রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

তাদের কাছে নির্বাচন নীতি না কৌশল?

মোশাররফ হোসেন মুসা

তাদের কাছে নির্বাচন নীতি না কৌশল?

মনীষীরা বলেছেন, নির্বাচন হলো সেই ব্যবস্থা যা প্রয়োগ করে জনগণ মর্যাদাবান হয়। কিন্তু শুধু নির্বাচন দিয়েই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। আবার নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে বাধ্য। সে জন্য গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা নির্বাচনকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এ দেশের রাজনীতিবিদরা এখনো নির্বাচনকে ‘নীতি’ হিসেবে গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। অধিকাংশ দলই নির্বাচনকে ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতায় থাকার ‘কৌশল’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সে কারণে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বহু আগেই এ দেশের নির্বাচনকে ‘একদিনের গণতন্ত্র’ নামে আখ্যা দিয়েছেন।  আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করেছে। বিএনপির তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে তারা নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। বিএনপির পক্ষের ইসলামপন্থি দলগুলোও প্রার্থী বাছাইয়ে মনোযোগ দিয়েছে। সরকারি মহল থেকে আশা করা হচ্ছে, ‘বিএনপি এবারকার নির্বাচন বয়কট করবে না। বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাবে।’ বিএনপি পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া ‘কৌশলগত’ ভুল ছিল। তাদের কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘সরকার বিএনপি’কে নির্বাচনী ফাঁদে আটকাতে চাচ্ছে।’ আওয়ামী লীগের পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা বহু আগে থেকেই বলে আসছেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনপন্থি দল। দলটি প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নীতির কারণে।’ বিএনপি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বলে আসছে, ‘তারা বুলেটে নয়, ব্যালটে ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাসী।’ অর্থাৎ উভয় দলই প্রকাশ্যে নিজেদের গণতন্ত্রপন্থি দল হিসেবে দাবি করলেও উভয় দলই নির্বাচনকে ‘কৌশল’ হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু কেন যে তারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলো তা এখন গবেষণার বিষয়। সম্ভবত এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান, তা হলো—দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসন ও পশ্চাৎপদ ধর্মীয় সংস্কৃতি। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় সহিংসপন্থিদের যুক্তি ছিল, ‘এ দেশে ব্রিটিশরা এসেছে অস্ত্রের মাধ্যমে। সে জন্য তাদের তাড়াতে হবে অস্ত্র দিয়ে।’ কিন্তু মহাত্মা গান্ধী কট্টরপন্থিদের নির্বাচনবিরোধী পরামর্শ উপেক্ষা করে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নির্বাচনে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে তার নির্বাচনী ‘কৌশল’ সঠিক ছিল। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। সে সময় বামপন্থিরা বলা শুরু করে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও একটি অংশ ’৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করে সশস্ত্র যুদ্ধের পক্ষে মত দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা অগ্রাহ্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে ন্যাপ (ভাসানী)সহ বামপন্থিরা নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথ সুগম হয়। সেই নির্বাচনের পথ ধরে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সে জন্য বুদ্ধিজীবীরা বহুবার স্বীকার করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনে যাওয়ার কৌশলটি সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত ছিল।’ আশা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। কিন্তু তৎকালীন শাসকরা সেদিকে না গিয়ে দেশকে কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকে নিয়ে যান। ’৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বহু অভিযোগ রয়েছে। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশ আবার পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে যাত্রা শুরু করে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে কোনো নির্বাচন দেননি। আওয়ামী লীগও ’৭৯ ও ’৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে দেখা যায়, দুটি দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের পরাজয় মেনে না নেওয়ার পেছনে রয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি না থাকা (কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে আগাম নির্বাচন দিয়েছিলেন দলকে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য। এটাকেও এক ধরনের কৌশল বলা যায়। তবে এই কৌশল গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে নয়। আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও মাঝেমধ্যে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে তারা পরাজয় মেনে নেন। যেমন— আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আল-গোর বুশের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ এনেও কোর্টে আইনি যুদ্ধ চালিয়ে যাননি)। অন্যদিকে এ দেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত হতাশাজনক। তাদের ইতিহাস প্রহসনমূলক ঘটনায় ভরপুর। তারা এ দেশে বসবাস করলেও আত্মপরিচয় খোঁজেন মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুরস্কের খেলাফত পুনরুদ্ধারের দাবি তোলে, পাকিস্তান আন্দোলনের সময় দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ’৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। মওদুদীর একটি বইয়ের মুখবন্ধে লেখা আছে— ‘একটি মুসলমান প্রধান দেশে আধা মুসলমান, আধা ইমান-আকিদা সম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেশি থাকে। তাদের ভোটে কখনো খাঁটি মুসলমান নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারবে না। সে জন্য বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে হবে।’ বামপন্থিরাও অনুরূপ কথা বলেন। তাদের মতে— ‘একটি দেশে শ্রমিক শ্রেণির চেতনাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা খুবই কম থাকে। তাদের ভোটে কখনো একজন খাঁটি সমাজতন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারে না। সে জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন।’ বিতর্কিত চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত তার এনজিও ‘উবিনীগ’ (আরশি নগর-২) কার্যালয়ে এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন, ‘৭০ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী না গিয়ে যে ভুল করেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে সেই ভুল করেছেন। আবার এ দলটি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে একই ভুল করবে।’ অর্থাৎ তার মতো অন্ধ মতাদর্শীরা চান বিএনপি একটি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাক। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপির নেতৃত্ব পর্যায়ে তার মতো বিপ্লবপন্থি লোকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু গণতন্ত্র শুধু মুখে প্রচারের বিষয় নয়, এটি অন্তরে ধারণ করার বিষয় এবং সর্বক্ষেত্রে চর্চার বিষয়।  আগামী সংসদ নির্বাচনে বড় দল দুটি সেই মানসিকতা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি?    

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর