সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই নেত্রীর সংলাপ জরুরি

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

দুই নেত্রীর সংলাপ জরুরি

আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক-সজ্জন বলে পরিচিত সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবারও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে কিছু সান্ত্বনা-তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা আগামী নির্বাচন সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। তিনি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন এই বলে, নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের ‘স্বাধীন-নিয়ন্ত্রক’ ভূমিকা অক্ষুণ্ন রেখে এবং শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনকালে সহায়ক সরকাররূপে ‘যথাযথ’ দায়িত্ব পালন করে যাবে। অর্থাৎ এই সরকার নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করার মতো কোনো তৎপরতা চালাবে না। আর সেনা মোতায়েনের ক্ষেত্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে যেভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং-ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছিল সেভাবেই এই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। এরপরই সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের একজন তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই হবে যথারীতি আর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হবেন; কারণ, তার হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।

এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে একটা সহায়ক সরকার গঠনে রাজি নয়। আসলে সামনের নির্বাচনটি নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অপরকে প্রবলভাবে ভয় পাচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছে : ক. আওয়ামী লীগের ভয়, তাদের সরকার নির্বাচনকালে ক্ষমতায় না থাকলে বিএনপির কর্মীবাহিনী পেশিশক্তি নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে, আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সাম্প্রতিক ও অতীত সব অনাচারের জন্য বিএনপি কর্মীরাসহ বিক্ষুব্ধ-জনতা তাদের বিরুদ্ধে শক্ত-অবস্থান নিতে পারে, পরিণামে, ‘আওয়ামী লীগের পরাজয় অবধারিত’ এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ও তাদের সরকার যত হামলা-মামলা করেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপরে, তার পাল্টা-প্রতিশোধ নেবে বিএনপি ও তার সরকার। (যদিও বেগম খালেদা জিয়া প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি পরিত্যাগের আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু আসল বাস্তবতা হচ্ছে— তার এই কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না আওয়ামী লীগ শীর্ষ-নেতৃত্ব)। খ. বিএনপি শীর্ষ-নেতৃত্ব ভয় পাচ্ছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দুটোই যখন একতরফাভাবে করা হয় (সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই পেরে) সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলটিকে বাইরে রেখে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এবারও। আর যদি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে বিরোধী দলের জন্য সর্বোচ্চ ৬০-৭০টি আসন ছেড়ে দিয়ে বাকি আসনে (মানে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে) আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে ভোট-জালিয়াতি করে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে ছাড়বে। বিএনপির হিসেবে রয়েছে— আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ডিসি, ইউএনও-সহ সব নির্বাচনী কর্মকর্তা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর (যিনি আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাও বটে) কথায় ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে পারে, পাশাপাশি তাদের অঙ্গসংগঠন বিশেষভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা মাস্তান বাহিনীর ভূমিকায় নামতে পারে। আর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হতে বাধ্য সেই অবস্থায়। তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচন হলো না, কিন্তু বিএনপিকে দিয়ে নির্বাচন করিয়ে সরকার সারা বিশ্বের কাছে নির্বাচনটিকে ‘জায়েজ’ করিয়ে নিল। ইতিমধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ সব নেতাকে, সংগঠকদের এবং প্রথম সারির কর্মীদের বিরুদ্ধে ডজন-ডজন মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে, প্রায়-প্রতি সপ্তাহে নেত্রীকে আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেকেরই আশঙ্কা, বিএনপি চেয়ারপারসনসহ প্রধান-নেতাদের সাজা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হতে পারে। এই ধরনের চক্রান্ত বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে পারে ব্যাপকভাবে। এটা সুস্পষ্ট, বিএনপি তার প্রধান নেতা খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনে যাবে না।

আওয়ামী লীগ আরেক টার্ম (পারলে পরের টার্মও) ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া, তারা উন্নয়নের ধারাবাহিতকতা রক্ষার দোহাই দিয়ে সেই পরিকল্পনা জনগণকে খাওয়াতে চায়। কিন্তু দেশবাসী ও আমাদের বন্ধু-বিশ্ববাসী এই দেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি মার্কা আরেকটি নির্বাচন চায় না, কিংবা স্বৈরাচার এরশাদ-আমলের পাতানো খেলার নির্বাচনও আর দেখতে চায় না।

এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এমনি যে, উভয় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কেউ কাউকে ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। এতে করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরেক দফা ভয়ানক হানাহানির আশঙ্কায় দেশবাসী শঙ্কিত এবং সেই শঙ্কা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থা দেশের সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য একেবারেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না, আগামী নির্বাচনের জন্য তো নয়ই। সমাধানের পথ খুঁজতে হবে দ্রুত, কারণ, দিন যত গড়াবে ততই শঙ্কা বাড়বে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছড়ানো এবং দেশবাসীর জানমালের ক্ষয়ক্ষতির।

প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যুক্তি মেনে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। রাজনৈতিক সব দলকে নিয়ে বসতে হবে আলোচনা সভায়। তবে সেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে আওয়ামী লীগ সরকারকে। নির্বাচন কমিশন যে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে শিগগিরই, তা কিন্তু সফল হবে না, সরকার সরাসরি আলোচনার উদ্যোগ না নিলে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ‘রোড-ম্যাপ’-এর নামে যে আলোচনা করতে চায় তা আরও পরে করতে পারবে। কিন্তু এখন হচ্ছে আসল কাজ— নির্বাচনটিকে অর্থবহ করার বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তথা গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক দলের যথাযথ ভূমিকা পালনের প্রশ্নে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা তার সরকার অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন সুষ্ঠুকরণ সংলাপ করতে আদৌ আগ্রহী নয়। তাদের একটা ভয়, ভয়ানক সে ভয়— সংলাপে বসলেই তাদের দুর্বল ভেবে বসবে বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দলগুলোর দাবি-দাওয়া জোরদার হতে থাকবে তাতে, যৌক্তিকতা পেতে শুরু করবে সেই সঙ্গে। তাই তারা তড়িঘড়ি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করাতে চায় যা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল সেই সংলাপে অংশ নেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবে না কেউই। আর বসলেও তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য-পর্যায়ের। সংলাপ হতে হবে সরকার ও সরকারি দলের শীর্ষ-নেতাদের সঙ্গে মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যসব শীর্ষ-আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া ও অন্যসব প্রধান নেতা এবং অন্যসব বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের সঙ্গে। আমাদের স্মৃতিতে আছে, কয়েক বছর আগে বিএনপি মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সংলাপ সফল হয়নি অনেক প্রচেষ্টার পরেও, তাই সংলাপ হতে হবে—প্রধান রাজনৈতিক দল দুটোর শীর্ষ নেতৃত্ব ও অন্যসব প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ-নেতাদের মাঝে। লক্ষ্যটা আগে থেকেই পরিষ্কার করে রাখতে হবে, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে একটা প্রকৃত নির্বাচন-সহায়ক সরকার বাস্তবায়ন, নির্বাচনকালীন তিন মাসের জন্য। তা না হলে উভয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের মধ্যে একে অপরকে ‘ভয়’ পাওয়া ও এড়িয়ে চলার পরিস্থিতির অবসান ঘটবে না। সেটা হবে খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুকরণের ‘ইতিবাচক’ কিছুই তাতে হবে না, আমরা সবাই সেই অবস্থার বিরুদ্ধে, সেই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হবেই হবে।

 

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর