বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্নীতি-বিমুক্ত সমাজ দেখতে চাই

নূরে আলম সিদ্দিকী

দুর্নীতি-বিমুক্ত সমাজ দেখতে চাই

ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে অবশেষে নতুন অর্থবছরের বাজেটটি পাস হয়েছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুধু বয়সের ভারে ন্যুব্জমানই নন, তার স্মৃতিশক্তিও অনেকটা অবলুপ্ত। আর লাজলজ্জা? সেটা তো একেবারেই নিঃশেষিত। ‘রাবিশ’ শব্দটি প্রয়োগ করতে উনি উদারচিত্ত। কিন্তু এই শব্দটি তার নিজের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য, বিবেকের দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিষ্কলুষ চিত্তে উনি নিজে কখনো অনুধাবন করার তাগিদ অনুভব করেছেন কি না জানি না।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এবার তার বাজেটটিকে কেউই প্রশংসা করেননি। কী সুশীল সমাজ, কী সংসদ সদস্য— সর্বত্রই সমালোচনা, তীব্র সমালোচনা, কটাক্ষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, উপহাস সবকিছুই হয়েছে। সংসদে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাও এই বাজেট নিয়ে কৌতুক, ব্যঙ্গ এবং সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। এমনকি সংসদ নেতাও তার স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে সমালোচকদের পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছেন। সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে এটি আমার কাছে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান সাহেবের অর্থমন্ত্রী সংসদের বাজেট উপস্থাপনের পর আইয়ুব খান সাহেব বিদেশ থেকে ভাড়া করে এক ধরনের বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে বাজেটের আদ্যপান্ত তুলে ধরে প্রশংসা করাতেন এবং সংবাদ মাধ্যম, বিশেষ করে পাকিস্তানের ডন, পূর্ব পাকিস্তান মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তানে আষাঢ়-শ্রাবণের মুষলধারে বর্ষণের মতো অবিশ্রান্ত ধারায় সেসব প্রশংসার প্রচারণা চালাতেন। আর এসবের বিরুদ্ধে ইত্তেফাকের মানিক ভাই তার কলামে এবং সিরাজ ভাই সংবাদ উপস্থাপনার মাধ্যমে এমন ধোলাই দিতেন যে, অনেক সময় ওইসব ভাড়াটিয়া বিদেশি ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে পাকিস্তান ছাড়তেন বলেও শুনেছি। ইচ্ছে করলে নিদেনপক্ষে মান বাঁচানোর জন্য শেখ হাসিনা সরকার সেই অপচেষ্টাটির অনুসরণ করতে পারতেন। কিন্তু তা কতটুকু কার্যকর ও ফলপ্রসূ হতো বলা যায় না। কারণ, অর্থমন্ত্রী নিজেই এতসব বেসামাল উক্তি করে রেখেছেন যে, তাকে প্রতিবাদের কশাঘাত থেকে কতটুকু রেয়াত দেওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির বিষয়ে ২০১১ সালে খালেদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টটি তিনি প্রকাশ তো করতে পারলেনই না, বরং পঞ্চদন্ত বিকশিত করে সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বললেন, ‘তারা এত হোমড়া-চোমড়া যে, আমি তাদের নাম প্রকাশের সাহস রাখি না।’ এটি একটি সরকারের যে কোনো মন্ত্রীর জন্য কতটুকু মানহানিকর, তার বিন্দুমাত্র উপলব্ধি করলে সেদিনই তিনি পদত্যাগ করতেন।

অর্থমন্ত্রী এ বছর ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এত বড় একটা মাথাভারী বাজেট প্রণয়ন করেছেন যে, বাজেটের এক-চতুর্থাংশ অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে তার বাজেট বক্তৃতায় এর কোনো উল্লেখই ছিল না। বাড়তি অংশটার ব্যাপারে তিনি নিজেই জানেন না এর উৎস কী হবে! এ ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তার দায়সারা গোছের একই উত্তর— ‘ওটা সময় মতো ভবিষ্যতে দেখা যাবে’! বলিহারি যাই! এমন বিস্ময়কর অযৌক্তিক ও হাস্যকর উত্তর দিতে অর্থমন্ত্রী কোনো রকম সংকোচবোধ করেননি। এক লাখ টাকা ব্যাংকে থাকলে তিনি তাকে ধনী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এবং এর ওপর ভ্যাট আরোপ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এটা নিয়েও সংসদ ও সমাজে প্রতিবাদ কম হয়নি। কিন্তু তিনি নির্বিকার। তিনি নির্বিকার থাকার কারণে সংসদ নেত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, মূসক এবং অন্যান্য কিছু অযৌক্তিক ও বিব্রতকর করারোপের বিষয়ে তিনি নিজেই বিহিত করবেন বা সমাধান দেবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিষয়টির আপাত সমাধান দিয়েছেন। এমনকি পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানত করের (আবগারি শুল্ক) আওতামুক্ত রেখেছেন। এটা সূর্যস্নাত দিবালোকের মতো সত্য, নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি মুহিত সাহেবের কল্পনাপ্রসূত কর ও মূসকের চোরাবালিতে পা রাখতে সাহস পাননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ, প্রশাসন, বিচারিক ব্যবস্থা— সবকিছুকে এমন বিস্ময়করভাবে অধিকরণ করেছেন যে, পাকিস্তানের সেনানায়ক ফিল্ডমার্শাল (!) আইয়ুব খান মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেও সেটা করতে পারেননি। মৌলিক গণতন্ত্র, অর্থাৎ বিডি মেম্বারদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান আজ জীবিত থাকলে শেখ হাসিনার এই বিস্ময়কর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দক্ষতায় এতটাই আশ্চর্যান্বিত হতেন যে, সুবোধ বালকের মতো শেখ হাসিনার পদতলে উপবিষ্ট হয়ে দীক্ষা নিতে শঙ্কাবোধ করতেন না। দেশে সার্বভৌম সংসদ আছে, সর্বোচ্চ আদালত আছে, একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক অবকাঠামো আছে; সেখানে একটা মেরুদণ্ডহীন বাগাড়ম্বরসর্বস্ব, আত্মম্বরী, ক্ষমতালিপ্সু এবং তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণ তথাকথিত বিরোধী দল (বিএনপি) রয়েছে। তারপরও সম্পূর্ণ মৌলিক অধিকার বিবর্জিত এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তিনি করলেন কী করে, তা সত্যিই বিস্ময়কর! রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। পরিবারটি রাজনৈতিক; এইটুকু মাত্র। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আগে থেকেই সত্যিকার অর্থে সর্বান্তকরণে একজন গৃহিণীর ভূমিকায় ছিলেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের আগে তার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া রাষ্ট্রীয় স্কলারশিপে বেলজিয়ামে গবেষণা করছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনা জয়-পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে বেলজিয়ামেই অবস্থান করছিলেন। বেলজিয়ামে তখন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সানাউল হক। শেখ হাসিনা সপরিবারে তার গৃহে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এতটাই ভীতু ও অকৃতজ্ঞ যে, আশ্রয় না দিয়ে শেখ হাসিনার পরিবারকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেন। পরিবারটিকে আশ্রয়ে দিতে পার্শ্ববর্তী জার্মানিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সেই বিপদের দিনে এগিয়ে আসেন। হুমায়ুন রশীদ সাহেব নিজ গাড়ি করে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে নিজের বাসায় নিয়ে সসম্মানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, শোকে মুহ্যমান শেখ হাসিনাকে শুধু আশ্রয় প্রদানই করেননি, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, পৃথিবীর তখনকার শ্রেষ্ঠতম স্টেটসম্যান ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ, সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। তারপর শোকে-বিহ্বলতায় সব হারানোর বেদনায় বিপর্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও নদীর স্রোতধারার মতো জীবন তো এগিয়ে যায়। সমস্ত শোক-দুঃখ-যন্ত্রণার ঊর্মিমালা অতিক্রম করে সেভাবেই হয়তো দিল্লিতে শেখ হাসিনার জীবন কাটছিল। এদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সমস্যা উত্তরণের একটা উপায় হিসেবে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। এই উদ্যোগের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ড. কামাল হোসেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনার আগে আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) নামে সংগঠনটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। সন্দেহাতীতভাবে জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে সিংহ ভাগ নেতা-কর্মী সম্পৃক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন মিজান ভাই। তবে স্বভাবসুলভভাবে তিনি কোনো বিষয়েই যথেষ্ট তত্পর ছিলেন না ও গুরুত্বসহকারে নিতেন না। সম্ভবত তাস তার জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ থাকার পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক মহলটার সঙ্গেই আমার অন্তরঙ্গতা ও উঠাবসা আগের মতোই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জেলখানা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ব্যবসায়িক জীবনটাকেই বেছে নিই। এখানে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতে আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাই।

আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) দুটি ধারায় আওয়ামী লীগ পরিচালিত হলেও আওয়ামী লীগ (মিজান)-এর পাল্লা প্রাথমিকভাবে ভারী ছিল। শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করে দুটি গ্রুপের বিভাজন কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এক উদাত্ত আহ্বান জানাতে পারতেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি তা করেননি। যদিও তার ক্ষমতায় আসতে ২২ বছর লেগেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের পরিপূর্ণ নেতৃত্ব আয়ত্তে আনতে তিনি দক্ষতার সঙ্গে সক্ষম হয়েছেন।

এবারের সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা প্রায় সবাই সরকারি দলে যোগ দিয়েছেন অনেকটা সুইমিংপুলে ঝাঁপ দেওয়ার মতো। আমার জানামতে, এরা কেউই নির্বোধ নন। বরং চতুর ও বুদ্ধিদীপ্ত। আপন আঙ্গিকে যোগদানের বিষয়টিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করার মতো মেধা ও প্রতিভা তাদের রয়েছে।

এবারের বাজেট আলোচনাটি আমি যথাসম্ভব শ্রবণ করেছি একটা অদ্ভুত কৌতূহল নিয়ে। আমি এটাও বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করেছি, কোনো একজন সংসদ সদস্য যখন বক্তৃতা করেন, তখন কোনো রকমে কোরাম সংরক্ষিত সংসদে তেমন কোনো সংসদ সদস্যই গুরুত্বসহকারে তার বক্তব্য শ্রবণ করেন না। কারণ সেটার জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে কেউ উপলব্ধিও করেন না। গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা এবং সংসদ সদস্যরা অসংলগ্ন, সামঞ্জস্য-বিবর্জিত এবং যার যার নিজস্ব স্টাইলে কথা বলেন। অবস্থাটা গৃহপালিত বিরোধী দলের চেয়েও শোচনীয়। সমগ্র বাজেট আলোচনায় প্রায় লক্ষ কোটি টাকা যে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, পয়েন্ট অব অর্ডারে সেই প্রতিবাদটি আমার কাছে যথাযথ মনে হয়েছে। অন্য বছরের বাজেট আলোচনার চেয়ে সংসদে এবার একটা ব্যতিক্রম এসেছে। সেটি সমগ্র সংসদকে একটি তামাশা কেন্দ্রে পরিণত করেছে। একজন সংসদ সদস্য যদি ২০ মিনিট কথা বলার সুযোগ পান, তাহলে ১৫ মিনিটই তার লেগে যায় কেবল স্তূতি, অর্চনা ও বন্দনায়। আগেকার দিনের প্রসিদ্ধ কবিগানে বন্দনা দিয়েই গান শুরু হতো কিন্তু সেই বন্দনাও ছিল প্রতিভাদীপ্ত এবং যে বিষয়ের ওপর কবিগানটি উপস্থাপিত হতো তার উপক্রমণিকারূপে। সেখানে একটা প্রাসঙ্গিকতা থাকত। এখনকার সংসদ সদস্যরা বন্দনা শুরু করেন (আমার স্নেহাস্পদ) জয় আর পুতুলকে দিয়ে। প্রায় সংসদ সদস্যই—কী মহিলা, কী পুরুষ; কাগজে তাদের পুরো বক্তব্য লিখে আনেন। লিখিত বক্তব্যটুকু কে কতটুকু নিজ গৃহে বসে অনুশীলন করেন বা মুখস্থ করার চেষ্টা করেন তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু অনেকের লিখিত বক্তব্য পাঠেও জড়তা দেখে খুবই বিব্রত হই। আমাদের সময়ে আমরা ওতপেতে বসে থাকতাম কাকে কখন, কীভাবে বক্তব্যের প্যাঁচে ফেলে পয়েন্ট অব অর্ডারে কুপোকাত করা যায়।

এখানে আমি আমার নিজের একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আত্মপ্রচারের তাগিদে নয়, বরং সে সময় সংসদ কতটুকু সজীব, সরব ও প্রাণবন্ত থাকত তারই একটা উদাহরণ দেওয়ার জন্য। সেদিন সংসদে প্রবেশ করতে আমার একটু বিলম্ব হয়। প্রবেশ করেই অবলোকন ও অনুধাবন করলাম সংসদ প্রচণ্ড উত্তপ্ত; সংসদ সদস্যরা অতিমাত্রায় উত্তেজিত। আমি আমার আসন গ্রহণ করেই আমার পাশের আসনে বসে থাকা এক সতীর্থকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, মিটফোর্ড রোডে অবস্থিত ‘পাক মেডিকেল স্টোর’ নামের একটি ওষুধের দোকানের লাইসেন্স নবায়নকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বসা দুয়েকজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম দোকানটির মালিক যুদ্ধাপরাধী নয়, অবাঙালিও নয়, জেনেভা ক্যাম্পেও থাকেন না এবং মননশীলতার দিক থেকে তিনি স্বাধীনতার বিপক্ষেও নন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে তো ননই বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক ও অর্থবহ বহু সাহায্য তিনি নিজেই করেছেন। সব জেনে নিয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তৃতায় আমি সেদিন বলেছিলাম ‘শুধুমাত্র পাক মেডিকেল স্টোর নামের কারণে যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের সব অর্জন এবং সব আত্মত্যাগ নিঃশেষিত হয়ে যায়; মাননীয় স্পিকার, তাহলে ওই একই অপরাধে আমি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আপনি এমনকী আমাদের সংসদ নেতা জাতির জনকও অপরাধী। কাজেই আমি এই সংসদে প্রস্তাব করছি, আমাদের পাকস্থলীর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গস্থলী করা হোক এবং এইমর্মে অভিধান পরিশোধনের জন্য বাংলা একাডেমিকে সংসদের নির্দেশনা পাঠানো হোক।’ প্রচণ্ড হাস্যরোলে সংসদ উল্লসিত হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু দুহাতে টেবিল চাপড়াতে চাপড়াতে চিৎকার করতে করতে বললেন, ‘মান্নান (টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী), আলম তোরে বাঁচায়ে দিয়েছে!’

এখন সংসদের অধিবেশনের অবস্থা দেখে আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, সরকারের একটা সদস্যও পয়েন্ট অব অর্ডারে উঠে এ ধরনের কৌতুক ও হাস্যরস সৃষ্টির স্পর্ধা দেখাতে পারবেন না। এটা তাদের কাছে অকল্পনীয় এবং ধৃষ্ঠতা।

৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেল, অর্থমন্ত্রী টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করতে পারলেন না! এমনকি টাকাগুলো ফেরত আনার ব্যাপারে উদ্যোগেরও কোনো ইঙ্গিত বাজেট বক্তৃতায় দিতে পারলেন না। এতে শুধু সংসদকে খাটো করা হয়নি, জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঙ্গনে আমাদের অর্থনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতিটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা কতটা বাস্তবতা-বিবর্জিত এবং কল্পনাবিলাসী তা প্রতীয়মান হয়েছে। হায় রে সাধের স্বাধীনতা! তোমার মৌলিক অধিকার আজ মরীচিকার মতো হারিয়ে গেল! মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাণ এই জীবনসায়াহ্নে এসে ভাবছে, দুর্নীতি-বিমুক্ত মৌলিক অধিকার সমন্বিত যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে যেতে পারব তো?

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর