বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক

ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

বিগত ৭০ বছরে ভারতের ১৩ জন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। রামনাথ কোবিন্দ হলেন চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি। শপথ গ্রহণের পর তিনি বলেছেন তার পূর্বসূরিরা যে পথে চলেছেন, তিনি সে পথেই চলবেন। দীর্ঘ ৭০ বছরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রপতি, দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঐক্য, সংহতির প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, যার ফলে গণতন্ত্রের বিশ্বমানের প্রাতিষ্ঠানিকতাকরণ সম্ভব হয়েছে।

আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে জাতিরাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতা এবং বিদেশি শক্তির প্রভাবে গণতান্ত্রিক সরকার পর্যুদস্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের অগণতান্ত্রিক শক্তি স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয়। ভারত এর ব্যতিক্রম এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছে। সংসদ, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন সুস্থধারায় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রপতি একদিকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। দ্বিতীয়ত সাংবিধানিক মূল নীতিমালাকে ধারণ করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছেন এবং ক্রান্তিকালে সংবিধানসম্মত সঠিক নির্দেশনা দিয়ে গণতন্ত্রকে বিকশিত করেছেন। নিচের পর্যালোচনা থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ১৪ জন যারা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাধা কৃষ্ণান, জাকির হোসাইন, সঞ্জীব রেড্ডি, জ্ঞানজইল সিং, এপিজে আবদুল কালাম, কে আর নারায়ণন, প্রতিভা পাতিল, প্রণব মুখার্জি অন্যতম। ভারত বিভিন্ন ভাষাভাষী, ধর্ম ও বর্ণের দেশ। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিগণ বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন ধর্মের এবং বিভিন্ন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এই পদের ব্যক্তিরা যাতে প্রতিভাবান, অভিজ্ঞ এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা স্থান পায়, সেদিকেই দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা দেখতে পাই, হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মহিলা রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। দলিত সম্প্রদায়ের কে আর নারায়ণনের পরে রামনাথ কোবিন্দ হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। সব অঞ্চলের ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রপতি পদটি অলংকৃত করেছেন। নীতিনির্ধারণে রাজনীতিবিদরা এই পদটিতে অঞ্চল, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে মনোনয়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদটিকে অন্তর্ভুক্তমূলক করেছেন। যা রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য জোরদারে সহায়ক হয়েছে।

গণতান্ত্রিক ধারা মসৃণ এবং সরল পথে চলে না। ভারতের গণতান্ত্রিক বিকাশে অনেক বাধা, বিপত্তি, সমস্যা দেখা গেছে। বিশেষ করে ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতিগণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে গণতন্ত্রকে মজুবত রাখার চেষ্টা করেছেন। আমরা জানি ৪৭ থেকে ৭৭ পর্যন্ত একনাগাড়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেস দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। সেই সময় রাষ্ট্রপতির পদটিকে অনেকেই অলঙ্কারিক ভেবেছেন। যদিও সেই সময় রাজ্য সরকারগুলোর পরিবর্তন এবং বিভিন্ন আইন-প্রণয়নে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। তবে ৭৭ থেকে ৯৯ পর্যন্ত ভারতের দলীয় ও জোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক ভাঙাগড়া হয়। ৯৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনেন।

৭৭ থেকে প্রায় ২০ বছর রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সময় রাষ্ট্রপতিগণ যদি নিরপেক্ষতা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করতেন, তাহলে দ্রুত রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর স্থিতিশীলতা আনয়ন করা কষ্টসাধ্য হতো এবং ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারত। ৭৭ থেকে ৮২ পর্যন্ত সঞ্জীব রেড্ডি ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং জনতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একদিকে যেমন জনতা দলের ভাঙাগড়া এবং সরকার গঠনে ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষভাবে সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পুনরায় ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রেও কোনো প্রতিবন্ধকতার চেষ্টা করেননি, বরং স্বাগত জানিয়েছেন। পরবর্তীতে অন্যান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও একই ধারা অব্যাহত থাকতে দেখি। এপিজে আবদুল কালাম এনডিএর মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০২ সালে শুরু হওয়া তার কার্যকাল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউপিএ সরকার পর্যন্ত চলে। একইভাবে প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হয়েছেন ২০১২ সালে ইউপিএ মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে কিন্তু কার্যকাল চলেছে এবং এনডিএ সরকার পর্যন্ত। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রাধান্য পেয়েছে। জোটের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। তারা ভারতের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছেও সম্মানিত হয়েছেন। দেশকে এবং সরকারি কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।

এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ মনোনীত করেছে দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা এবং বিহারের রাজ্যপাল রামনাথ কোবিন্দকে আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ মনোনীত করেছে দলিত সম্প্রদায়ের কিংবদন্তি জগজীবন রামের কন্যা প্রাক্তন লোকসভার অধ্যক্ষ মীরা কুমারকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রার্থী মনোনয়ন এবং বক্তব্য বিবৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা নীতি ও আদর্শের প্রতিযোগিতা করেছেন। নিচের আলোচনা থেকে তা দৃশ্যমান হবে। রামনাথ কোবিন্দ নির্বাচনের সময় বলেছেন তিনি ভারতের নীতি, আদর্শ এবং সংবিধান মেনে চলবেন। মীরা কুমার বলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তবায়ন এবং জাত-পাত্রের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও রাজনীতি পরিচালিত হোক সেই বিষয়টাকেই প্রাধান্য দেবেন। জাতির উদ্দেশে শেষ ভাষণে প্রণব মুখার্জি বলেন, বহুত্ববাদিতা আর সহনশীলতাই হচ্ছে ভারতের অন্তরাত্মা। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে প্রথমে শক্তিমান নারী ইন্দিরা গান্ধীর কথা স্মরণ করেন। পাশাপাশি বাজপেয়ি ও নরসিমা রাও, এলকে আদভানি ও সোনিয়া গান্ধীকে স্মরণ করেন। বিদায়ী ভাষণে যে কথা বলেছিলেন প্রণব মুখার্জি সেই বহুত্ববাদিতা ও সহনশীলতা ভেসে উঠল নতুন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের বক্তব্য। চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি বললেন দেশের নানা জাতি, নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের বাস। তাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই তার উদ্দেশ্য। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীগণ। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ও সমকালীন বিজ্ঞানকে সঙ্গী করে আমাদের এগোতে হবে। তিনি তার বক্তব্যে রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাধা কৃষ্ণান, এপিজে আবদুল কালাম এবং প্রণব মুখার্জির অবদানকে স্মরণ করেন এবং তাদের দেখানো পথে চলবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বুদ্ধের দেশ ভারত সব সময় শান্তিপূর্ণ পথে চলবে। সকালে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে তার দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, ভারতে বিভেদকামী শক্তি আছে, সাম্প্রদায়িকতা আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনীতির মূল ধারায় বহুত্ববাদিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক সংবিধানের মূল নীতিমালাকে ধারণ করে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের কার্য পরিচালনা করছে এবং নীতি ও আর্দশ বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছে। সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করছে। যার ফলে ভারত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছে। অতীতে দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতাকে অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী রূপ দিয়েছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে। ভারত বিশ্বে আজ বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃত এবং রোড মডেল হিসেবে পরিচিত।

দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম ও ৭১ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নেতৃত্বে ৭২ সালে চার মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয় যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নীতিমালাকে ধারণ করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে। বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি রয়েছে, জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-সন্ত্রাসবাদ রয়েছে। একে মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে, সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা চলছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হচ্ছে। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও নির্বাচন অবাধ ও সুষুম হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এবং স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। আমরা জানি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী আইন ও নীতিমালার অনুরূপ আমাদের কমিশনেরও স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো আইন ও নীতিমালা রয়েছে। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুষুম ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব। গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিতে গেলে সুষুম অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষুম নির্বাচন অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিতে গেলে সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধারণ করে অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষুম নির্বাচন অপরিহার্য। আশা করি আমরা সবাই মিলে এই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও রাষ্ট্রদূত, মুক্তিযোদ্ধা ও বিএলএফের (মুজিব বাহিনী) অন্যতম সংগঠক।

সর্বশেষ খবর