অনেক বছর আগে থেকেই ইচ্ছেটা পুষে রেখেছি। ইলোরা অজন্তা দেখবো। ভারতের দর্শনীয় অনেক কিছুই দেখা হয়েছে, আবার অনেক কিছু দেখা হয়নি। ভারতে চলাফেরা করাটা আমার জন্য সহজ নয়। দেহরক্ষী থাকতে হয়। কোথায় যাবো তা আগে থেকে কাউকে জানানো চলবে না। হুট করেই যেতে হবে। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করলে বক্তার লিস্টে আমার নাম থাকা চলবে না, আচমকা মঞ্চে উপস্থিত হতে হবে। বক্তৃতার পর দ্রুত ওই এলাকা ছাড়তে হবে। এসব যে এখানে আমাকে বলা হয় করতে তা নয়, আমি নিজেই করি। দীর্ঘদিন ইউরোপের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে নিরাপত্তা কী করে দিতে হয় তা কিছুটা জেনেছি। ইউরোপের সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তার তুলনা করা যায় না। এখানে সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী দেওয়া হয় আমাকে, বাকিটা, কোথায় যাবো, কখন যাবো, কতক্ষণ থাকবো বা থাকা উচিত— এসব সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিই। ২০০৭-এর পর থেকে এমন অবস্থা। তার আগে তো কোথাও কোনও অনুষ্ঠানে আমি গেলে তার খবর হতো, বিজ্ঞাপন হতো, তারপর যেতাম, কোনও দিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। দুর্ঘটনা একবার ঘটতে শুরু করলে ঘটতেই থাকে। এক রাজ্যে ঘটলে আরেক রাজ্যে ঘটে। এ অনেকটা কলেরা বা ম্যালেরিয়ার মতো, অথবা হালের ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো সংক্রামক। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে থেমে থাকে না।
অন্য দেশের মতোই ভারতবর্ষের কোথাও আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমার জন্য নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়। কিন্তু কোথাও যদি আমি বেড়াতে যেতে চাই? তাহলে কোনও তো সংগঠক নেই যে আমার নিরাপত্তার জন্য রাজ্যসরকারের কাছে নিরাপত্তা রক্ষী চাইবে! সেক্ষেত্রে ব্যবস্থাটা আমাকেই করতে হবে। যাতায়াতের টিকিট কিনতে হবে। হোটেল বুক করতে হবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের আমার সবকিছু, কবে কখন পৌঁছবো, কদিন থাকবো, কোথায় থাকবো, কোথায় যাবো, কবে ফিরবো, জানাতে হবে।
কাকপক্ষী যেন না জানে এমন করে ইলোরা-অজন্তা ভ্রমণের জন্য যা কিছু করতে হয় করেছিলাম। হোটেল বুক করেছিলাম ভ্রমণসঙ্গীর নামে, টিকিটও তার নামে, কিন্তু নিজের নাম ছাড়া ভ্রমণ করা যায় না বলে অগত্যা নিজের নাম দিতে হয়েছিলো সঙ্গী হিসেবে। চার-পাঁচ দিন আগেই বিমানের টিকিট, হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র দিল্লির নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে দিয়েছিলাম। ওরা ওদের অফিসের ‘ফাংশান ব্রাঞ্চ’-এ দিয়ে দিয়েছে আমার আবেদনপত্র। ফাংশান ব্রাঞ্চ থেকে আমাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে দিল্লি থেকে বার্তা পৌঁছে গিয়েছে মহারাষ্ট্রে, মহারাষ্ট্রের নিরাপত্তা পুলিশ আমার পাশে থাকবে। নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতে আমার ইচ্ছে হয় না, কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় নেই। খুব অসহায় আমি। কিন্তু ভুলে থাকার চেষ্টা করি আমি অসহায়। কঠিন বাস্তবকে মেনে নিতে বাধ্য হই।২৯ তারিখে রওনা হলাম আওরঙ্গবাদে। বিমান থেকে নেমেই দেখি পুলিশের ভিড়। আমার ভ্রমণসঙ্গী ছিল কন্যাসম একটি মেয়ে। ওকে বলছিলাম এত পুলিশ আমার ভালো লাগে না, দুজন রক্ষী থাকলেই তো যথেষ্ট। তখনও আমি জানি না, ওরা আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমাকে নিয়ে ব্যাগেজ ক্লেইমে যাচ্ছে না। ওরা আমাকে ওদের অফিসারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। সুটকেস নেওয়া হয়ে গেছে, এবার আমি বাইরে বেরোবো, এমন সময় পথ রোধ করলেন অফিসার। বললেন, ‘শহরের অবস্থা খারাপ। শহরে আপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। হোটেলের সামনে ৫০০ লোক জমা হয়েছে।’
বিস্ময়ের সীমা ছিল না আমার। যে তথ্য দিল্লির পুলিশের কাছ থেকে গোপন বার্তায় মহারাষ্ট্রের পুলিশের কাছে গিয়েছে, সেই তথ্য কট্টরপন্থিদের কাছে গেল কী করে? অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা কি করে জানলো, এ খবর তো পুলিশ ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়?’ অফিসার বললেন, ‘তিনি জানেন না ওরা কি করে জেনেছে।’ আমি বারবারই বিস্ময় প্রকাশ করি, আর অসহায় চোখে তাকাই চারদিকে। গলা বুজে আসে কষ্টে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে কী করতে হবে এখন?’ অফিসার বললেন, ‘আপনাকে ফিরে যেতে হবে’।
‘কখন যাবো? কী করে যাবো?’
অফিসার বললেন, ‘এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট দিল্লি যাবে। ফ্লাইট সকালে’।
‘সকাল পর্যন্ত কী করবো? কোথায় থাকবো?’
‘এয়ারপোর্টে’।
‘একেবারেই বেরোতে পারবো না?’
‘না’।
এরপর অফিসার ভাবলেন কিছুক্ষণ। এয়ার ইন্ডিয়ার একজন লোককে ডাকিয়ে এনে যে ফ্লাইটে আমি দিল্লি থেকে এসেছি, যেটি কিছুক্ষণ পর মুম্বাই যাচ্ছে, ওতেই আমাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। আমাকে ওঁরা দ্রুত নিয়ে গেলেন এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট কাউন্টারে। ওখান থেকে দুটো টিকিট কিনতে হলো মুম্বাই যাওয়ার। টিকিট কাউন্টারের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমার ভ্রমণসঙ্গী মেয়েটি তখন বলছিল, ‘বিক্ষোভকারীরা মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।’ পাশের পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কী কাণ্ড ওদের কেন ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে?’ উনি হেসে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমরা আছি, কিছু হবে না।’
পুলিশদের খুব নিশ্চিন্তই দেখাচ্ছিল। ঘাবড়াচ্ছিলাম আমি। আমাকে এরপর ওরা নিয়ে গেল সিকিউরিটি চেকে। পেছন থেকে প্রায় একশ-দু’শ লোকের চিৎকার, ‘তসলিমা গো ব্যাক, তসলিমা মুর্দাবাদ, নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর।’ আমাকে বিমানে উঠিয়ে দিয়ে পুলিশ চলে গেল। মুম্বাই নামতে আবারও পুলিশ। ওখানে আমাকে লাউঞ্জে বসিয়ে আমি কোথায় যাবো তা জানতে চাওয়া হলো। তবে মুম্বাই শহরে যে বেরোনো চলবে না, তা বলে দেওয়া হলো। আমি নেটে দেখতে লাগলাম কোথাও কোনও অসন্তোষ ছড়িয়েছে কি না। না, কোথাও ছড়ায়নি। স্বস্তি পেলাম। একবার ভেবেছিলাম ইউরোপের কোনও শহরে চলে যাই কিছুদিনের জন্য। পরে ভাবলাম, দেশ যদি শান্ত থাকে, তবে কী দরকার চলে যাওয়ার! পরদিন খবর ছাপা হলো টাইমস অব ইন্ডিয়ায়। সেই খবর লুফে নিয়ে পিটিআই খবর করলো, আগুনের মতো খবরটি ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। এরকম আমি চাইছিলাম না। আমার তো খারাপ অভিজ্ঞতা জীবনে কম নেই। হায়দারাবাদে আমাকে আক্রমণ করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। কলকাতায় ফিরে এলে কোথায় আমার পাশে তখন দাঁড়াবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তা নয় আমাকে গৃহবন্দি করলো। আর ওদিকে কোথায় মানুষ সমবেদনা জানাবে, তা নয় কলকাতায় মৌলবাদীদের মিছিল হলো। কোথায় তখন আমাকে নিরাপত্তা দেবে সরকার, তা নয় আমাকে তাড়ালো রাজ্য থেকে। রাজস্থানে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হলো আমাকে, ওখানে কোথায় আমাকে আশ্রয় দেওয়া হবে, তা নয় ভোর হওয়ার আগে আমাকে বের করে দেয় রাজস্থান সরকার। আমাকে দিল্লিতে ফেলে এলো ওরা, দিল্লি থেকে কোথায় আমাকে কলকাতায় আমার বাড়িতে নিরাপদে ফেরত পাঠানো হবে, তা নয় ক্যান্টনমেন্টের ভিতর নিয়ে গৃহবন্দি করা হলো আমাকে। কয়েক মাস গৃহবন্দি অবস্থায় রেখে আমাকে বাধ্য করা হলো ভারত ত্যাগ করতে। আক্রমণের শিকার হলাম আমি, শাস্তি পেলাম আমি। ওই অভিজ্ঞতা যার আছে, সে তো চাইবে না আবার তার ওপর হামলা হোক, সে তো চাইবে না হামলার কোনও ঘটনা প্রচার হোক কোথাও। সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকারের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন, আওরঙ্গবাদ বিমানবন্দরে কী ঘটেছে তা নিয়ে কথা বলতে চান, না কারও সঙ্গে কথা বলিনি।
এদিকে পত্রপত্রিকায় দেখছি মহারাষ্ট্রের পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হলে ওঁরা একবার বললেন, আমি আওরঙ্গবাদে যাবো এ ব্যাপারে ওঁরা কিছু জানেন না, আবার বললেন, জানেন, দিল্লি থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে সাড়ে ৪টার সময়, আবার বললেন, জানানো হয়ছে বিকেল ৬টায়। আমি জানি না দিল্লির ‘ফাংশান ব্রাঞ্চ’ থেকে ঠিক কবে এবং কখন মহারাষ্ট্রে তথ্য পাঠানো হয়েছে। অনেক সময় যেন ফাঁস না হয়ে যায়, এ কারণে শেষ মুহূর্তে তথ্য পাঠানো হয়। আগে থেকে পাঠাক বা শেষ মুহূর্তে পাঠাক, মৌলবাদীরা কী করে সব জানে, কোন হোটেলে আমি থাকবো, ক’দিন থাকবো, কী নামে বুক করা হয়েছে হোটেল, কোথায় কোথায় যাবো আমি— সব কিছু! নেটে দেখলাম, একপাল উন্মত্ত দাঙ্গাবাজের সামনে মুসলিম কট্টরপন্থি নেতারা যখন ভাষণ দিচ্ছিল, আমার গোপন সব তথ্যই উল্লেখ করছিল। আমাকে নাকি বুঝিয়ে দেবে অজন্তা আর ইলোরার গুহা কাকে বলে, এও বলেছে পুলিশকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে আমাকে আওরঙ্গবাদে ঢুকতে না দেওয়ার ব্যবস্থা ওরা করেছে।
অবাক হই, মুসলমানেরা কি জানে না তাদের শত্রু আসলে কে এবং কারা? এই যে গোরক্ষকরা কদিন পর পর মুসলমানদের প্রাণে মেরে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে তো দেখি না! আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কেন? গোরক্ষকদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আমি তো প্রচুর হিন্দুত্ববাদীর বিরাগভাজন হয়েছি! নাকি আমাকে আক্রমণ করা সহজ বলে আক্রমণ করে ওরা? আমার কেউ নেই বলে? কোনও দেশ, কোনও রাজ্য?
কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল আমাকে বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছে। এবার হয়তো বিজেপির দেওয়ার পালা। বিজেপি দেবে না কেন! মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ না করলে তারা ভোট পাবে কী করে! ভোটের চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তা রাজনীতিকদের নেই সে যে রাজনীতিকই হোক। আমাকে কবে যে তাদের শত্রু বানালো মুসলমানেরা! মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণ চাইলে, নারী পুরুষের সমানাধিকার দাবি করলে আমি মুসলমানের শত্রু নই, বরং মুসলমানের বন্ধু। মুসলমানের শত্রুরাই চাইবে মুসলমানদের ধর্মান্ধ বানিয়ে রাখতে। চাইবে মুসলমানেরা যেন অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা আর অন্ধকার আঁকড়ে রাখে জীবনভর। যারা মুসলমানের সত্যিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, তারাই চায় মুসলমানরা শিক্ষিত হোক, সভ্য হোক, আলোকিত হোক, বিজ্ঞানমনস্ক হোক, মানবাধিকারে আর নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী হোক।
আমার কোনও দল নেই, রাজনীতি নেই, আমার কোনও সংগঠন নেই, পাশে ‘বুদ্ধিজীবী’ নেই, বুদ্ধিজীবীরা একেকজন একেকটা রাজনৈতিক দলের সুবিধেবাদী সমর্থক। ভারতে আমার বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ একা, নিজের আদর্শ আর বিশ্বাস সম্বল করে। পায়ের তলায় মাটি আছে? না নেই। তারপরও আছি, ভালোবাসি বলে আছি। এই দেশটি না থাকলে নিজের দেশের মতো দেশ আর কোথায় পাবো?
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।