মাহে রমজানে ‘মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে’ কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে কোরআনে— ‘হে রসুল! আমি তোমার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা দুখান : ৫৮)। ‘আমি (সুস্পষ্ট কিতাব) অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কোরআনরূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সূরা জুখরুফ : ৩)। ‘আমি তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তুমি সতর্ক করতে পারো মক্কা ও এর চারপারে জনগণকে।’ (সূরা শুরা : ৭)। ‘আমি যদি আজমি ভাষায় (অর্থাৎ আরবি ছাড়া অন্য যে কোনো ভাষায়) কোরআন অবতীর্ণ করতাম তারা অবশ্যই বলত, এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, এর ভাষা আজমি অথচ রসুল আরবীয়।’ (সূরা হা মিম আস সাজদা : ৪৪)। ‘আরবি ভাষায় এই কোরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে।’ (সূরা জুমার : ২৮)। ‘আমি কোরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী, যাতে তারা ভয় করে অথবা তা হয় তাদের জন্য উপদেশ।’ (সূরা তোয়াহা : ১১৩)।
মাতৃভাষায় ভাবের আদান-প্রদান যতটা স্বাভাবিক ও সাবলীল অন্য ভাষায় ততটা নয়। একজন অক্ষরজ্ঞানহীনের পক্ষে ভাবের আদান-প্রদানে কোনো অসুবিধা হয় না নিজের মাতৃভাষায়। মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান। স্থানীয়ভাবে, নিজস্ব নিয়মে প্রাকৃতিক অবয়বে গঠিত ধ্বনি ও শব্দমালার মাধ্যমে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করে। এলাকাবিশেষে নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতা ও সংহতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নিজস্ব ভাষা অন্যতম অবলম্বন হিসেবে কাজ করে। অঞ্চল, গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য নির্দেশক হিসেবেও এবং নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশে বাহন হিসেবে ভাষা একটি অন্যতম নিয়ামক। জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভাষার অবিসংবাদিত ভূমিকার কারণে ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে অনেক দেশ, গোত্র ও গোষ্ঠীকে।
কোরআন মজিদের তাৎপর্য ও ভূমিকা প্রসঙ্গে আল কোরআনেই এই মহান কিতাবকে বিভিন্ন বিশেষ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন ‘আল কিতাব’ — মহাগ্রন্থ (২:২), ‘আল ফুরকান’ — ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্দেশকারী (২৫:১), ‘আজ জিকর’ — মানুষের প্রতি আল্লাহ-প্রদত্ত মহিমা স্মরণ করিয়ে দেওয়া (১৫:৯), ‘আল মুয়াইজাহ’ — বিশেষ উপদেশ (১০:৫৭), ‘আল হুকুম’ — বিচারের রায় (১৩:৩৭), ‘আল হিকমত’ — প্রজ্ঞা (১৭:৩৯), ‘আশ শিফা’ — আরোগ্যদানকারী (১০:৫৭), ‘আল হুদা’ — সঠিক পথপ্রদর্শক (৭২:১৩), ‘আত তানজিল’ — অবতীর্ণ ঐশীবাণী (২৬:১০২), ‘আর রহমত’ — দয়া (১৭:৩২), ‘আর রুহ’ — জীবনদানকারী আত্মা (৪২:৫২), ‘আল খায়ের’ — উত্তম স্তভাব (৩:১০৩), ‘আল বায়ান’ — উত্তম ব্যাখ্যাকারী (৩১:৩৭), ‘আন নিয়ামত’ — কল্যাণ (৯৩:১১), ‘আল বুরহান’ — স্বচ্ছযুক্তি (৪:১৭৫), ‘আল কাইউম’ — উত্তম ব্যবস্থাপক (১৮:২), ‘আল মুহাইমিন’ — উত্তম অভিভাবক (আগের কিতাবসমূহের) (৫:৪৮), ‘আন নূর’ — আলো (৭:১৫৭), ‘আল হক’ — সত্য (১৭:৮১), ‘হাবলুল্লাহ’ — খোদার নির্দেশনা (৩:১০২), ইত্যাদি।
মাহে রমজানের অশেষ কল্যাণ ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনে নিশ্চিত করতে আল কোরআনের মহান শিক্ষা ও নির্দেশনা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। আল কোরআন ও মাহে রমজান পারস্পরিক সূত্রে গাঁথা এবং মানবতার সার্বিক কল্যাণে এক অবিনশ্বর অবলম্বন। আধুনিক বিশ্বে মানবতার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, নৈতিকতা ও আদর্শিক মূল্যবোধের বিকাশ অতীব প্রয়োজন।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর।