বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেই দিনটি আর আসেনি

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

সেই দিনটি আর আসেনি

১৯৭৯ সালের শুরুতে বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) গঠনের প্রক্রিয়া থেকে ওই সংগঠনটির প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলাম। ওই বছরই শেষভাগে আমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আমাদের নেতা জিয়াউর রহমানের আদর্শ— তার কবিতা, তার গান, তার অন্যসব সাহিত্যকর্ম এবং সে সবের ভিতরকার সংগ্রামী চেতনার এবং সব অনাচারের বিপরীতে লড়াইয়ের প্রেরণার যে মূলধারা তা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রাণের, হৃদয়ে-মগজের ভিতরে গাঁথা এক অমূল্য সম্পদ।

১৯৮০ সালের ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ) কবি কাজী নজরুলের জন্মদিবস পালনের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)। আমি সেই আনুষ্ঠানিকতায় উপস্থিত ছিলাম— যথারীতি উপস্থাপকের ভূমিকায়, তা ছিল একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান। আমি জাসাস সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সংগঠনের পক্ষ থেকে ফার্মগেট হতে কবি নজরুলের মাজার অবধি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন) সড়কটির নামকরণ কবির নামে করার প্রস্তাব দিই। সেই প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতকে। অনুষ্ঠানে নজরুল একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নজরুলসংগীত শিল্পীরাও অংশ নেন। ফার্মগেটের অনুষ্ঠানে কবির নামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’ উদ্বোধন করেন। ফার্মগেট থেকে কবির মাজার পর্যন্ত যে র‌্যালি হয় তাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুই প্রান্তে দুইবার অংশ নেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কবির মাজারে একটি বৃক্ষ রোপণ করেন।

এই ঘটনার ২-৩ দিন আগেকার ঘটনা। আমরা জাসাসের পক্ষ থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবস সামনে রেখে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবক রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তিকে একটু উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে সহজ-সরল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা পোস্টার ছাপালাম— সেটিতে কবির ধূমকেতু কবিতার একটা অংশ তুলে দিলাম— ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু... আমি...’ ইত্যাদি। পোস্টারের ছবিতে— নজরুলের মুখচ্ছবির আদল থেকে বেরিয়ে আসছেন জিয়াউর রহমান। আমরা এই পোস্টারটি ছেপে সারা ঢাকা নগরীর দেয়ালে দেয়ালে সাঁটলাম লোকজন দিয়ে। অবাক কাণ্ড, আমরা একের পর এক দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছি, আর পুলিশ তা তুলে ফেলছে— ব্যাপারটা কী! দু-এক দিনের মধ্যে দেখলাম সব পোস্টার গায়েব হয়ে গেছে। আমরা তো হতবাক! এই সময়েই আমরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের হালকা ধমক দিলেন। জিয়াউর রহমান বললেন, ‘আরে, তোমরা বোঝো না কেন— কবি নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, তিনি কত বড় ব্যক্তিত্ব! তার সঙ্গে আমাকে তুলনা করবে তোমরা! এটা কী অসম্ভব কথা! আমার মা মিসেস জাহানারা রহমান করাচি রেডিও-তে নজরুলের গান গাইতেন, আমি আবাল্য কবির সব কবিতা, গান, সাহিত্যকর্মের পাঠক, তার এক গুণমুগ্ধ অনুসারী— তার সব সাহিত্যের সংগ্রামী চেতনার, সমগ্র প্রেরণার উত্তরাধিকার অর্জনের সংগ্রামে আমি অংশীদার হতে আগ্রহী, আমি মনে-প্রাণে তাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি! কিন্তু তার সঙ্গে আমার নিজেকে তুলনা করার দুঃসাহস বা ধৃষ্টতা আমার কখনো হবে না। সে কারণেই জাসাসের পোস্টার তুলে নিয়েছি।’ আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম— আমাদের নেতার মহানুভবতা, তার সাংস্কৃতিক-বোধ, তার মূল্যবোধের উচ্চতা। বুঝলাম, আমাদের জাতীয় কবির প্রতি জিয়াউর রহমানের অগাধ শ্রদ্ধাবোধ যা ছিল শতভাগ অকৃত্রিম।

এরপরের ঘটনাবলি তো চলমান, বহমান— আমরা জাসাস নিয়ে ব্যস্ত, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকার পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত, বিশ্বরাজনীতির বহু বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বিশেষ করে তিনি বিশ্বরাজনীতিতে, ভূ-রাজনৈতিক কর্মতত্পরতায় নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা ইত্যাদি। মুসলিম-ভ্রাতৃঘাতী ইরান-ইরাক যুদ্ধের অবসান ঘটানো এসব নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত দিনাতিপাত করছিলেন।

পরের বছর (১৯৮১) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে) জাসাস যে অনুষ্ঠান আয়োজন করল তার ২-৩ দিন আগেকার ঘটনা। জাসাসের সেই কর্মসূচিটি ছিল সীমিত পর্যায়ের। তাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রধান অতিথি করার ভাবনা আমাদের মাথায় ছিল না। প্রধান অতিথি করার কথা বিএনপি মহাসচিব প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। আমরা জাসাসের কয়েকজন নেতা-কর্মী বিএনপি ধানমন্ডি অফিসে (চেয়ারম্যান অফিস) দলের চেয়ারম্যান এবং দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম।

কিছু সময় অপেক্ষার পরে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতি মিলল। আমি রুমে ঢোকামাত্রই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলে উঠলেন— ‘কি খবর, রেজাবুদ্দৌলা, তোমরা এবার, কবি নজরুলের জন্মদিবস করছ না! আমাকে তো কিছুই বলনি!’ আমি বললাম— ‘স্যার, আমাদের একটু সীমাবদ্ধতার কারণে, এবার সীমিত পর্যায়ের অনুষ্ঠান করছি, তাই আপনাকে জানাইনি, প্রধান অতিথি এবার মহাসচিব সাহেব (ডা. বি. চৌধুরী)। আগামীবার বড় অনুষ্ঠান করব, আপনি থাকবেন স্যার।’ তিনিও তাতে সম্মতি দিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই দিনটি আর আসেনি, এসেছে মর্মান্তিক খবর, তার অনেক আগেই।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর