বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

উৎসবের একাল ও সেকাল

সাইফুর রহমান

উৎসবের একাল ও সেকাল

সন্ধ্যায় ছাই রঙা মেঘে ঢাকা সমস্ত আকাশ। কালো কৃষ্ণবর্ণের ছেঁড়া ছেঁড়া খানিক মেঘ বিক্ষিপ্তভাবে ছেয়ে আছে এখানে সেখানে। তমিজউদ্দিন দোরের কপাট খুলে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উঠোনের একপাশে অবহেলায় ও অযত্নে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের খোঁয়াড়টির দিকে। মোরগ-মুরগিগুলো হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকবে খোঁয়াড়ে। তমিজউদ্দিন একটি মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন ঘরের মেঝেতে।  তার সম্মুখে কিছু আহার সামগ্রী রাখা। ভারী একটি কাঁসার গেলাসে পোয়া খানেকের মতো দুধ। বৃহৎ কাঁসার থালাটিতে বেশ খানিকটা ছাতু সঙ্গে বিচি কলা ও অল্প একটু ঝোলা গুড়। সমস্ত দিন রোজা রেখে শুধু ছাতু কলা ইফতারের জন্য যদিও যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাতে কি, কোনোমতে ইফতার শেষ করেই তিনি উদর পূর্তি করবেন মাছ, ভাত আর ডাল দিয়ে। এ ঘটনাটি আদ্দি কালের। কম করে হলেও নিদেনপক্ষে দু-তিন পুরুষ আগেকার কথা। তখনো রাস্তা ধরে সারি সারি ইলেকট্রিক খুঁটি পোঁতা হয়নি। ঘরে ঘরে লাগেনি বৈদ্যুতিক সংযোগ। সিকিমাইল দূরে অবস্থিত নোয়াপাড়া মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যাবে সে আশা করা অবান্তর। সে জন্যই তমিজউদ্দিন তীক্ষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মোরগ-মুরগিগুলোর দিকে। ওগুলো খোঁয়াড়ে ঢোকা মাত্রই মুখে পানি তুলে রোজা ভাঙবেন তিনি। চারপাশের অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হয়ে এলো। মুরগিগুলোও সব এক এক করে ঢুকে গেল খোঁয়াড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে তমিজউদ্দিনও পানি পান করে রোজা ভাঙলেন। কিন্তু পশ্চিম দিগন্তের একেবারে শেষ প্রান্তে মেঘমালাগুলো অল্প একটু অপসৃত হতেই ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা থেকে কোত্থেকে আচানক একচিলতে আলো ফিক করে বেরিয়ে আলো ছড়িয়ে দিল চারদিকে। তমিজউদ্দিন বলে উঠলেন আরে যা! সারা দিনের কষ্টটাই মনে হয় গেল মাটি হয়ে। এই বলে তিনি লাঠি হাতে ছুটলেন খোঁয়াড়ের দিকে মোরগ-মুরগিগুলোকে শায়েস্তা করতে।

এক সময় এমনটাই ছিল রোজা অবসানে ইফতার করার প্রচলিত রীতি। এই কাহিনীটি আমাকে শুনিয়েছেন আমার বন্ধুবর এ সময়ের জনপ্রিয় কবি জুননু রাইন। উনি শুনেছেন ওনার বাবার মুখ থেকে। আর জুননুর বাবাকে এ গল্প বলেছেন জুননুর দাদা। বর্তমান সময়ে রোজার তাৎপর্য কিংবা ঈদ উৎসবের আনন্দ সব কিছুই কেমন যেন বদলে গেছে। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঈদ উদযাপনের ঐতিহ্যময় সব সংস্কৃতি। ছোটবেলায় আমরা ঈদে নতুন জামার জন্য ভীষণ মুখিয়ে থাকতাম। নতুন জামা, জুতো, ইংলিশ প্যান্ট না হলে যেন ঈদ সম্পূর্ণতা পেত না। ছোটবেলায় প্রায়ই আমাদের ঈদ করা হতো নানা বাড়ি ঢাকার বাড্ডায়। আমার বয়স তখন কত হবে। বড় জোর ছ-সাত বছর, ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা বলছি। আমার নানা ছিলেন বাড্ডা আলাতুননেসা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমার বাবাও সে সময় বয়সে তরুণ ও সরকারি চাকুরে। কতই বা বেতন পান। সেবার ঈদে বাবা আমাদের নতুন কোনো জামাকাপড় কিনে দিতে পারেননি। ঈদের আগের সমস্ত দিন জামা-জুতোর জন্য কান্নাকাটি করলাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ঈদের দিন খুব ভোরে উঠে বর্ষার মেঘের মতো মুখ কালো ও ভার করে বসে রইলাম। নানার মনে হয়তো একটু দয়া হলো। তিনি সেই সকাল ৬টার দিকে আমাকে নিয়ে বের হলেন বাজারে। নিয়ে গেলেন একটি দর্জির দোকানে। ১৯৯০ সালের আগে বেশির ভাগ মানুষজনদের দেখতাম দর্জি দিয়ে জামাকাপড় তৈরি করে পরতেন। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। একটা সময় ছিল যখন দর্জিরা সমস্ত চাঁদ রাত জেগে খদ্দেরদের জন্য জামাকাপড় সেলাতেন। অনেকে ঈদের দিন সকালেও পোশাক-পরিচ্ছেদ ডেলিভারি নিতেন। তো হয়েছে কি নানা ও আমি সেই দর্জির দোকানে গিয়ে হাজির। দেখলাম সেখানে অনেক মানুষ সারিবদ্ধভাবে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জামাকাপড় ডেলিভারি নিতে। দর্জি বেচারা ক্লান্ত দেহে সবার হাতে সদ্য নির্মিত জামাকাপড়গুলো তুলে দিচ্ছিলেন এক এক করে। নানাকে দেখেই দর্জি সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সে সময় স্কুলের শিক্ষকদের মানুষ অসম্ভব শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। নানা আমাকে দেখিয়ে বললেন— আমার নাতিটার খুব মন খারাপ। এবার ঈদে ওর জন্য কোনো নতুন জামা কেনা হয়নি। তুমি ভাই কষ্ট করে এক্ষুনি একটি ফুল হাতা শার্ট তৈরি করে দাও। দর্জি লোকটা বেশ উসখুস করতে লাগল। অন্য কেউ হলে হয়তো জোর গলায় ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু মহল্লার একমাত্র স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে কথা। দর্জি লোকটার ছেলেও সম্ভবত পড়তেন নানার স্কুলে। অতি সস্তা দামের ট্রেটনের একটি বড় থান থেকে কাপড় কেটে আমার জন্য দর্জি লোকটি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তৈরি করে দিলেন একটি ফুলহাতা শার্ট। লাল, সবুজ ও হলুদ প্রিন্টের সেই শার্টটি যেন আমি এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই। আঁকিয়ে হলে সেই শার্টটির ছবি আমি এখনো হুবহু এঁকে দিতে পারতুম। আমার মনে হয় নাকে টকটকে লাল টমেটো গোঁজা সার্কাসের ক্লাউনরাও এর চেয়ে ভালো রঙচঙে জামা পরে খেলা দেখায়। স্মৃতিপটে শার্টটির ছবি হুবহু লেপটে আছে এ কারণে যে, সে বয়সে অর্ধেক পৃথিবীর সম্পদ আমার হাতে তুলে দিলেও বোধকরি এতটা খুশি আমি হতাম কিনা সন্দেহ। যা আমি হয়েছিলাম ঈদের সকালে সস্তা দামের সেই শার্টটি গায়ে চড়িয়ে।

পরিতাপের বিষয় এই যে, এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে ঈদের দিনও যেন অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটি দিন। কিন্তু আমাদের সময়ে ঈদ যে কি পরিমাণ খুশির বার্তা নিয়ে আসত তা আমাদের ছেলেমেয়েদের বুঝাই কী করে।

ঈদের নতুন চাঁদ দেখার কথাই প্রথম বলি— ঊনত্রিশ কিংবা ত্রিশ রোজার শেষে আমরা ছোট ছেলেপুলেরা তীর্থের কাকের মতো আকাশ পানে তাকিয়ে থাকতাম কখন দেখা দেবে ঈদের নতুন চাঁদ। শুভ্র সরু সুতোর মতো বাঁকা এক ফালি চাঁদ দেখার পর কি যে আনন্দ-উল্লাস হতো সেটা মনে হলে এখন আশ্চর্য লাগে। আমরা ছোটরা দল বেঁধে সব ছড়া কাটতাম। চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে/দেখবি কে কে আয়/নতুন চাঁদের আলো এসে/পড়লো সবার গায়। টিভি, রেডিওতে গান শুরু হতো— ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুমি আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ। এখন ভাবি কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি না লিখলে ঈদের আনন্দটাই বোধকরি সম্পূর্ণ হতো না। ভাগ্যিস কবির ভাবশিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি এ গানটি আমাদের জন্য রচনা করেছিলেন। পাশাপাশি চারদিকে শুরু হতো বাজি ফোটানোর ধুম। আমরা দোকান থেকে কিনে নিতাম হরেক রকমের পটকা। কোনোটি ছিল বর্তুলাকার, কোনোটি আবার চ্যাপ্টা ধরনের। তাঁরাবাতি নামে একটি বাজি ছিল যেটা আতশবাজির মতো চারদিক আলো ছড়াতো। ওটাতে আগুন জ্বেলে হাতে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ঘারিয়ে ছুড়ে দিতাম আকাশে। ওটা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো পানির ফোয়ারার মতো। আরেকটি ছিল মরিচা বাতি, ওটার এক প্রান্তে আগুন ধরিয়ে দিলে সেটি চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ করে ঘুরপাক খেয়ে ঈষৎ আলো ছড়িয়ে দড়াম শব্দে কাঁপাতো চারদিক। আবার আরেক ধরনের পটকার নাম ছিল রকেট বোম। ওটার পশ্চাদে আগুন ধরিয়ে দিলে শোঁ শোঁ করে ওটা উঠে যেত আকাশের দিকে। তারপর বিকট শব্দে প্রকম্পিত হতো চারপাশ। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশে কিন্তু আমাদের মতো এমনভাবে পটকা কিংবা আতশবাজি ফুটিয়ে ঈদ উদযাপনের রীতি রেওয়াজ চোখে পড়ে না। ঈদ উৎসবে এসব রীতি রেওয়াজের প্রচলন শুরু হয়েছিল মোগল আমলে। রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, মোগল সুবেদাররা ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের সময় থেকেই ঈদের আনন্দ-উৎসব উত্কর্ষতা লাভ করতে শুরু করে। সুবেদার ইসলাম খাঁ যে বছর প্রথম ঢাকা আসেন তখন ছিল রমজান মাস। সে বছরই ঈদ উৎসব জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয়েছিল। একদিকে যেমন ছিল রাজধানী স্থাপনের আনন্দ অন্যদিকে ঈদের আনন্দ। মোগল আমলে আকাশে নতুন চাঁদ দেখে কীভাবে আনন্দ উৎসব করা হতো সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন লেখক মির্জা নাথান। দিনের শেষে ঈদের নতুন চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠতো শাহীতূর্য। গোলন্দাজ বাহিনী শুরু করত আকাশে আগুন লাগানো নয়নাভিরাম আতশবাজির উৎসব। সন্ধ্যার প্রথম প্রহর থেকে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত একটানা বন্দুকের গুলি ছুড়ে এলাকাবাসীর মনে ঈদের আনন্দের রঙ মাখিয়ে দিত। রাতের শেষ প্রহরের দিকে বন্দুক ছোড়া বন্ধ করে গোলন্দাজ বাহিনী বড় কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ শুরু করত। তাতে করে দ্রাম দ্রাম শব্দে প্রকম্পিত হতো দূর-দূরান্ত পর্যন্ত। একটা সময় ছিল যখন হোটেল, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি ঘরেও তৈরি হতো সুস্বাদু ও মজাদার হরেক রকমের সব ইফতার। শহরের বেশির ভাগ মানুষই এখন আর এসব ঝামেলা পোহাতে চান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাইরে থেকে তারা কিনে আনেন যাবতীয় ইফতার। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে বাড়িতে পিয়াজু, বেগুনি, মাংসের নানাবিধ চপ, কষা মাংস, পরোটা প্রভৃতির খোশবাই রোজার খিদেকে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ বাড়িয়ে তুলত। ট্রেতে নানা রঙের ইফতার সাজিয়ে সাদা রঙের কাপড়ের ওপর লাল, নীল ফুল আঁকা রুমালে ঢেকে ইফতার বিলানো হতো এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি। আরেকটি কথা, বর্তমানে এই যে, আমাদের ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ ছোলা ও মুড়ি এটি কীভাবে আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ল এ বিষয়টি একটু ছোট করে বলি— ইংরেজ আমলে চলাচলের প্রধান বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। দুই কিংবা চার চাকার গাড়িগুলো টানত তাগড়া ও হৃষ্টপুষ্ট সব ঘোড়া। অসুরের মতো শক্তি জোগাতে সেসব ঘোড়াকে সকাল-সন্ধ্যা খাওয়ানো হতো প্রচুর পরিমাণ ছোলা। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের ছোট-বড় সব জমিদারের কাজকর্ম, বিষয়-আশয় তদারকি করার জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর লোকলস্কর, পাইক-পেয়াদা ও কুলি-কামিন। জমিদারদের ধারণা হলো ঘোড়াদের ছোলা খাওয়ালে যদি শক্তি বাড়ে তবে এসব লোকলস্করকে দৈনন্দিন আহার্য খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে বেশ পরিমাণ ছোলা খাওয়ানো গেলে হয়তো তাদেরও পরিশ্রম ক্ষমতা বাড়বে। এভাবেই আস্তে আস্তে বাংলায় নিম্নবিত্তের মধ্যে ছোলা খাওয়ার প্রচলন শুরু হলো। প্রথম দিকে ছোলা খাওয়া হতো কাঁচা, দীর্ঘক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে। পরবর্তীতে ছোলা সেদ্ধ করে খাওয়ার চল শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ছোলার সঙ্গে যুক্ত হয় তেল মসলা প্রভৃতি অনুষঙ্গ। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ হিন্দু জমিদারের প্রজা ও কাজকর্মের অন্য সব লোক ছিলেন মুসলিম। গরিব ও দরিদ্র মুসলমান সারা দিন রোজা রেখে ইফতারের সময় ছোলা খেতেন এ জন্য যে, তাতে হয়তো সারা দিনের শারীরিক দুর্বলতা দূর করে শরীরে শক্তি জোগাবে। এরপর ছোলার সঙ্গে যুক্ত হলো মুড়ি। অন্যদিকে পিয়াজু, ফুলুরি, বেগুনি এগুলো তো আমাদের দীর্ঘদিনের বাঙালি ঐতিহ্যময় খাবারেরই অনুষঙ্গ। আমি যখন ওয়ান-টু’তে পড়ি তখন রোজা হতো গ্রীষ্মকালে। প্রচণ্ড গরমে ও তেষ্টায় রোজাদারদের হাঁসফাঁস অবস্থা। রোজা ভাঙতে প্রয়োজন সুশীতল বরফগলা পানি। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে খুব কম মানুষের বাসাতেই ফ্রিজ ছিল। আমাদের বাড়িতেও ফ্রিজ আসে সম্ভবত ১৯৮৫ সালের দিকে। সে সময় দেখেছি বিকাল হলেই বরফওয়ালারা মাথায় কিংবা কখনো কখনো সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে বরফের বাক্স চাপিয়ে বরফ বিক্রি করতে বেরুত। মাঝে মধ্যে বরফওয়ালাদের দেখা না পাওয়া গেলে বাবা আমাকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘যা তো বাবা বরফ কল থেকে দু-চার টাকার বরফ নিয়ে আয় জলদি’। আমি তক্ষুনি আমার একটি লাল রঙের অ্যাভোন সাইকেল ছিল সেটাতে প্যাডেল চেপে দ্রুত চলে যেতাম আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে। সেখান থেকে বরফ নিয়ে আসতাম ফ্ল্যাক্সের ভিতর ভরে। প্রসঙ্গ ক্রমেই মনে পড়ে গেল ভারতবর্ষে প্রথম বরফ আমদানির ইতিহাস। বরফের মতো এমন একটি বস্তু দিয়েও যে ব্যবসা করা যায় সেটাও ইংরেজরাই আমাদের দেখিয়ে ছেড়েছিলেন। ভারতবর্ষে প্রথম বরফ আমদানি হয় কলকাতায়। ১৮৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে আমেরিকার বোস্টন থেকে বরফ বোঝাই একটি জাহাজ কলকাতা বন্দরে এসে ভিড়ল। চারদিকে খবর রটে গেল মুহৃর্তেই। আর অমনি কলকাতার লোকজন ঊর্ধ্বশ্বাসে সব ছুটল বন্দরের দিকে। বরফ জিনিসটা নিজ চর্ম চোখে না দেখা পর্যন্ত যেন মনে শান্তি নেই কারও। ওয়েনহাম হ্রদের জমাট বাঁধা বরফের চাঁই আমেরিকা থেকে কলকাতায় আনানোর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের। ভারতের শৌখিন ও বিলাসী সম্প্রদায় কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে ১৫ হাজার মাইল দূরবর্তী অঞ্চল থেকে ভারতে বরফ আমদানি সম্ভব হবে। একবার বরফ ব্যবসায়ী টিউডর সাহেবের একখানা জাহাজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের পথে চড়ায় আটকে যায়। ওইভাবে কাটে চার মাস। চার মাস পর যখন মালপত্র খালাস করা হয় তখন দেখা গেল যে, বরফের তেমন কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অন্যান্য মালপত্রের মধ্যে বরফও ছিল। এ ঘটনার পর টিউডর সাহেব ভারতবর্ষে বরফ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিলেন।

এক সময় ঈদের আরেকটি বড় আকর্ষণ ছিল মেলা। ঈদ উপলক্ষে শুধুমাত্র যে গ্রামগঞ্জেই মেলা হতো তা কিন্তু নয়। খোদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বসত ঈদ মেলার জমজমাট সব আয়োজন। ধানমন্ডির ঈদগাহের পাশে ঈদ উপলক্ষে একটি মেলার আয়োজন করা হতো। এছাড়াও রমনার ময়দান, চকবাজার, ইসলামপুর, ধূপখোলা মাঠ এবং পল্টন ময়দানে ঈদের মেলা হতো। পাঠক শুনে আশ্চর্যান্বিত হবেন যে, ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে গুলশানের ২ নাম্বারে, কয়েক দিন আগেও যেখানে ওয়ান্ডার ল্যান্ড নামক একটি পার্ক ছিল ওখানে বসত জাঁকজমকপূর্ণ একটি ঈদ মেলা। সে সময় ওটা ছিল জনসাধারণের জন্য অবারিত একটি পার্ক। নানা গাছ-গাছালিতে ছাওয়া ছিল পার্কটি। নাগরদোলা থেকে শুরু করে বাঁশের বাঁশি, টিনের তলোয়ার, প্লাস্টিকের ছোট বায়স্কোপ, লাল-নীল কাগজের হরেক রকমের খেলনা আরও কত কিছু যে পাওয়া যেত মেলায় সেটা বলে শেষ করা যাবে না। থাকত নানা রকম খাবার-খই, কদমা, মণ্ডা, মুড়ি, মুড়কি, মোয়াসহ অন্যান্য মুখরোচক সব খাদ্যদ্রব্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মনের আনন্দে বরফওয়ালার কাছ থেকে কিনে নিত কুলফি বরফ, রাঙা শরবত, গোলাপি লজেন্সচুস কিংবা হাওয়াই মিঠাই জাতীয় খাবার। সে সময় এক টাকা ঘণ্টা সাইকেল ভাড়া পাওয়া যেত। আমি আর আমার এক সমবয়সী মামা দুজন দুটো সাইকেল ভাড়া করে বাড্ডা থেকে ছুটে যেতাম মেলায়। তখনো গুলশান এতটা জাতে ওঠেনি। বেশির ভাগ ইমারত-ই ছিল দু-তিন তলা ও সাধারণ মানের। গুলশান এক নম্বর থেকে দুই নম্বর পর্যন্ত পাকা সড়কটি ছিল একেবারে ফাঁকা। মাঝে মধ্যে শুধু দু-একটা টয়েটো পাবলিকা কিংবা ডেটসান জাতীয় প্রাইভেট কার শাঁ শাঁ করে ছুটে যেত। আমরা ভয়ে সাইকেল নিয়ে দ্রুত সরে যেতাম রাস্তার এক প্রান্তে। এ কথা আজ ধ্রুব সত্য যে, মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ দিনকে দিন পানসে হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঈদের সব ইতিহাস ও ঐতিহ্য।  মানুষের মধ্যে অতিশয় আত্মকেন্দ্রিকতা, নানাবিধ ভার্চুয়াল আমোদ প্রমোদ, সভ্যতার চরম বিকাশ প্রভৃতি বিষয়গুলো এর প্রধান কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়। আগত ঈদ উপলক্ষে আমাদের এতটুকুই চাওয়া— ফিরে আসুক ঈদ উৎসবের সেই পুরনো সুর।  ঈদের আনন্দের রঙে রাঙ্গুক প্রতিটি মানুষের হৃদয়।

 

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর