শিরোনাম
শনিবার, ৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফুলের রাজ্য ফ্লোরা হল্যান্ড

শাইখ সিরাজ

ফুলের রাজ্য ফ্লোরা হল্যান্ড

সাম্প্রতিক সময়ে হাওরে আগাম বন্যায় সৃষ্ট দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে গত সপ্তাহে হাওরের বিকল্প ধানের জাত আছে কিনা তা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। নেদারল্যান্ডসের কৃষি নিয়ে যে সিরিজ লিখছিলাম তার দ্বিতীয় পর্ব আজ আবার প্রকাশ শুরু হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারড্যাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আলসমিয়ের। সারা পৃথিবীতে যারা বড় পরিসরে ফুল চাষ করেন তাদের কাছে পরিচিত এক ক্ষেত্র। ফুলবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষের কাছে এক স্বপ্নক্ষেত্র। আজ ফুলের সৌরভের সঙ্গে মেলাব আপনাদের। নিয়ে যাব ফুলের এক অন্যরকম রাজ্যে। ফ্লোরা হল্যান্ড। ফুলের অন্যতম বৃহৎ অকশন সেন্টার। সারা বিশ্বে যে জায়গা থেকে ফুল রপ্তানি হয়। সামনাসামনি এ রকম একটি অকশন দেখা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আমার মনে পড়ে চীনের কুনমিংয়ের কথা। সেও তো ২০০৭ সালের কথা। কী সুবিশাল ছিল অকশন মার্কেট। সেবারে রাতে অকশনে গিয়েছিলাম। ওদের অকশনটা হয় রাতেই। আর এখানে সকালেই শুরু। একদম সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত চলবে। ফ্লোরা হল্যান্ডের অভ্যর্থনায় পৌঁছে দেখলাম ফুলের ছবিসংবলিত কার্ড, রঙিন পুতুল। আমাদের ডাচ সঙ্গী বরাবরের মতো হেলেন রুহি এবং হানেকে ভান হুফ। আর ফ্লোরা হল্যান্ডের পক্ষ থেকে গাইড হিসেবে এলেন নাতাশা। বিশেষ জুতা পরতে হলো আমাদের সবাইকে। লোহার পাত বসানো জুতার মাথায়। মনে পড়ে গেল, যখন নেদারল্যান্ডসে আসার প্রাথমিক কাজ চলছিল তখন ওদের ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে আমাদের টিমের সবার পায়ের মাপ জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম অন্য কথা। এখানে এসে বুঝলাম কারণটি। লোহার পাত বসানো জুতার মাথায় যাতে অকশন ফ্লোরে, ফুল বহনকারী ছোট ছোট কার্টগুলো দুর্ঘটনাবশত পায়ের ওপর দিয়ে গেলেও আঘাত না লাগে। ছোট অভ্যর্থনা পেরিয়ে ভিতরে গেলেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। দোতলা থেকে নিচে তাকালে মনে হতে পারে অবাস্তব বা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি আমরা। শত শত ফুলের ট্রলি নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে ফ্লোরে। দৃশ্যটি উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল ভিডিও গেমসের একটি পর্দা, যেখানে অসংখ্য গাড়ি ছুটছে।

এক কিলোমিটার লম্বা সেফটি ব্রিজ ধরে আমরা এগিয়ে চলছি মূল অকশন রুমের দিকে। নিচে সারি সারি কার্টে ফুল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নেওয়া হচ্ছে। অসাধারণ কর্মযজ্ঞ। অবশেষে পৌঁছলাম অকশন রুমে। যেখানে সবাই ডিজিটালি কানেকটেড পুরো বিশ্বের সঙ্গে। একটি ক্লকের মাধ্যমে অকশন চলছে। তবে নাতাশা বলছে এখানে যে ৩০০ জন বিডার আছে তাদের সবাইকে অন্তত বছরখানেক সময় ব্যয় করে শিখতে হয়েছে এই নিঁখুত হিসাব-নিকাশ। এ ছাড়া ফ্লোরা হল্যান্ডে আছে স্মল অকশন রুম। একই সঙ্গে বাসা থেকে বসেও বিড করতে পারে এমন বিডার যারা সবাই স্মার্টকার্ড হোল্ডার। প্রিয় পাঠক! পুরো বিশ্বে ফ্লোরা হল্যান্ড হলো প্লান্ট এবং ফুলের অন্যতম বৃহৎ ট্রেডিং সেন্টার।

কুনমিং ছাড়াও মনে পড়ছে জাপানের কথা। ২০০৪ সাল। জাপানের রাজধানী টোকিওতে পৃথিবীর বৃহৎ গাড়ির অকশন দেখেছি। যেখানে অকশন হলে শত শত বিডার কম্পিউটারে অংশ নিচ্ছেন নিলামে। এত বছর পর ফুলবাণিজ্যের এক সুবিশাল অকশনের সঙ্গে দেখা হলো আমার, বিষয়টা বেশ রোমাঞ্চকর। চীনের কুনমিংয়ের ফুল অকশন কেন্দ্রও আয়তনে বেশ বড়, কিন্তু ফ্লোরা হল্যান্ডের তুলনায় তা একেবারে ছোট। ফ্লোরা হল্যান্ডের অকশনটির ইতিহাস শত বছরের পুরনো। ফুল উৎপাদকরা সবাই সমবায়ের আওতাধীন এবং তাদের অর্থেই চলে এই আন্তর্জাতিক অকশন। ৯৯ শতাংশ ফুল চাষি হল্যান্ডের। নাতাশা বলছিল, প্রতিদিন ২ কোটি ১০ লাখ ফুল বিকিকিনি হয় এখানে। আর বছর শেষে ফুলবাণিজ্যের অঙ্কটি বেশ বড়। ৪০০ কোটি ৩০ লাখ ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি। কম্পিউটার স্ক্রিনে, ল্যাপটপে, মোবাইলে মানুষ ফুল দেখে সরাসরি। আর তখনই নিলাম করে এবং প্রযুক্তি ঠিক করে দেয় কত দামে কে কিনতে পারছে ফুল। কীভাবে এবং কবেই বা শিপিং হবে ফুল; সব তথ্য ও গবেষণাই আছে এখানে।

প্রিয় পাঠক! বাংলাদেশের দিকে একটু দৃষ্টি দিই। বাংলাদেশের ফুলবাণিজ্যে কার্ট ফ্লাওয়ারের যে চল আমরা এখন দেখি বাজারে তা আমাদের কৃষকদের অবদান। নিজস্ব মেধা, মনন আর বুদ্ধি খাটিয়ে তারা এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।  তবে এর পেছনে একজন মানুষের অবদান ছিল। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে বেলজিয়ান উন্নয়নকর্মী জন পল পেরিনের কথা। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কার্ট ফ্লাওয়ার যেমন ক্রিসেনথিমাম, জারবেরা, কার্নিশান, টিউলিপ এ ফুলগুলো যার হাত ধরে চাষ এবং পরে সম্প্রসারিত হয় তার প্রধান কারিগর পেরিন। আনন্দ-বিনোদনে, নানা উৎসব আয়োজনে ফুল দেওয়ার রেওয়াজ আছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিশেষ দিন, উৎসবকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যটা একেবারে কম নয়। বেশির ভাগ ফুল চলে আসে ঢাকায়। বছর চারেক আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে ফুলের স্বর্গরাজ্য যশোরের গদখালীতে। গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরছি বাংলাদেশের ফুল উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রেক্ষাপট। বার বার যে কথা বলেছি গ্রিন হাউস, স্টোরেজ এবং উন্নত প্রযুক্তি— এসবের কোনো কিছুই যেন হয়ে উঠছে না। কত দূর যে এগিয়ে যেতে পারতাম আমরাও, তা হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। তাই মনে করি, নেদারল্যান্ডসের ফুলবাণিজ্য এত বড় হওয়ার পেছনে শুধু চাষিরাই নন, প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের একটা বিশাল অবদান রয়েছে। নইলে ফুল নিয়ে এত বড় বাণিজ্যবিপ্লব ঘটত না সেখানে। ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের ফুল চাষি গদখালীর শের আলী সেই নেদারল্যান্ডস ঘুরতে গিয়েছিলেন বহু আগে। তিনি সেখান থেকে ফিরে শুধু সহজাত জ্ঞান আর যা দেখেছেন তাই দিয়ে বানিয়ে ফেললেন স্থানীয় প্রযুক্তির গ্রিন হাউস। যদিও বলা উচিত হবে না, তা বিশ্বমানের এবং শতভাগ সঠিক পদ্ধতিতে নির্মিত। গোটা গ্রামে এখন শের আলীর প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কাজ চালানোর জন্য শের আলীর ওই গ্রিন হাউস অনেক দামি। এখন শুধু প্রয়োজন সহযোগিতা। সরকারের পক্ষ থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ কৃষি বাণিজ্যিক খাতের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। তাহলে ফুল আমদানি করার বদলে আমরা রপ্তানির একটা বড় জায়গা দখল করে নিতে পারব বলে বিশ্বাস। এবং আন্তর্জাতিক মানে ফুলের বাণিজ্যকে প্রসারিত করার সুযোগও সৃষ্টি হবে।

ফ্লোরা হল্যান্ডে ফিরে আসা যাক। চারদিকে এক বর্গকিলোমিটার জায়গা। ৩০টি অকশনের এন্ট্রি পয়েন্টে ফুলভর্তি কনটেইনার লরি দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল ব্যবস্থাটি আসার আগে অতীতে একটা পুল টেবিলে ফুল রাখা হতো আর বিডাররা হাতে তুলে নিত ফুল। এরপর শুরু হতো বিকিকিনি। উপর থেকে আমরা নেমে এলাম ফ্লোরে। এখানে এসেই বোঝা গেল মজবুত জুতা পরার কারণটি কী। ফুল নিয়ে চলমান স্বয়ংক্রিয় এ ট্রলিগুলোর ফাঁকে খুব সাবধানে পার হতে হয় পথ। কার্টগুলো এত দ্রুত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে যে কোনো সময় পায়ে আঘাতের শঙ্কা নয় শুধু, রীতিমতো জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়। সারি সারি কার্ট বা চলমান ট্রলিতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে ফুল। যেখান দিয়ে ফুলগুলো নিয়ে যাচ্ছে সে জায়গাটি তারা বলছে হাইওয়ে। বেশ বিপজ্জনক জায়গা। সতর্কতার ঘাটতি হলেই বিপদ নিশ্চিত। হাজার হাজার কার্ট চলে ভিতরে। ফ্লোরে কাজ করছেন ১৩ হাজার শ্রমিক। এখানে কুলিং এরিয়াটি বিশাল। ৪৫ হাজার স্কয়ার মিটার। ফ্লোর টিম ম্যানেজার ইয়োর্গেন স্লোবের সঙ্গে পরিচয় হলো। সে ১৯ বছর ধরে কাজ করছে ফ্লোরা হল্যান্ডে। বলল, আগে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে কাজ করত। সেখানেও দায়িত্ব ছিল ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলে। সে অভিজ্ঞতাই তাকে এখানে চাকরি মিলিয়েছে। ইয়োর্গেনের অধীনে ৪৬০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ৩০০ কন্ট্রাক্টে আর বাকি ১৬০ জন এজেন্সি থেকে হায়ার করা।

পাঠক! মজার বিষয়, এখানে ফুলের ভাস-লাইফ বা খেত থেকে সংগ্রহের পর তা সতেজ থাকার সময় পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় কতদিন ফুল টিকতে পারে। কিউ আর কোডও রয়েছে যেখানে একটি ফুলের জীবন-ইতিহাসের সব তথ্য আছে। কেউ যদি বলে কোনো ফুল তার চার দিন পর দরকার, তখন দেখা হয় সেই ফুল আদৌ চার দিন টিকবে কিনা। সে অনুযায়ী অর্ডার রাখা হয়। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয় ফুল। সব মিলিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। আজ যদি উগান্ডা থেকে অর্ডার আসে তা ঘণ্টা চারেকের মধ্যে নিশ্চিত পৌঁছাবে। এ রকম একেকটি দেশের জন্য একেক সময় ঠিক করা আছে।

প্রিয় পাঠক! নেদারল্যান্ডসের ফুলবাণিজ্যের ইতিহাস অনেক পুরনো। আলসমিয়ের এলাকায় অবস্থিত ফুলের এই নিলাম কেন্দ্র বা অকশন হাউসও ছাড়িয়ে গেছে ১০০ বছরের ইতিহাস। কিন্তু দিনের পর দিন এখানে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেই চলেছে। সবচেয়ে আশান্বিত হওয়ার মতো বিষয় বাংলাদেশের চাষিদের কাছে ফ্লোরা হল্যান্ডের বিশাল এই কর্মযজ্ঞ হতে পারে। ইতিমধ্যে শের আলী এবং আরও দু-এক জন কৃষক ঘুরেও গেছেন বিরাট এই ক্ষেত্র। দেশে ফিরে হল্যান্ডকে অনুসরণ করছেন ফুল চাষ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে। তবে সেটা সহজাত বুদ্ধি দিয়ে। পরিপূর্ণ কোনো অবকাঠামো সুবিধা এখনো পাননি তারা। এর পরও লাভ করছেন। বহু উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। একবার ভাবুন তো, যদি সঠিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ তারা পান, তাহলে অবস্থাটি কী দাঁড়াবে? উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তাই চাই সঠিক পরিকল্পনা আর প্রযুক্তির সমন্বয়।

এভাবেই দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে গেছে ফুল চাষের বার্তা। সৌন্দর্য, সৌরভ আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চাষি ও ব্যবসায়ীদের এক দারুণ বাণিজ্যিক শিক্ষা কেন্দ্র এই ফ্লোরা হল্যান্ড। ২০২০ সালের মধ্যে আরও ১০০ কোটি ইউরো বেশি বাণিজ্য করার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে তারা ভোক্তা পর্যায়ে তিন ভাগে নামিয়ে আনতে চায় ফুলের দাম। সেই সঙ্গে সব কৃষি উন্নত দেশগুলোয় পৌঁছে দিতে চায় ফুল চাষ ও বাণিজ্যের সম্ভাবনা। আমাদের বাংলাদেশও এদিকে দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছে। ফুল চাষ ও বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বহু মানুষ। বিশ্বাস করি, ফ্লোরা হল্যান্ড তাদের স্বপ্নকে আরও বড় করে দেবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর