শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

হজযাত্রীদের যা জানা জরুরি

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

হজযাত্রীদের যা জানা জরুরি

আলেম-ওলামারা হজের সফরকে আখিরাতের সফরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ মানুষ যখন হজের উদ্দেশে আপন ঘরবাড়ি থেকে বের হয় তখন আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি, বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে যেন পরকালের সফরে বের হয়। মৃত্যুর সময় যেমন বাড়িঘর, দোকানপাট সবকিছু ত্যাগ করতে হয়, অনুরূপ হজের সময়ও এ-জাতীয় সব ছেড়ে বের হতে হয়। হজের সফরের যানবাহন, একজন হাজীকে খাটে সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরা সাদা কাপড় হাজীর মনে কাফনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইহরামের পর ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ কিয়ামতের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সমতুল্য। বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করা আরশে আজিমের চারদিক তাওয়াফ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের ‘সাই’ করা হাশরের ময়দানে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার নামান্তর। সেদিন মানুষ দিশাহারা হয়ে নবীদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করবে। অনুরূপভাবে হাজীরাও সাফা ও মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করেন। আরাফার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান হাশরের ময়দানের নমুনার কথা বলে দেয়। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দানে। এক কথায়, হজের প্রতিটি আমল থেকেই আখিরাতের সফরের চিত্র ভেসে ওঠে একজন হাজীর সামনে। প্রিয় পাঠক! এ হজ একটি ফরজ ইবাদত। প্রতিটি ইবাদতের মতো হজ নামক ইবাদতেরও প্রয়োজনীয় বিষয়াদি জানা থাকা প্রত্যেক হাজীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। না জেনে কোনো ইবাদত করলে যেমন শুদ্ধভাবে হয় না, তেমনি হজ ও ওমরার প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল জানা না থাকলে হজ সহিভাবে আদায় হয় না। ফতোয়ায়ে শামিতে উল্লেখ করা হয়েছে হজের প্রকৃত ফরজ মোট তিনটি। এক. ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ হজের নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করা। যা হজের জন্য শর্ত। দুই. আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। যা হজের শ্রেষ্ঠতম রুকন। তিন. তাওয়াফে জিয়ারত করা। এটিও হজের রুকন। যদি এ তিনটি ফরজের কোনো একটি বাদ পড়ে যায় তবে হজ সহি হবে না এবং দম বা কোরবানি দ্বারাও এর ক্ষতিপূরণ হবে না। এ তিনটি ফরজ ধারাবাহিকভাবে আদায় করা এবং প্রতিটি ফরজ তার নির্দিষ্ট স্থান এবং নির্ধারিত নিয়মে আদায় করা ওয়াজিব। আরাফায় অবস্থানের আগে স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত থাকাও ওয়াজিব। আর হজের ওয়াজিব মূলত ছয়টি। এক. মুজদালিফায় অবস্থান করা। দুই. সাফা-মারওয়ায় সাই করা। তিন. রমি তথা কঙ্কর নিক্ষেপ। চার. হজে কিরান বা হজে তামাত্তু পালনকারীর জন্য দমে শোকর বা হজের কোরবানি করা। পাঁচ. মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছাঁটা। ছয়. মিকাতের বাইরের লোকদের বিদায়ী তাওয়াফ করা। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি : প্রথম খণ্ড)। ফতোয়ায়ে শামিতে রয়েছে, হজের ওয়াজিবসমূহের মধ্যে যদি কোনো একটি ভুলে বাদ পড়ে যায় তবুও হজ আদায় হয়ে যাবে। তবে এ অবস্থায় তার দম দেওয়া ওয়াজিব হবে। আর হজের অনেক সুন্নাত রয়েছে। নিচে ১০টি সুন্নাত পেশ করা হলো। এক. মিকাতের বাইরে অবস্থানকারীদের মধ্যে যারা ইফরাদ বা কিরান হজ করেন, তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম করা। দুই. তাওয়াফে কুদুমে রমল করা। অর্থাৎ বীরের ন্যায় চলা। যদি এ তাওয়াফে রমল না করে তবে তাওয়াফে জিয়ারত বা বিদায়ী তাওয়াফে রমল করা। তিন. সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সবুজ বাতির মাঝখানে দ্রুতগতিতে চলা। চার. ইমামের জন্য তিন জায়গায় খুতবা প্রদান করা। ৭ জিলহজ হারাম শরিফে, ৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে, ১১ জিলহজ মিনায়। পাঁচ. ৮ জিলহজ বাদ ফজর মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অর্থাৎ জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা এবং ৯ জিলহজ ফজর আদায় করা। (তবে ভিড় ও অন্য কোনো ওজরের কারণে ফজরের আগে রওনা দেওয়াও জায়েজ। ছয়. ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার উদ্দেশে রওনা হওয়া। তবে ভিড় এড়ানোর জন্য বা অন্য কোনো ওজরের কারণে ফজরের আগে রওনা দেওয়াও জায়েজ। সাত. আরাফার ময়দানে গোসল করা। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো পানির পরিমাণ বুঝে গোসল করতে হবে। অনেকে প্রচুর পানি ব্যয় করে গোসল করেন। ফলে পানি শেষ হয়ে যায় এবং অন্য হাজীদের কষ্টের কারণ হয়। এখানে আরও লক্ষ্য রাখতে হবে, ইহরামের কাপড় সাদা হওয়ার কারণে গোসলের পানি শরীরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর বিশেষ করে নাভির নিম্নদেশ দেখা যায়। তাই ইহরামের ওপর অন্য কোনো কাপড় বা গামছা দিয়ে গোসল করা ভালো। আট. আরাফার থেকে সূর্যাস্তের পরপর রওনা হওয়া। নয়. ৯ জিলহজ আরাফা থেকে মুজদালিফায় এসে রাত যাপন করা। উল্লেখ্য, মুজদালিফায় সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যোদয়ের মধ্যে কিছুক্ষণ অবস্থান করা। আর সুবহে সাদিকের আগে অবস্থান করা সুন্নাত। দশ. মিনায় অবস্থানের দিনগুলোয় রাতযাপনও মিনায় করা। এ ছাড়া আরও অনেক সুন্নাত রয়েছে। বিস্তারিত ওলামায়ে-কিরামদের থেকে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। অনুরূপভাবে হজের সফরের কিছু আদব বা মুস্তাহাব রয়েছে; যা প্রত্যেক হাজীর জন্য স্মরণ রাখা চাই। নিচে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো। এক. খালিস নিয়ত করা। দুই. হজের সফরে বের হওয়ার আগে নিজের ওপর যাবতীয় ফরজ পরিশোধ করা। তিন. খাঁটি মনে তাওয়াফ করা। চার. অহংকার না করা। পাঁচ. হালাল মাল দ্বারা হজ করা বা করানো। ছয়. উত্তম সফরসঙ্গী নির্বাচন করা। সাত. পরিবারের যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা করে সফর শুরু করা। আট. পবিত্র অবস্থায় হজের উদ্দেশে রওনা হওয়া। নয়. তাকওয়া ও পরহেজগারি অবলম্বন করা। দশ. আল্লাহর বেশি বেশি জিকির করা। এগারো. রাগ ও ক্রোধ দমন করা। বারো. অযথা কথাবার্তা পরিহার করে শান্ত থাকা। তেরো. হজের সফরে ব্যবসা- বাণিজ্য না করা। চৌদ্দ. হজের সফরের আসবাবপত্র কেনার সময় দরকষাকষি না করা। পনেরো. বৃহস্পতিবার বাড়ি থেকে রওনা হওয়া। ষোল. সফরের আগে পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করা। সতেরো. বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া। আঠারো. হজের সফরে গমনের আগে বিজ্ঞ কোনো আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা। উনিশ. হজের মাসলা শিক্ষা করে নেওয়া। বিশ. হজ ও ওমরার সফর বরকতময় সফর। তাই এ সফরের যাবতীয় আদব আমল করা।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর