণ অন্য মানুষের ন্যায় তাদেরও তো হঠাৎ অনিচ্ছায় কোনো কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে আমরা ১ মে এলেই শ্রমিক দিবস পালন করে থাকি। এ মে দিবস পালন অনেকটা আনুষ্ঠাকিতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তা না হলে শ্রমিকের অবমূল্যায়নে আমরা যে কত বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা বুঝতাম। মালিক যদি শ্রমিকের প্রাপ্য আদায় না করে এতে উভয়পক্ষের সম্পর্কে ফাটল ধরে। ফলত মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে শ্রমিকরা মনে মনে খুশি হয়। আবার এ ক্ষতির কারণে মালিকরা যা দিত তাও দিতে গড়িমসি করে। অর্থাৎ মালিকপক্ষের অনৈতিকতার কারণে উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রমিক যখন কাজ করে তখন মনে করতে হবে আমাদের এ শ্রমের বিনিময়ে শুধু আমি পারিশ্রমিক পাচ্ছি তা নয়, বরং হাজার হাজার মানুষ আমাদের উৎপাদিত দ্রব্য দ্বারা উপকৃত হচ্ছে, এর ছওয়াবও আমরা পাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে মালিককে মনে রাখতে হবে আল্লাহতায়ালা আমার ওপর বড় অনুগ্রহ করেছেন— আমার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বহু মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন। এটা আমার কোনো যোগ্যতা নয়, বরং যোগ্যতা হলে এত বড় বড় ডিগ্রিধারী সম্মানী ব্যক্তিরা আমার অধীনে চাকরি করত না। যতদিন পর্যন্ত শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের মানসিকতা, মানবিক মূল্যবোধ উন্নত হবে না ততদিন শ্রমিকের অধিকারও আদায় হবে না। এ রকমভাবে যতদিন শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গভীর হবে না ততদিন দেশও উন্নত হবে না। সেই জন্য রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার আগ মুহূর্তে দুটি অসিয়ত করে গেছেন, একটি হলো- নামাজ, অন্যটি হলো- অধীনস্থদের হকের ব্যাপারে। আল্লাহতায়ালা আমাদের একে অপরের অধিকার আদায় করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ।

সর্বশেষ খবর