রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিষ্প্র্রাণের প্রাণসংহার

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নিষ্প্র্রাণের প্রাণসংহার

সুন্দরবনে সংবাদটি পৌঁছায় ভোর পৌনে ৫টাতেই। বিশ্বের সেরা গহিন গরান বনের বন্যপ্রাণী সমাজের সংগঠন ‘বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির’ (বাবাহকু) পর্ষদের প্রেসিডিয়াম প্রধান সুন্দর মিয়া তখন কচিখালীতে বর্ষাকালীন অবকাশ যাপন করছিলেন। বাবাহকুর গৃহপালিত সংবাদ সংস্থা ‘উড়ো বিভ্রান্তিকর সংশয় ও সন্দেহ’  (উবিসস) বাতাস বার্তার মাধ্যমে জানতে পারে যে লোকালয়ের কেন্দ্রস্থলে (খোদ রাজধানী ঢাকার পান্থপথের মাথায়, সার্ক ফোয়ারার সন্নিকটে এবং সোনারগাঁও হোটেলের অদূরে) বাঘের চাপায় পড়ে সেখানকার এক ভ্যানচালক মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে। উবিসস সংবাদটি সরাসরি সুন্দর মিয়াকে না জানিয়ে প্রথমে তথ্য ও প্রচার প্রধান হরিণা হাপানকে জানান। গত কয়েক সপ্তাহে সুন্দরবন, এর ভবিষ্যৎ ও সুন্দরবনের বনেদি বাসিন্দা বাঘ সম্প্রদায় সম্পর্কে বেশ কিছু বিব্রতকর খবরাখবর এদিক-সেদিক থেকে আসছিল। ‘এক বাঘেই মেলে কোটি টাকা’ জাতীয় পিলে চমকানো খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই বনের বাঘ সম্প্রদায়ের বর্ষীয়ান নেতা সুন্দর মিয়া বেশ বিচলিতবোধ করে চলেছেন। বিধান ব্যবস্থা ‘বনে জঙ্গলে’র মুখ্য মাতবর শিয়ালেন্দু মামাইয়াকে একটি জরুরি অধিবেশন ডাকার কথাও ভাবতে বলেছেন তিনি। আগামীকাল শিয়ালেন্দু-সুন্দর মিয়ার মধ্যে বৈঠকের কথা রয়েছে।

এ বছর ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’ উদযাপন করা হয়েছে ঘটা করে। সম্প্রতি সুন্দরবনের বাঘের শুমারও হয়েছে। বংশ গৌরবে গরিয়ান, ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘রয়াল’ খেতাবপ্রাপ্ত বনের রাজা বাঘ সম্প্রদায়ের এ অকাল অপসৃয়মাণ পরিস্থিতিতে বনের অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রাণীকূল বেশ বিচলিত, উৎকণ্ঠিত। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়ে এধারে। সেসময় এধারে সুন্দর মিয়াদের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার আর ওধারে হাজার বারোশর মতো। কপালের এমনই ফের এখন এধারের সংখ্যা ১০৬। ইতিমধ্যে লোকালয়েরই এক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— ‘দস্যুতার পাশাপাশি এখন বাঘ শিকারের দিকে ঝুঁকছে সুন্দরবনের বনদস্যুরা। বাঘের চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার লাভজনক হওয়ায় তারা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের প্রধান টার্গেট এখন বাঘ শিকার। বনদস্যুরা হরিণ বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী শিকার করে তার পেটে এক ধরনের ভারতীয় চেতনানাশক ওষুধ রেখে দেয়। এসব প্রাণী খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে তারা গলায় ফাঁস দিয়ে বাঘকে হত্যা করে চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করে থাকে। আর এক বাঘেই মিলে যায় কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া বনদস্যুদের স্বীকারোক্তিতে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।’ 

বাঘ সম্প্রদায়ের জন্য এ দারুণ দুঃসংবাদে উদ্বেগাকুল বানর গ্রুপের নেতা বানারান বানারা গত পরশু দুবলার চরে এক ঘরোয়া বৈঠকে বলেছেন, ‘এভাবে বাদার একটি প্রধান পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কর্মসূচি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কর্তারা না থাকলে বনে আমরা তো ছাই, কিচ্ছুই থাকবেনানে।’ পাখি সম্প্রদায়ের মুখপাত্র পঙ্খী পুখারা কটকায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদেরকে দেখভাল-যত্নআত্তির কোনো খবর নেই অথচ ক্ষতি করবার বেলায় ষোলআনা— তাইলে আমরা বাঁচি কেমনে! তবে বলে দিই আমরা না বাঁচলি এই বন বাঁচবে না’

পুখারার এ বিবৃতির মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের কোনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল কিনা এ নিয়ে ‘হরিণ ঘাটা ইনস্টিটিউট অব ওয়াইল্ড লাইফ’ একটি গবেষণা চালায়। সেখানকার মুখ্য প্রদায়ক শালিখা শাখালান পাথরঘাটা গবেষণা কেন্দ্র থেকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুখারার বিবৃতিতে প্রতিশোধ নেওয়া কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না’। তবে পুখারা ঠিক যে সন্ধ্যায় এ মন্তব্য করেন সে রাতের শেষভাগে ঢাকার পান্থপথে এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। লোকালয়ে সুন্দর মিয়াদের প্রতি সম্মান ও সমীহ এখনো বেশ উচ্চমাত্রায়। সে কারণে প্রায় দুুই টন মালমসলা দিয়ে যত শক্ত করা যায় এমনভাবে দুটি (মা ও মেয়ে) বাঘমূর্তি বানান হয়, আজকাল একে ভাস্কর্য বলার ফ্যাশন চালু হয়েছে। এটি বসানো হয় ক্রিকেটে সাফল্যের ধারাকে আরও আবেগঘন ও তেজোদীপ্ত করতে। লোকালয়ের নগর কর্তৃপক্ষের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভেবেছিল বাঘটিকে যত ভারী করা যাবে তত এর ভিত্তি ও ভাবমূর্তি শক্ত হবে। কিন্তু এটা উপলব্ধির আওতায় আসেনি যে শুধু ওজনে বা প্রচার বাড়লেই আবেগ বাড়ে না বা কারও সম্মান ভারি বা স্থায়ী হয় না। সুন্দর মিয়াদের সার্বিক উন্নয়ন, তাদের নিরাপদ সাফল্য কামনার ক্ষেত্রে বরাবর অমনোযোগিতা ও উদাসীনতা বহাল রেখে শুধু প্রখ্যাত স্থানে মূর্তি বানিয়ে বিখ্যাতকরণের উদ্যোগ নেওয়া কিংবা বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানে ‘সুন্দরবনের পরিবেশসহ সকল প্রজাতিকে সুরক্ষার সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ মর্মে ঘোষণা যে প্রকারান্তরে নিজেদের আত্মপ্রচারে, প্রসঙ্গ পলায়নী প্রবণতায় এবং আত্মগ্লানি ঘুচানোর এক ধরনের ফাঁকা আয়োজন তা তো বোঝাই যায়। উদ্দেশ্য বিধেয়ের এ বিপুল বৈপরীত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর জন্য নিষ্প্র্রাণ বাঘটিকে প্রাণঘাতকে পরিণত হতে হয়েছে বলে মনে করেন সুন্দরবনের অন্যতম চিন্তা চৌবাচ্চা ‘চতুরঙ্গ চত্বর’।

ভ্যানচালক বাঘটিকেই ঝড় বাদল থেকে নিরাপদ আশ্রয়দাতা ভেবেছিল, ভেবেছিল প্রাকৃতিক এ দুর্যোগকালে এখানে ঘুমানোটা বেশ নিরাপদ হবে। কিন্তু নির্মাণত্রুটি ও ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার বদৌলতে নিষ্প্রাণ বাঘটি বৃষ্টি ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ভ্যানচালকের নিরাপদ ভাবনায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি নিরাপত্তাবোধ ও নিরাপদ ভাবনায় ছন্দ পতনে এ করুণ পরিণতি। সুন্দর মিয়া মর্মস্পর্শী এ ঘটনার কথা শুনে আরও ভেঙে পড়েন। তার স্বজাতির এ ধরনের হন্তাকারক পরিণতি তাদের সুনামে, সুখ্যাতিকে, শৌর্যবীর্যের পরিচয়কে নানানভাবে বিনষ্ট করতে এ ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে কাছের কিংবা দূূরের কোনো ষড়যন্ত্রের সুতা টানা হয়েছে কিনা তা অনুসন্ধানে সুন্দর মিয়া সর্বাগ্রে তার গোপন বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। সুন্দর মিয়া নিরাপত্তা উপদেষ্টা উখারান উখাইয়াকে সঙ্গে সঙ্গে তলব করেন এবং এ বিষয়ে একটা তাত্ক্ষণিক সুরতহাল রিপোর্ট প্রত্যাশা করেন তিনি। উখারান উখাইয়া সুন্দর মিয়াকে জানিয়েছেন বাঘের ভাস্কর্যটি যেখানে তার কাছেই কিছু দিন আগে একটি নির্মীয়মাণ ভবনধসে বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়। ভাস্কর্যটি ভেঙে পড়ার পেছনে ওই ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে। যাই হোক এ ব্যাপারে বাবাহকুর তরফ থেকে একটি উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া পত্র জারি হওয়ার আবশ্যকতা অনুভব করেই প্রধান বিবৃতি মোসাবিদাকারককে মালমসলা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়।

দুপুর দেড়টায় কচিখালিতে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে সুন্দর মিয়া যে বিবৃতি দেন বাবাহকুর নিজস্ব বার্তা সংস্থা উবিসস তা সরাসরি সম্প্রচার করে। বিবৃতি পাঠের পর সুন্দর মিয়া স্পর্শকাতর এ বিষয়ে কোনো মৌখিক মন্তব্য কিংবা প্রশ্নের জবাব দেবেন না বলে বাবাহকুর তথ্য ও প্রচার বিভাগ থেকে আগেই জানানো হয়। বিবৃতিতে সুন্দর মিয়া বলেন, ‘আজ ভোরে লোকালয়ের কেন্দ্রস্থলে আমাদের স্বজাতির একটি নির্মিত ভাস্কর্য ভেঙে পড়ায় তার চাপে আমাদের একজন প্রিয় প্রতিবেশী মারা গেছেন এ সংবাদে আমি ব্যক্তিগতভাবে, বাবাহকু পর্ষদ এবং এর সব সাধারণ সদস্য মর্মাহত। আমরা এতে গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করছি। নিঃসন্দেহে ঘটনাটি দুঃখজনক এবং আমরা অনুতপ্ত। আমরা এর সুবিচারের স্বার্থে সঠিক ও কার্যকর তদন্তের আহ্বান জানাই। এই সুবাদে আমরা স্পষ্ট করতে চাই ওই ভাস্কর্যটি আমাদের একটি প্রতীকী প্রকাশ ছিল এবং সেটি নির্মাণকালে আমাদের কোনো অনুমতি, পরামর্শ এমনকি কোনো কারিগরি সহায়তাও চাওয়া হয়নি। আমাদের সম্মানিত করা হয়েছে বিবেচনায় আমরা এর কোনো প্রতিবাদও জানাইনি। তবে ইদানীং আমাদের আবাস ভূূমির ভবিষ্যৎ ধ্বংস সাধন প্রয়াস প্রচেষ্টার প্রতিবাদ আমরা করেছি। মর্মস্পর্শী এ ঘটনার সূত্র ধরে আমরা আমাদের আরেকটি উপলব্ধির কথা সবিনয়ে জানাতে চাই যে— ভাবনায়, পরিকল্পনায়, সিদ্ধান্তে এবং নির্মাণে-বাস্তবায়নে যারা অন্যায়-অনিয়ম ভুল করেন কিংবা অস্বচ্ছতায় আকীর্ণ হন তার খেসারত ভোগের বেলায় কিন্তু তাদের পাওয়া যায় না, ধরা যায় না। নিরীহ সাধারণেরাই সব সময় প্রতিফল ভোগ করেন।  আবার আমাদের সবার ত্যাগ শিকারের অবদানে যে সাফল্য সুনাম অর্জিত হয় তার কৃতিত্বের দাবিদার সাজেন অসাধারণরা, এমনকি সাফল্যের ভাগ বাটোয়ারাতেও থাকেন তারা।’  সুন্দরবন সুরক্ষাকল্পে প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার প্রতি যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতির উপান্তে সুন্দর মিয়া কামনা করেন এ দুর্ঘটনা থেকে সবার আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হোক, শাণিত হোক।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর]

সর্বশেষ খবর