বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

শবেবরাতের সিঁড়ি বেয়ে আসে রমজান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

শবেবরাতের সিঁড়ি বেয়ে আসে রমজান

দুনিয়ার মোহে পড়ে বান্দা তার প্রভুকে ভুলে  যায়। প্রভু কিন্তু ভুলে না গুনাহগার বান্দাকে। দুনিয়ার রং রাঙানো বেকারার বান্দাকে ডাক দিয়ে আল্লাহপাক বলেন,  ‘ইয়া আইয়ুহাল ইনসানু মা গাররকা বিরাব্বিকাল কারিম। অর্থ, হে আমার পথহারা বান্দা! কিসে তোমাকে আমার মতো মমতাময় প্রভুর কথা ভুলিয়ে রাখল!’ ‘ফা আইনা তাজহাবুন। অর্থ, প্রেমময় প্রভুর দয়ামায়া উপেক্ষা করে কোথায় ছুটছ তোমরা হে মানুষ!’ এভাবে বান্দাকে ডাকার পরও অনেক বান্দাই ভুলে থাকে প্রভুর প্রেম মায়াকে। এসব আল্লাহ-ভোলা বান্দাদের জন্য ঘুরে ঘুরে আসে লাইলাতুল মেরাজ, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল ঈদাইন, মাহে রমজান, মাহে শাবানের মতো ভাবরাতগুলো। আসে জুমার মতো শ্রেষ্ঠ দিনগুলো। এসব দিনরাত আসে বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য। বান্দার মনে প্রেম জাগিয়ে আল্লাহপ্রেমিক বান্দা হিসেবে তৈরি করার জন্য। এমনই একটি ‘সুবর্ণ সুযোগ’ আমার আপনার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রজনী। উপমহাদেশে যা ভাগ্যরজনী নামে পরিচিত। হাদিসের কিতাবগুলোতে এ রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহপাক পৃথিবীর কাছাকাছি আকাশে নেমে আসেন। বান্দাদের দিকে দয়ার নজর দিয়ে তাকান। যারা তার সঙ্গে কোনো কিছুর শরিক করেনি এবং কোনো মানুষের প্রতি বিদ্বেষভাব রাখে না-তাদের আল্লাহপাক ক্ষমার চাদরে ঢেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ)। অন্য একটি হাদিসে হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘এক রাতে ঘুম ভাঙার পর দেখি নবীজী (সা.) বিছানায় নেই। আমি তাকে খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে চলে আসি। দেখি নবীজী (সা.)  মোনাজাতরত অবস্থায় আছেন। মোনাজাত শেষে তিনি আমাকে দেখে বলেন, আয়শা! তুমি কি জান আজ কোন রাত? আজ হলো মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর কাছাকাছি আকাশে অবস্থান করেন। তুমি শুনলে অবাক হবে আয়শা! বনি কালব গোত্রের যত বকরি আছে, ওই বকরিগুলোর গায়ে যত লাখ-কোটি পশম আছে এই পরিমাণ গুনাহগার বান্দাকে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন এই বরকতময় রাতের উসিলায়।’ (তিরমিজি)

এমনিভাবে এ রাতের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। সব হাদিসের মূল কথা একটাই, এ রাতে আল্লাহতায়ালা ক্ষমার ডালি নিয়ে বান্দার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে থাকেন রিজিকের ভাণ্ডার নিয়ে। সুস্থতার মতো মূল্যবান নেয়ামত নিয়ে ডাকতে থাকেন প্রেম ও মমতাভরে। আমাদের মধ্যে যাদের অভাব-অনটন লেগেই আছে, আছে অসুস্থতার মতো সুখ নষ্ট করা যন্ত্রণা— এ রাতটি আমাদের জন্য হতে পারে অলৌকিক কোনো শেফার রাত। হতে পারে অফুরন্ত রিজিকের ফায়সালা করিয়ে নেওয়ার রাত। সর্বোপরি, আমাদের ভুল-চুক নিয়ে আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেটে মাফ নেওয়ার রাতও এটি। এ রাতে কোটি কোটি ক্ষমাপ্রাপ্ত বান্দার তালিকায় যদি আমার নামটি না থাকে, তবে আমার চেয়ে বড় হতভাগ্য আর কে হবে ভাই? তাই এ ভাগ্যরজনী যেন আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে আসে সে জন্য আল্লাহর কদমে সেজদায় লুটিয়ে কান্নাকাটি করতে হবে। কোরআন তেলাওয়াতে ডুবে থাকতে হবে মৃত বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনকে স্মরণ করে। আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা হলে, তিনি আমাদের জন্য কল্যাণকর ফায়সালা করবেন। এ রাতে মসজিদ-মাদ্রাসা, এতিমখানা, কবর জেয়ারতসহ নানা ধর্মীয় কাজে আমরা অংশগ্রহণ করব। এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জীবনে ধর্মের যে ছোঁয়া আসবে তা যেন রমজান পর্যন্ত অটুট থাকে সে সাধনা করে যেতে হবে। আরেকটি বিষয় খুব লক্ষ্য রাখতে হবে, শবেবরাতসহ যে কোনো ইবাদত হলো আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গোপন প্রেমের মতো। এখানে লোক দেখানোর কোনো স্থান নেই। আপনার সমস্যার জন্য গোপনে প্রভুর কাছে কান্নাকাটি করবেন— এটাই ধর্মের নিয়ম। তাই যখনই প্রভুর দুয়ারে কড়া নাড়বেন, তখন যেন নীরব-নিস্তব্ধ এক পরিবেশ থাকে। সরব পরিবেশেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যায়, তবে একান্তে বসে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরালে যে আবেগ-অনুভূতি-খুলসিয়াত তৈরি হয়, অন্য সময় তা হয় না। 

হে আমার ভাই! শবেবরাতের পর মাত্র পনেরো দিন বাকি থাকে মাহে রমজানের। এ সময়টা একজন মুসলমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাহে রমজানের রুটিন-পরিকল্পনা শবেবরাত থেকেই করে ফেলতে হবে। আমাদের রুটিন এমনভাবে করতে হবে যেন মাসজুড়ে কোরআনের সান্নিধ্যে থাকতে পারি।  নিজের আত্মাকে কলুষমুক্ত করে তবে রমজানের সিঁড়িতে উঠতে হবে। তবেই রমজান আমাদের জন্য রহমত-মাগফিরাত ও নাজাতের উসিলা হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কলুষমুক্ত আত্মা নিয়ে রমজান মাসে পৌঁছার তৌফিক দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর