মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভৃত্য-মনিব সম্পর্ক : রানী ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রনাথ ও রুশো

সাইফুর রহমান

ভৃত্য-মনিব সম্পর্ক : রানী ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রনাথ ও রুশো

মাঝে মাঝে নাগরিক জীবন থেকে পালিয়ে দূরে কোথাও যাই। বন, জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র অথবা নির্জন কোনো স্থানে। নিজেকে নিজের মতো করে না পেলে মাথাটা কিছুতেই যেন খোলে না। মাঝে মাঝে সতীর্থ লেখক কিংবা বন্ধুদের সঙ্গেও যাই কোথাও কোথাও। কিছু দিন আগে কবিবন্ধু জুন্নুরাইনকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম মাওয়ায়, পদ্মার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে। জুন্নু কবিতা লেখেন দুর্দান্ত, আবৃত্তিও করেন মোটামুটি। সেদিন বসে আছি পদ্মার পাড়ে। তিনি কবিতা আবৃত্তি না করে হঠাৎ একটি গান ধরলেন— নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি নারে মন/তুই সুখীজনের করিস পূজা দুঃখীর অযতন। আমি বললাম বাঃ বেশ তো গানটি। জুন্নুরাইন বললেন, বেশ হবে না, এটি তো অতুল প্রসাদের গান। আমিও জ্ঞান ঝাড়ার সুযোগটি হাতছাড়া করলাম না। বললাম, জানেন তো, অতুল প্রসাদ ছিলেন ব্যারিস্টার। প্রাকটিস করতেন এলাহাবাদ হাই কোর্টে। কিন্তু আইন প্রাকটিসের চেয়ে সংগীতচর্চাই করতেন বেশি। গানের লাইন দুটি মাথা থেকে কিন্তু কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তখনই হঠাৎ মনে হলো ভৃত্য-মনিব সম্পর্ক নিয়ে তো কিছু লেখা যায়। বর্তমানে আমাদের নাগরিক জীবনে একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ভৃত্য। তাদের আমরা হরেক নামেই ডাকি— পিয়ন, আরদালি, বেয়ারা, চাকর, নফর, আয়া, বুয়া, পাচক, মালী, গৃহপরিচারিকা ইত্যাদি। এসব নামের ছদ্মাবরণে তারা সকাল, দুপুর, রাত আমাদের ফাই-ফরমাশ খাটে, আমাদের জীবনকে সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট করে তোলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মধ্যরাত পর্যন্ত শ্রম-ঘাম ঝরিয়ে ঘরকন্নার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করার পরও তারা কখনো কখনো অপাঙেক্তয়, অবাঞ্ছিত কিংবা কখনো মনিবের রোষানলে পতিত ও ক্রোধের আগুনে বিদ্ধ।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে এ রকম— শয়নকক্ষের ভৃত্যই নাকি একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ জীবনীকার। এই কথাটির যথার্থতা বোধকরি একমাত্র রবীন্দ্রনাথই উপলব্ধি করেছিলেন। আর এজন্যই তিনি বলেছিলেন, ‘কবিকে খুঁজো না কবির জীবন চরিতে।’ সে যা হোক, কথা হলো যে মানুষটি হতে পারে মনিবের শ্রেষ্ঠ জীবনীকার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের প্রধান নিয়ামক সেই মানুষটি প্রতিনিয়ত কেন তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য, ঘৃণা ও আক্রোশের শিকার। প্রায়ই পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায় গৃহবধূ কর্তৃক গৃহপরিচারিকা নির্যাতন। গৃহস্বামী দ্বারা ভৃত্যকে অমানুষিক প্রহার ও নিষ্পেষণ। কখনো কখনো তাদের নির্যাতন বর্বর যুগকেও যেন হার মানায়। কেউ কেউ লোহার শিক আগুনে তাতিয়ে গৃহকর্মীর শরীরে নকশা কাটে। মেতে ওঠে বর্বরোচিত সব শিল্পকর্মে। কেউ আবার মাথার সব চুল উপড়ে নেয় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কর্তনসহ এ ধরনের আরও বিচিত্র রোমহর্ষক ঘটনা সৃষ্টিতে মেতে ওঠে। এখন প্রশ্ন হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভৃত্যের প্রতি মনিব কেন অসহিষ্ণু, অতৃপ্ত ও বীতশ্রদ্ধ। ঘটনা একটি কিন্তু এর উত্তর বহুমুখী। প্রথমেই আসে সুশিক্ষার অভাব। একটি মানুষের মধ্যে সুশিক্ষা না থাকলে সহসা সে ভালোমন্দের বিচারে অক্ষম হয়। পারিবারিক ঐতিহ্যের অভাবেও একটি মানুষ আরেকটি মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নে কুণ্ঠাবোধ করে না। উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালি সমাজে শুধু জমিদার ও বনেদি শ্রেণির লোকজনই সাধারণত ভৃত্য ও গৃহপরিচারক রাখতে পারত। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীতে এসে বাঙালি সমাজের বড় একটি অংশ মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। ফলে এই মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই বাড়ির চাকর-বাকরদের সাধারণত মানুষ বলে মনে করে না। তারা তাদের বিবেচনা করে পণ্য হিসেবে। ঠিক প্রায় একই রকম দৃশ্য দেখা যায় আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬১-১৮৬৫)। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মানুষ বলে মনে করত না। মনে করত তারা পণ্য। আর এজন্যই তো বেধে গিয়েছিল গৃহযুদ্ধ। অথচ ঠিক সমসাময়িককালে ইউরোপে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে দেখা যায় তখনকার সমাজব্যবস্থায় মনিবরা ভৃত্যদের প্রতি ছিলেন অনেকটাই উদার ও সহানুভূতিশীল। এর কারণ সম্ভবত প্রখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ ও তার সতীর্থ সাহিত্যিকদের আন্দোলনের মুখে ১৮২৩ সালে ‘মনিব-ভৃত্য আইনটি’ আলোর মুখ দেখেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি তখনকার বড় বড় অভিজাত ও ধনী ব্যক্তিরা ভৃত্যের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে খানিকটা সভ্য হয়ে উঠতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া (১৮১২-১৯০১) ভৃত্যদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রেমে। ভিক্টোরিয়া প্রেমে মজেছিলেন দুজন ভৃত্যের সঙ্গে, প্রথম জনের নাম জন ব্রাউন, ইনি ছিলেন আবার স্কটিশ। ভিক্টোরিয়ার কন্যা আড়ালে জন ব্রাউনকে দেখলেই টিপ্পনি কেটে বলতেন, ‘ওই দেখো আমার মায়ের প্রেমিক’। আর দ্বিতীয় জনের নাম ছিল আবদুল করিম। আবদুল করিম ছিলেন ভারতের আগ্রার বাসিন্দা। ১৮৮৭ সালে ভৃত্য হিসেবে আবদুল করিমকে উপহার দেওয়া হয় রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে। ১৮৬১ সালে ভিক্টোরিয়ার প্রিয় স্বামী প্রিন্স আলবার্ট মারা যাওয়ার পর রানী অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বে দিন কাটাচ্ছিলেন। আর ঠিক তখনই রানী তার ব্যক্তিগত ভৃত্য হিসেবে পেলেন আবদুল করিমকে। আবদুল করিমকে রানী এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছেন : ‘যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি আবদুল করিমের প্রতি ভীষণ রকম অনুরক্ত হয়ে পড়ছি। কারণ ও এতটাই ভালো ও ভদ্র যে, সত্যি সত্যি যদি কেউ আমাকে প্রশান্তি দিতে পারে তবে সেটা আবদুল করিম।’ উইন্ডসর প্রাসাদে আবদুল করিমের শয়নকক্ষ ছিল রানীর খাস শয়নকক্ষের সঙ্গে লাগোয়া। তারা প্রায়ই দুজনে একসঙ্গে রাতযাপন করতেন। আবদুল করিমকে রানী ভৃত্য থেকে তার ব্যক্তিগত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। আবদুল করিম দেখতে দীর্ঘাঙ্গী। সুঠাম দেহ। লম্বা ললাট। যাকে বলে একেবারে সুপুরুষ সে রকম। রানী নিভৃতে সময় কাটাতেন আবদুল করিমের সঙ্গে। আরবি ও উর্দু ভাষাগুলো শিখতেন তার কাছে। আবদুল করিম কোমরে তলোয়ার ও মূল্যবান রত্নখচিত পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে আসতেন রানীর দরবারে। রানীও তাকে সঙ্গে করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেতেন রাজ আমাত্য হিসেবে। বিভিন্ন দেশের রাজা কিংবা রাজকুমারদের সঙ্গে বসে সভা করতেন। অংশ নিতেন রাজভোজসমূহে। রানী আবদুল করিমকে ভারত ও ইংল্যান্ডে বহু জমি দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি ফরাসি দার্শনিক জ্যাক রুশো (১৭১২-১৮৭৮)। রুশো ফরাসি ভাষায় লিখলেও তার জন্ম হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। রুশোর জন্ম মোটামুটি ধরনের সম্পন্ন পরিবারে হলেও কালক্রমে পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ফলে রুশোর যখন ২০ বছর বয়স তখন তাকে সুইজারল্যান্ডেরই আরেকটি শহর, ভিভিয়েতে এক ধনী মহিলার বাড়িতে নিতে হয় ভৃত্যের কাজ। এই ধনী মহিলার নাম মাদাম ডি ওয়ারেন্স। রুশো তখন ২০ বছরের টগবগে যুবক। দেখতেও অসাধারণ। অন্যদিকে ওয়ারেন্স ছিলেন রুশো থেকে ১৩ বছরের বড়। অর্থাৎ ওয়ারেন্সের বয়স তখন ৩৩। রুশো দেখতে সুন্দর, সুপুরুষ। পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ না জুটলেও ঘরে বসেই প্রচুর পড়াশোনা করতেন রুশো। পেছনে প্রধান উৎসাহ ছিলেন তার পিতা। রুশো একদিকে যেমন দেখতে ছিলেন সুন্দর অন্যদিকে প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও জ্ঞানী। ফলে গৃহকর্ত্রী মাদাম ডি ওয়ারেন্স স্বল্পসময়ের মধ্যেই রুশোকে ভালোবেসে ফেললেন। তাদের মধ্যকার এই প্রেম দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। বলতে গেলে রুশোর লেখক ও দার্শনিক হয়ে ওঠার পেছনে মাদাম ওয়ারেন্সের হাত ছিল বেশ খানিকটা। কারণ ওয়ারেন্সের ঘরে ছিল বিশাল একটি বইয়ের সংগ্রহশালা। যার যথাযোগ্য ও সদ্ব্যবহার করেছিলেন রুশো।

বাড়ির চাকর-বাকর ও গৃহপরিচারিকাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের আরও কয়েকটি কারণ বোধ করি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরাদি কিংবা আমি নিজেও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, গৃহকর্মী নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি ঘটে ক্ষমতার কাছাকাছি যেসব মানুষের অবস্থান তাদের ঘরে। হতে পারে তিনি আমলা, নিরাপত্তাকর্মী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা পেশাজীবী। অন্যদিকে আর্থিকভাবে সমাজে যারা বেশ শক্তিশালী তাদের ঘরেও সেই একই দৃশ্য। সমাজে নীচু শ্রেণির মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। তবে আমার এক বন্ধু আছেন নাম ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান, যিনি আইন পেশায় ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা নামও করে ফেলেছেন। তিনি তার সব ভৃত্য, পিয়ন, ক্লার্ককে আপনি করে সম্বোধন করেন। এমনটা বর্তমান সময়ে সত্যি দেখা যায় না। হাসান দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। বাবা ছিলেন ডাকসাইটে সচিব। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তার পরও অফিস-আদালতের ভৃত্যদের আপনি করে বলাটা সত্যি বিরল। ও হ্যাঁ, আরেকজনের কথা মনে পড়েছে। আমার বন্ধু ব্যারিস্টার মীর হেলালের স্ত্রী, আমাদের নওশীন ভাবীও বাড়িতে চাকর-বাকরদের আপনি করে বলেন। আমার বন্ধুর বাড়িতে গেলে বোঝা যায় না তারা আদৌ গৃহকর্মী নাকি গ্রাম থেকে আসা কোনো মেহমান। ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পে ভৃত্যদের সম্পর্কে লিখেছেন : ‘ওরা গৃহে ছোট হয়ে ঢুকে বটে কিন্তু কালপরিক্রমায় কে যে মনিব আর কে যে ভৃত্য সে সীমারেখা অচিরেই লুপ্ত হয়।’ আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। থার্গুড মার্শাল নামে একজন ব্যক্তি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে কাজ করেছিলেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে কথা, থাকতেন রাজধানী ওয়াশিংটনে। বাগানসমেত বিশাল সরকারি বাড়ি। মাঝে মাঝে তার ভৃত্যদের বিদায় দিয়ে তাদের কাজগুলো তিনি নিজ হাতেই করতেন। তো হয়েছে কি, একদিন বাগানের ঘাসগুলো বড় হয়ে যাওয়ায় তিনি নিজেই সেগুলো কেটে সাফ করছিলেন। বাড়ির সামনেই সদর রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে জনৈক শ্বেতাঙ্গ মহিলা মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। মার্শালকে ঘাস কাটতে দেখে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে মহাশয়! একটু শোনেন তো। মার্শাল ঘাস কাটা থামিয়ে মহিলাটির দিকে তাকালেন। মহিলা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সমস্ত বাগানের ঘাস কাটতে তুমি কত টাকা পারিশ্রমিক নাও। মার্শাল কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। একটু আমতা আমতা করছিলেন। শ্বেতাঙ্গ মহিলাটি এবার বললেন, তা আমি জানতে চাইছি যে, তোমার গৃহকর্ত্রী মালিক এই ঘাসগুলো কাটার জন্য কত টাকা দেন। মার্শাল এবার হেসে বললেন আমাকে উনি টাকা-পয়সা কিছু দেন না। তবে রাতের বেলায় দয়া করে উনি আমাকে ওনার সঙ্গে ঘুমাতে দেন। মার্শালের মুখে এসব শুনে শ্বেতাঙ্গ সেই মহিলাটি তো পালিয়ে বাঁচেন। গৃহপরিচারিকাদের নির্যাতনের আরেকটি বড় কারণ ব্যক্তিবিশেষে অস্থিতিশীল মানসিক অবস্থা, এটিকে অবশ্য এক ধরনের মনোবৈকল্যও বলা যায়। পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্যাতন কিংবা গৃহকর্মীর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রমাণ করে যে, নিপীড়নকারী কতটা মানসিকভাবে অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত। তাদের মন-মানস এতটাই পচিত ও ক্লেদযুক্ত যে ভাগ্যিস তাদের ভিতরটা হাড়, চামড়া ও রক্ত-মাংস দিয়ে আবৃত। তা না হলে মনে হয় দুর্গন্ধের চোটে তাদের পাশে ঘেঁষাটাই অসম্ভব হয়ে উঠত। বাড়ির কাজের লোকের ওপর যৌন নিপীড়ন করে একজন মানুষ যে কী ধরনের সুখ পায় সে প্রশ্ন শুধু আমি কেন যে কোনো সুস্থ মানুষ মাত্রেরই ভাবার কথা। এসব ভাবলে তাদের নিজেদেরই অনুতপ্ত ও অনুশোচনার আগুনে আপ্লুত হওয়ার কথা। তবে একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। উন্নত ও সভ্য দেশগুলোয় যে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না তা কিন্তু নয়। উন্নত বিশ্বের অনেক বড় বড় বিখ্যাত লোকেরই হয়তো কখনো কখনো বাড়ির গৃহপরিচারিকার সঙ্গে একপ্রকার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে সেখানে থাকে প্রচ্ছন্নভাবে প্রেম-ভালোবাসার ছোঁয়া এবং কখনো কখনো তারা সেই সম্পর্ককে স্বীকৃতিও দিতে দ্বিধা করেন না। সে রকমই একজন মানুষ ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোর বাবা এনজেল কাস্ত্রো। এনজেল কাস্ত্রো বিয়ে করেছিলেন মারিয়া লুইসা নামের এক তরুণীকে। কিন্তু পাশাপাশি একটি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বাড়ির এক গৃহকর্মীর সঙ্গে। নাম লিনা রুজ গনজালেস। অচিরেই লিনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন এবং পরে জন্ম হয় ফিদেল কাস্ত্রোর। ফিদেল কাস্ত্রো যখন ১৫ বছরের তরুণ ঠিক তখন এনজেল কাস্ত্রো ফিদেল কাস্ত্রোর মা অর্থাৎ লিনাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। আমেরিকার ৩২তম রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টও সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা লুসি মার্শা নামে এক নারীর। অন্যদিকে ইতিহাসে কুখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত জোসেফ স্ট্যালিন তার জীবনের শেষ ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন ভ্যালেনটিনা ইনটোমিনা নামে তার ব্যক্তিগত গৃহপরিচারিকার সঙ্গে। মস্কো থেকে বেশ খানিকটা দূরে স্ট্যালিনের জন্য তৈরি প্রাসাদে শুধু ভ্যালেনটিনারই প্রবেশের অধিকার ছিল, অন্য কারও নয়।

তবে ভৃত্যের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ লেখক-সাহিত্যের মতো করে বোধহয় আর কেউ করতে পারেননি। শওকত ওসমান লিখেছেন ‘ক্রীতদাসের হাসি’। এ ধরনের উত্কৃষ্ট উপন্যাস বাংলা ভাষায় খুব বেশি লেখা হয়নি। বিখ্যাত গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র তো একবার গৃহকর্মীর কাছ থেকে ঝাড়ু-বালতি কেড়ে নিয়ে নিজেই নেমে পড়েছিলেন ধোয়া-মোছার কাজে। এটা দেখার জন্য যে ভৃত্যরা কতটা কষ্ট করে এসব কাজ করে। কৃষণ চন্দর লিখেছেন গল্প ‘কালু ঝাড়ুদার’। এ গল্পটি পড়লে চোখের পানি ধরে রাখা খুব কষ্ট। তলস্তয় লিখেছেন গল্প ‘মনিব ও ভৃত্য’। তবে রবীন্দ্রনাথের মতো করে ভৃত্যের দুঃখ-কষ্টের ছবি মনে হয় আর কেউ আঁকতে পারেননি। যা আমরা দেখি তার গল্প ‘পোস্টমাস্টার’, ‘খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন’ কিংবা তার সেই বিখ্যাত কবিতা ‘পুরাতন ভৃত্য’ প্রভৃতিতে। অথচ ছোটবেলায় ভৃত্যদের সঙ্গে কিন্তু তার সম্পর্ক খুব একটা সুখকর ছিল না। বর্তমানে আমরা যেখানে দেখি মনিব অত্যাচার করছেন ভৃত্যকে, অথচ শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে প্রচ্ছন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন ভৃত্যের হাতে। তিনি শৈশবের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন : ‘এখন এক-একবার ভাবি, ভৃত্যদের হাত হইতে কেন এমন নির্মম ব্যবহার আমরা পাইতাম। মোটের উপরে আকারপ্রকারে আমরা যে স্নেহ দয়ামায়ার অযোগ্য ছিলাম তাহা বলিতে পারি না। আসল কারণটা এই, ভৃত্যদের উপরে আমাদের সম্পূর্ণ ভার পড়িয়াছিল। সম্পূর্ণ ভার জিনিসটা বড়ো অসহ্য।’

রবীন্দ্রনাথের একজন ভৃত্যের নাম ছিল ব্রজ, তার সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল চাপা। আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, “আর দেব কি? কোন উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম “চাই নে”। তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না। দুধের বাটিটার উপরও তার অসামাল টান ছিল।’

লেখাটি শেষ করতে ভোর হয়ে এলো, অন্ধকার ভেদ করে কখন যে আলো ফুটে উঠছে বাইরে খেয়ালই করিনি। হঠাৎ কানে বাজল অতুল প্রসাদের সেই গান— নীচুর কাছে নীচু হতে...। আজ হঠাৎ কে বাজাচ্ছে এই গান। আমি চেয়ার ছেড়ে বাড়ির ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধ। এত ভোরে কারও গান শোনার কথা নয়। বুঝলাম আসলে আমার মাথার ভিতরেই ক্রমাগত বাজছে গানটি। সূর্যের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। একটি নতুন সকাল। আরেকটি নতুন দিনের শুরু। এখনই হয়তো আধুনিক যুগের দাস-দাসীরা সব ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজে। সেই সঙ্গে মনিবেরাও যথারীতি।...

     লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর