শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঠাকুরগাঁওয়ে তরুণ উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী কৃষি প্রকল্প

শাইখ সিরাজ

ঠাকুরগাঁওয়ে তরুণ উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী কৃষি প্রকল্প

আমরা যারা শহর-নগরে থাকি, আমাদের সবার ভিতর একটা স্বপ্ন থাকে সবুজের ভিতর থাকার, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার। সেই স্বপ্ন থেকেই ইচ্ছে থাকে বসত আঙিনা বা ছাদে একটা বাগান করার। কিন্তু ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অনেক ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হয়তো পাওয়া হয়ে ওঠে না কৃষি সরঞ্জামাদি, নয়তো একটা ছাদের বহু মালিকানার প্রশ্নে কিংবা এরকম আরও অনেক সমস্যার কারণে বাগান করার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যায়। আবার অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে ঠিকই তার লালিত স্বপ্নকে ধরে ফেলে। শুধু তাই না, এক মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে আর একজন মানুষ। এমন এক মানুষের সন্ধান আমি পেয়েছি, যে শুধু নিজের স্বপ্ন না, অন্যের সবুজের স্বপ্নও বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তার নাম জাহিদ চাকলাদার। ঢাকার ছেলে জাহিদ ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল ও পীরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত দুটি গ্রামে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে। ধরা যাক আপনি একটা আম বাগানের মালিক হতে চান, জাহিদ আপনাকে সে আম বাগানের মালিক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করে দেবে। কীভাবে? সে গল্পই আজ শোনাব আপনাদের।

ধারণাটি একেবারে নতুন। সময়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে জাহিদ চাকলাদার। এই তরুণ মূলত প্রবাসে ছিল। সেখান থেকে দেশে ফিরে স্বপ্ন দেখছিল নিজেই কিছু করার। একবার উত্তরাঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে বিস্তীর্ণ ও পতিত জমি দেখে তার মাথায় খেলে যায় উদ্ভাবনী চিন্তা। ব্যবসা করতে হবে শুধু নিজে নয়, সবাইকে নিয়ে। ২০১২ সালের যে স্বপ্নের সূচনা, আজ পাঁচ বছরের ব্যবধানে সে স্বপ্ন পৌঁছেছে বহুদূর। আজকের দিনে অর্থচিন্তায় মগ্ন প্রতিটি মানুষ। সবাই চাইছে বিত্তশালী হয়ে অট্টালিকার পর অট্টালিকা গড়তে। বড় বড় ভবনের ভিতর দিয়েই সে অর্থবিত্তের নমুনা দেখাতে চায়। এটিই যেন তার চূড়ান্ত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সে তিন ফসলি কৃষি জমি থেকে শুরু করে শস্য শ্যামল সুজলা সুফলা যে কোনো ক্ষেত্রকেই উপেক্ষা করতে পারে। যেখানে সেখানে গড়ে তুলতে পারে বড় বড় ভবন। কখনো তা আরাম আয়েশের জন্য কখনো তা বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য। কিন্তু বাণিজ্যিক চিন্তার ভিতরে থেকেও যে সবুজের সঙ্গে থাকা যায়, কৃষি উদ্যোগের একটি সমাজ গড়া যায়, নাগরিক মানুষকে কৃষিতে টেনে আনা যায়, জাহিদ চাকলাদার সেই নমুনাই হাজির করেছেন আমাদের সামনে।

কয়েক বছরের মধ্যে তার প্রকল্প এলাকা পরিণত হয়েছে সমৃদ্ধ আমবাগানে। অন্যের স্বপ্ন লালিত হচ্ছে এখানে। এখানে যারা আমবাগান বা প্লট কিনেছেন তারা যেমন নিজের করে পাচ্ছেন এই বাগানটিকে, একইভাবে জাহিদ চাকলাদারও তার প্রতিটি গ্রাহক মিলিয়ে একটি বড় পরিবারের দায়িত্ব পালন করছেন।

জাহিদ চাকলাদার শুরুর গল্প জানাতে গিয়ে বলেন, শহরের মানুষের বিনিয়োগটাও শহরকেন্দ্রিক। কেউ ফ্ল্যাট কিনে, প্লট কিনে, কলকারখানা বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। কিন্তু কেউ কৃষিতে বিনিয়োগ করে না। অথচ কৃষিতে বিনিয়োগ করলে পাল্টে ফেলা সম্ভব কৃষি অর্থনীতি। তিনি চিন্তা করলেন, মানুষের কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার, বাগান করার স্বপ্নটাকে কাজে লাগিয়ে নিজে সাপোর্ট দিয়ে যদি লাভজনক কিছু একটা করে দিতে পারেন। তবে কৃষির যেমন উন্নয়ন হবে। লোকজনও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। প্রথমে কেনা হলো তিন একর জমি। সেখানে করা হলো আমের বাগান। আর তার সঙ্গে যুক্ত হলো কিছু স্বপ্নবান মানুষ। যাদের স্বপ্ন সবুজের উত্তরণের পাশাপাশি বিষমুক্ত ফল চাষের। তারাও যুক্ত করল তাদের আত্মীয়স্বজনকে। ধীরে ধীরে ছোট্ট একটা স্বপ্ন আকারে বড় হতে থাকল। পীরগঞ্জের দেলোয়ার হোসেনের সহযোগিতায় জাহিদের স্বপ্ন দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। বাগানও বড় হয়ে সাত একরের বেশি হয়ে গেছে এখন। প্রতিটি পাঁচ শতক আয়তনের ১৩১টি প্লটের ভিতর ৯০টি প্লট এরই ভিতর বিক্রি হয়ে গেছে।

এখানে প্লট রয়েছে ঢাকার একজন তরুণ মহিউদ্দিনের। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন, এখানে পারিবারিকভাবে তাদের তিনটি প্লট কেনা হয়েছে ২০১৩ সালে। এ পর্যন্ত দুবার পেয়েছেন সতেজ ফল। প্রতিটি ইউনিট থেকে পেয়েছেন ৯৬ কেজি করে আম। জানিয়ে রাখি, জাহিদ চাকলাদার পাঁচ শতাংশ করে এক একটি প্লটকে ইউনিট হিসেবে ধরছেন। ৬০ ফিট দৈর্ঘ্যের ও ৩১ ফিট প্রস্থের এক একটি ইউনিটে রয়েছে ৫৪টি করে আম গাছ। যার মাঝে ৫২টি আম্রপালি। আর বাকি দুটি বড় জাতের গাছ ল্যাংড়া, ফজলি বা হিমসাগর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ ১০-১২ বছর পর  আম্রপালির গাছগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। থেকে যাবে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগরের গাছ।   

এভাবেই একজনের দেখাদেখি আরেকজন করে একই পরিবারের অনেকেই কিনেছেন আমবাগান। রাজধানীতে বসেই তারা হয়ে উঠেছেন একেকজন আমবাগান মালিক। কোনো কোনো সংগঠনও এখানে আমবাগান কিনেছে। এমনই একজন কৃষিবিদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ৪৫ জন বন্ধু মিলে তারা একটা সংগঠন করেছেন। সেই সংগঠন থেকে তারা আরও চারটি বাগান কিনেছে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে মাত্র পাঁচ শতাংশের মাঝে ৫৪টি গাছ। ব্যাপারটি পরিষ্কার করলেন কৃষিবিদ ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ডেন্স প্ল্যানটেশন পদ্ধতিতে ৫৪টি গাছ লাগানো আছে ঠিকই। কিন্তু এখানে একটা ছক করা আছে। কয়েক বছর পর পর এখান থেকে কিছু কিছু গাছ সরিয়ে ফেলা হবে। ওই হিসাবে এটি বিজ্ঞানসম্মত। তিনি আরও বলেন, জাহিদ ইন্টারক্রপিং সিস্টেম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। শুধু এখানে আমের এক জাতের সঙ্গে আরেক জাতের চাষ। আর যেহেতু আম্রপালি গাছ আকারে ছোট তাই তেমন সমস্যা নেই। 

আমি যখন এই প্রকল্প দেখতে আসি তখন ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন আমবাগান মালিকের সঙ্গে আমার কথা হয়। যারা এখানে প্লট কিনছেন তাদের বাগানের গাছ দেখাশোনা করার দায়িত্বও জাহিদের। তবে সামান্য সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। মাসে প্লটপ্রতি ৫০০ টাকা। বাগানের সমস্ত ফল আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও জাহিদের। শতকরা ১০ ভাগ ফল অবশ্য রেখে দেয় জাহিদ মেইনটেনেন্স খরচ বাবদ। ১২ বছর ফল চাষের চুক্তি থাকে জাহিদের সঙ্গে। এরপর ক্রেতা সেখানে নিজের ইচ্ছা মতো যে কোনো কিছুই করতে পারবে।

যারা এখানে আমবাগান কিনেছেন তারা সবাই বলছেন শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো প্রতিশ্রুতি শুনেছেন, বাস্তবেও তাই পেয়েছেন তারা। এতেই দিনে দিনে তাদের আস্থা আরও বাড়ছে। একজন একটি বাগান কেনার পর তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আগ্রহী হন কিনতে। এভাবেই এখানকার বাগানগুলো খণ্ড খণ্ডভাবে পারিবারিক একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে দুটি বাগান কিনেছেন সলিমুল্লাহ। তিনি এই উদ্যোগটি দেখেই প্রথমে আকৃষ্ট হন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দিন যত যাচ্ছে তার আকর্ষণ ও আস্থা যেন বাড়ছে। সলিমুল্লাহ বলছেন, জাহিদ চাকলাদারের এই পরিকল্পনা অসাধারণ। সাধারণত প্লট কেনা বলতেই তিনি বা অন্যরা মনে করেন সেখানে দালান কোঠা তৈরি, কিন্তু মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় পাঁচ শতক জমি কিনে সেখানে বাগান করার এই পরিকল্পনা সত্যি চমৎকার পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব উদ্যোগ বলে মনে করেন সলিমুল্লাহ।

জাহিদ চাকলাদার দারুণ স্বপ্নচারী এক তরুণ। তার উদ্যোগগুলো কৃষিবান্ধব ও সুদূরপ্রসারী। প্রকল্পটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। পাশাপাশি সময়ের দিকেও তিনি তাকিয়ে আছেন। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন সে সঙ্গে আগামীর চিন্তা ও বাস্তবতা যা দাবি করে সেদিকে যেতে চান তিনি। এলাকার সাধারণ মানুষের কাছেও জাহিদের এই উদ্যোগ বেশ গ্রহণযোগ্য। এই বাগান দেখে দৃষ্টি খুলে গেছে অনেকের। প্রিয় পাঠক, সম্মিলিত বাণিজ্যিক ভাবনা বা অন্যের স্বপ্ন পূরণের বাণিজ্যিক উদ্যোগ আজকের দিনে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। আমাদের দেশেও তরুণদের মধ্যে এমন উদ্ভাবনী চিন্তা আসছে, এটি এক আশাপ্রদ ব্যাপার।

এখানে অনেক ইতিবাচক দিক আছে। এক. উদ্যোগটি পুরোপুরি কৃষিবান্ধব, দুই. বছরান্তে পুরোপুরি বিষ ও রাসায়নিকমুক্ত আম খাওয়ার সুযোগ, তিন. নাগরিকদের কৃষির আকাঙ্ক্ষার সহজ বাস্তবায়ন। আমাদের বিশ্বাস, অনেক ক্ষেত্রেই এমন উদ্যোগ আসবে। একজনের উদ্ভাবনী চিন্তার অংশীদার হয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে বহু মানুষ।  আপনি পাঁচ শতাংশ পরিমাণ জমির আম বাগানের গর্বিত মালিক হয়ে খেতে পারবেন বিষমুক্ত আম। পাঠাতে পারবেন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিজ বাগানের আম। 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর