বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্মরণ

বেগম ও বেগম ক্লাব

দিল মনোয়ার মনু

বেগম ও বেগম ক্লাব

বাঙালি সমাজে সে এক অন্ধকার যুগ। অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারে যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি যখন অবজ্ঞাত; বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন নানাবিধ বাধা-নিষেধের বেড়াজালে নিমজ্জিত, সে সময়ে একজন অখ্যাত অজ্ঞাত যুবক একমাত্র দৃঢ় মনোবল এবং সাহসকে পুঁজি করে সেই সময়ে আধুনিক সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রবেশ করে দৃপ্ত পদভারে চারদিক প্রকম্পিত করতে পেরেছিলেন, তার নাম মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন।

যিনি পরবর্তী সময়ে সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন নামে দুই বাংলায় দারুণ প্রশংসিত, জনপ্রিয় এবং নন্দিত হয়েছিলেন এবং একজন কিংবদন্তি সম্পাদক হিসেবে যিনি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাদৃত। এই অসাধারণ ব্যক্তিসম্পন্ন মানুষটির লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকার প্রকাশ এবং তারই ধারাবাহিকতায় মহিলাদের জন্য জননন্দিত জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বেগম’-এর আত্মপ্রকাশ।

এই সংবেদনশীল মানবিক মানুষটির জন্ম ১২৯৫-এর ৩ অগ্রহায়ণ, চাঁদপুরের পাইকারদি নামের এক রক্ষণশীল গৃহস্থ পরিবারে। বাবা ধর্মপ্রাণ ছিলেন কিন্তু গোঁড়া ছিলেন না। বাংলা জানতেন এবং বাংলা ভাষার অনুরাগী ছিলেন। তিনি গ্রাম্য ভাষায় কবিতা রচনা করতেন এবং পুঁথির সুরে তা জনমহলে পাঠ করে শোনাতেন। তিনি তাই ছেলেকে প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষা এবং পরবর্তী সময়ে বাংলা শিক্ষার জন্য গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে চন্দ্রকুমার পাল পণ্ডিত মশাইয়ের পাঠশালায় ভর্তি করান। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তার বাংলা, ইংরেজি পত্রপত্রিকা পড়া ও ছবি দেখার প্রবল আগ্রহ জন্মে। কিন্তু অনতিদূরেও কোনো লাইব্রেরি না থাকায় পত্রপত্রিকা দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। বিদ্যালয়ে এক বিত্তশালী পরিবারের ছেলে কলকাতা থেকে পত্রপত্রিকা আনার সুযোগ পেত। নাসিরউদ্দিন ওর কাছে পত্রিকা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে ছেলেটি সেদিন বিরক্তভরা কণ্ঠে বলেছিল—তোদের মুসলমানদের তো কোনো পত্রিকা নেই—আমাদের পত্রিকা দেখতে চাস কেন? সেই থেকে নাসিরউদ্দিন মুসলমান সম্পাদিত এবং মুসলমান লেখক তৈরির জন্য একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করার সুবাদে জমানো কিছু টাকা এবং প্রচণ্ড সাহস ও আন্তরিকতা নিয়ে এই স্বপ্ন পূরণের কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। তারই ফলশ্রুতিতে প্রথমে সওগাত এবং পরে বেগম পত্রিকার প্রকাশ সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে পাঠক সমাজকে চমত্কৃত করে। সেই অজ্ঞানতা অন্ধকার যুগে মহিলাদের জন্য প্রগতিমুখী বেগম পত্রিকা প্রকাশ ছিল অকল্পনীয় এবং দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেই কাজটি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তিনি এই চিন্তাকে মাথায় রেখে আগে থেকেই সওগাতের মাধ্যমে বেশ কিছু সম্ভাবনাময় মহিলাকে সাহিত্য চর্চায় নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে এদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বেগম পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কাজটি প্রথম দিকে দুঃসাধ্য ছিল লক্ষ্য ঠিক রেখে সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে এবং নিপুণ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে বেগম পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। ধীরে বেগম পত্রিকাকে কেন্দ্র করে লেখিকা ও সমাজ কর্মীদের প্রতিশ্রুতিশীল গোষ্ঠী তৈরি হতে থাকে। তৈরি করলেনও একটি জাগরণমূলক সমাজ সচেতন পরিবেশ।

প্রথম দিকে নারী লেখক সংকট থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা কাটতে শুরু করে এবং শুধু লেখকই নন, বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং গুণীজনরাও পাশে এসে দাঁড়ান। কলকাতা থাককালীন বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আমাদের সবার জননী সাহসিকা, শতাব্দীর বিবেক কবি সুফিয়া কামাল।

বেগম পত্রিকার প্রকাশ লগ্নে মহিলা লেখকরা তাদের বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেছিলেন এই পত্রিকা তাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে এক যুগান্তর পরিবর্তন আনবে। কারণ এর নেপথ্যে রয়েছেন এক উদার, সাহসী, সত্যান্বেষী সম্পাদক যার নাম মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। যিনি সচিত্র সাপ্তাহিক মহিলা সংখ্যা সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করে শুধু নারী লেখক তৈরিই নয়, সমাজ বদলের ক্ষেত্রে সৈনিকের ভূমিকা রেখে সেই অন্ধ সময়ে হয়েছিলেন ব্যাপকভাবে নন্দিত। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সে সময়ের সব উল্লেখযোগ্য হিন্দু ও মুসলমান লেখক, সমাজ সংস্কারক, সমাজবিদরা তাকে পরিপূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করেছেন। বেগম প্রকাশ লগ্নে যারা শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি সুফিয়া কামাল, শামসুন্নাহার মাহমুদ, জোবেদা খাতুন, নন্দিতা মজুমদার, প্রতিভা গাঙ্গুলী, মরিয়ম রশীদ, মর্জিনা করিম, সৈয়দা মোতাহেরা বানুসহ অনেকে।

দেশ ভাগের পর সাপ্তাহিক বেগম ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। লেখিকাদের অধিকাংশই তখন ঢাকায় ফিরতে শুরু করেন। সম্পাদিকা নূরজাহান বেগমের সম্পাদনায় ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বরের ঢাকায় সাপ্তাহিক বেগমের চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ঘটে। সেই থেকে আজ অবধি ঢাকায় বেগমের নিয়মিত পথচলা। ছয় দশক তার সম্পাদনায় বেগম পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুর পরও পত্রিকাটির প্রকাশ নিয়মিত না হলেও অব্যাহত আছে।

লেখক : সাংবাদিক ও নারী অধিকার কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর