আমাদের দেশের রাজনৈতিক অসুস্থতার মধ্যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও সেই দলের রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে বিশেষ বিশেষ নেতা-নেত্রীকে টার্গেট করে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও চরিত্র হননের চেষ্টা চালানো হয়। সম্প্রতি এটা অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণ, রাজনীতি এখন আর আদর্শবাদিতার আকর্ষণীয় স্থানে নেই, রাজনীতি হয়ে গেছে সম্পূর্ণ ভোগবাদী। আগে মানুষ উচ্চশিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ও শিক্ষকতাসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত থেকে সৎ পথে উপার্জিত অর্থে জায়গা-জমি, বাড়ি, গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করতেন, কিছু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করে, শিল্প-কারখানা স্থাপন করেও বিত্ত-বৈভব গড়েছেন। ভোগ-বিলাসের জন্য বিত্ত-বৈভব ও অগাধ ধন-সম্পদ টাকা-পয়সার মালিক হওয়ার জন্য এখন কষ্টের কোনো পেশার দরকার নেই, এ জন্য রাজনীতি এখন মোক্ষম অবলম্বন। বিভিন্ন বড় দলের চালকের আসনে উপরে-নিচে যারা বসে আছেন তাদের অনেকের ‘আমলনামা’ পর্যালোচনা করলে বিষয়টা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। রাজনীতি তাই এখন আর সাধারণ মানুষকে তেমন আকর্ষণ করে না। তারপরও রাজনীতি আছে, রাজনীতি থাকবে। বাংলাদেশ আজকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি দৃষ্টান্ত অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না। জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্থান অনন্য। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, স্ট্যানলি এ কোচানেকের মতে, ‘বাংলাদেশে’ একটি অসাধারণ ‘সমরূপ জনগোষ্ঠী রয়েছে’। ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় যেসব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, সেসব দেশেও সাধারণত এত জনগোষ্ঠী দেখা যায় না। জাতিগতভাবে ৯৮.৭% লোক অভিন্ন। প্রায় ৯০% জনগোষ্ঠী একই ধর্মে বিশ্বাস করে। কমপক্ষে ৯৮% লোক বাংলায় কথা বলে। এসব বন্ধন সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। (তথ্যসূত্র : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের গ্রন্থ ‘অবাক বাংলাদেশ’ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি)। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তা অর্জন করতে পারিনি। কেন পারিনি সে কারণ খুঁজতে কারও গবেষণা করার প্রয়োজন নেই। আদর্শ ও জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করলে রাজনীতিবিদরা দেশের কথা ভেবেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতেন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নানা ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের সীমাহীন ব্যর্থতার পরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘ভিক্ষার ঝুড়ি’। দুজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন ‘উন্নয়নের অগ্নিপরীক্ষা’ নামে। তাদের বক্তব্য ছিল যে, বাংলাদেশের মতো দুর্দশাগ্রস্ত দেশে যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় তবে পৃথিবীর যে কোনো দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনীতিবিদদের সব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। ১. জন্মলগ্নে বাংলাদেশ ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। এখন বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। গত চার দশকের অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে দেশ আজ এ মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। ২. জনসংখ্যা হ্রাস ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ৩. ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে এক কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতো। ২০১৪ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩.৪ কোটি টন। ৪. ১৯৭০ সালে প্রায় ৭০% জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। আজ এ হার ২৪ শতাংশের নিচে। ৫. ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে এক কোটি বেশি ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের ফলে বর্তমানে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক কোটি কম। ৬. শিক্ষার হার বেড়েছে। ৭. শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। ১৯৭০ সালে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২। বর্তমানে এ হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ বছর। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সহনশীলতা আদর্শবাদিতা যদি অটুট থাকত তখন উন্নয়নের বর্তমান চিত্র কোথায় পৌঁছত তা সহজেই অনুমেয়। একটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই আমাদের পরস্পরবিরোধী রাজনীতিবিদদের অসহিষ্ণুতা, একের প্রতি অপরের হিংসা-ঘৃণা, অন্যকে নাজেহাল করার জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি স্বাধীনতার পর দেশের কত ক্ষতি করেছে তা বোঝা যাবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়কালে গড়ে প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে মাত্র দুটি হরতাল পালিত হয়। আঞ্চলিক ও স্থানীয় হরতাল বিবেচনায় নিলে তার পরিমাণ ছিল ৩.৭৫টি হরতাল। আর ২০১১-২০১৫ সময়কালে প্রতিবছর গড়ে ৩৫.৫ দিন জাতীয় পর্যায়ে হরতাল পালিত হয়। আর আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের হরতালসমূহ যোগ করলে এর পরিমাণ ৯৫.৭৫ দিন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের তুলনায় জাতীয় পর্যায়ে ২০০৯-২০১৫ সময়কালে হরতালের পরিমাণ বেড়েছে ১৭৭৫ শতাংশ। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, রাজনীতিবিদরা হরতাল, সহিংসতার মতো তাণ্ডব যদি এই হারে না করতেন আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর বিপ্লব সংগঠিত করতে পারতেন আমাদের দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়ারা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : [email protected]