বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নেতা নামধারী অর্বাচীনদের থামাতে হবে

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

নেতা নামধারী অর্বাচীনদের থামাতে হবে

দেশে দৃশ্যত কোনো বিরোধী দল নেই। না সাংসদে না সংসদের বাইরে। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যারা আছেন তারা হিজ মাস্টার্স ভয়েস। সংসদের বাইরে যারা আছেন তারা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি তত্ত্ব ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। সরকারের জন্য এগুলো সুসংবাদ হলেও তাতে স্বস্তি নেই। ঘরের মধ্যে বিভীষণদের দাপট যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে ডুবানোর জন্য বিরোধী দলের প্রয়োজন নেই। তারা নিজেরাই এ জন্য যথেষ্ট। বগুড়ায় শ্রমিক লীগের এক নেতা এক কিশোরীকে ধর্ষণ শুধু নয়, বিচার চাওয়ায় কিশোরী ও তার মায়ের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের মাথার চুল কেটে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে। আল্লাহর আরশ কাঁপানো এ ঘটনার কুশীলবদের শেষ পর্যন্ত জেলে ভরা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইশারায়। বরগুনা সদর উপজেলার ইউএনও গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার আজগুবি মামলা করেছিলেন আওয়ামী লীগের এক হাইব্রিড নেতা। ইউএনওকে তিনি জেলে ভরে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছিলেন।  শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে উল্টো দিকের চাকা সোজা দিকে ঘুরেছ। হাইব্রিডকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ইতিমধ্যে। ইউএনও তারিককে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

ইউএনও শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন তাদের কোমল মনে সৃজনশীলতার বুনিয়াদ গেঁড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। একজন শিশু কত সুন্দর কল্পনা করতে পারে কত নিখুঁত তার হস্ত হতে পারে, সেটার চাইতে বিবেচ্য বিষয় তাদের কোমল হৃদয়ের কল্পনা। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন চশমা ছাড়া, প্রথম দর্শনে এক পলকে ওই বয়সের শিশুর আঁকা ছবি বঙ্গবন্ধু মনে হয় কি না। শিশুরা জীবনের প্রথম বেলায় যে ছবি এঁকেছে তা রীতিমতো উৎসাহব্যঞ্জক।

লজ্জার সঙ্গে বলতে হয়, কিছু নির্লজ্জ দলকানা, নিজের নাম প্রচারের অপকৌশল ও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে দলের বারোটা বাজিয়েছে। এই মামলার বাদী উকিল সাহেব তাদের একজন। গত রাতে একাত্তর টিভির টকশোতে দেখলাম উপস্থাপিকা ও আলোচকরা তার সঙ্গে কথা বলে যে মেসেজ দিয়েছেন তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি মনে হয়। তার কর্মের কিতা কায়দা দেখে মনে হচ্ছে, ভদ্র লোকের অর্থবল, বাহুবল উপরে যোগাযোগের হাত পাকা। তা না হলে প্রতিযোগিতার বাজারে দুটি বড় পদ নিজের কব্জায় নিলেন কী করে। পঞ্চাশজন আইনজীবী একসঙ্গে আদালতে সমাগম করলেন কী করে? জেলা প্রশাসকের নির্লিপ্ততা পুলিশ সুপারের দায়সারা কাজ দেখে মনে হয় তিনি বাঘ-গরু-ছাগল একঘাটে জল খাওয়াতে পেরেছেন। শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা একেক জনের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম। ব্যক্তি তার মতো করে ভক্তি-শ্রদ্ধা হৃদয়ে ধারণ করে। বঙ্গবন্ধুর চিত্র অঙ্কন সম্পর্কে শিশু মনে যে ভয়-ভীতির উদ্রেক করেছে, তা কি কোনো ডাক্তার দ্রুত অপসারণ করতে পারবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি কি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে না কি দলের জন্য অমঙ্গল হয়েছে, না কি সাধারণ মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে। ইউএনওর বিরুদ্ধে এই জিঘাংসামূলক মামলা করে গণমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে তার পক্ষে যেন কেউ আদালতে দাঁড়াতে না পারে, সে বন্দোবস্তও তিনি করেছেন। এটাই কি আইনের শাসন? নিম্ন আদালত কেমন স্বাধীন এই মামলায় তার প্রমাণ দিলেন মুখ্য মহানগর হাকিম তাকে জেলে পুরার নির্দেশ দিয়ে। মনে হয় তিনিও তাদের দাপটে তটস্থ হয়ে এমন বেইনসাফি আদেশ দিয়েছেন। যদি দলীয় বাহিনীর ভয়-ভীতি মনে থাকে তার জন্য ওই পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু, গ্রেফতার, জেল-জরিমানা করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগে। তা এই আইনজীবী জেনেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দলীয় প্রভাবে কার্য সিদ্ধি করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর আঁকা ছবি ব্যবহার ও দ্বিতীয় পাতায় ছাপানোর কারণে বরগুনা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করায় শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব বলেছেন, তার ছেলের নিজের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি পুলিশে ধরার ভয়ে লুকিয়ে রেখেছে। মামলাটি সমগ্র জাতির কোন সেন্টিমেন্টে আঘাত করেছে মামলার বাদী তা কি ঠাহর করতে পেরেছেন। এই অপকর্মটির পরিণতি কি দলে কোনো সুফল দেবে। যে রাজনীতিক একটি নিষ্পাপ কচি মনের শিশু শিল্পীকে সম্মান দিতে জানে না, তার রং-তুলিতে বঙ্গবন্ধুর অবয়ব তুলে ধরার মর্ম বোঝে না, তারা কীসের রাজনীতিক। ছবি হুবহু হতে হবে তাহলে পত্রিকায় যত কার্টুন আঁকা হয় তারা সবাই তো জেলের ঘানি টানত, জেলের ভাত খেত। পুলিশ জনগণের পরম বন্ধু—একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাকে কীভাবে এক বন্ধু পুলিশের এসআই হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তা দেখে আমি শঙ্কিত-উদ্বিগ্ন। ভাবখানা এমন যে, একজন দাগি আসামিকে পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছে।

মামলাটি তাকে পুলিশি হয়রানি, জেল দণ্ড প্রশাসনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এমন কী মামলার সামগ্রিক আয়োজন দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জেলা প্রশাসকও তার পাশে থাকেননি পদ-পদবি হারানোর ভয়ে তিনি পিটটান দিয়েছেন। পুলিশ সুপারও ঢিমেতাল দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বলতে হয়েছে ডিসি ও এসপিকে ব্যাপারটা দেখতে হবে। তাদের আমি দায়ী করব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দলীয় লোকরা কি দেশটা খরিদ করে নিয়েছেন, না পৈতৃক তালুকদারি পেয়েছেন। তারা বাদে সব জনতা কি বানের পানিতে এই দেশে ভেসে এসেছেন। আমাদের প্রশাসন কি ভিন দেশের প্রশাসন, না কি ভিন দেশের রাজনীতিকরা তাদের পরিচালনা করেন। হটকারীদের কাণ্ডজ্ঞান কি আছে। রাজনীতিকদের মর্যাদা তারা নিজেরাই হারিয়েছেন চরম উদ্ধত্য দেখাতে গিয়ে। আইন হাতে তুলে নেওয়া, নিজের সাধ-সাধনা ইচ্ছা পূরণে যা খুশি তাই করা তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। শিক্ষক লাঞ্ছনা করা, সরকারি কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলা, সাধারণ মানুষের গায়ে গুলি ছোড়া, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, ঋণ খেলাপি, অবৈধ মাদক ব্যবসার বিস্তর অভিযোগ সৎ-নির্ভীক-দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের প্রাপ্য সম্মান থেকেও বঞ্চিত করছে।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই ছবি দেখলে বেশি খুশি হতেন, ইউএনওকে বাহবা দিতেন। শিশুদের মমতা মাখানো আদর করতেন। জাতি গঠনে তারিক সালমনের মেধাকে আমি তারিফ করি। ছবিতে তাকে দৃঢ়চেতা ব্যক্তি বলে মনে হলো। পদে থাকা অবস্থায় লোকাল রাজনীতিকদের অনেকের বেআইনি আবদার দাবি নিত্য দিন তাদের পোহাতে হয়। কোনো দাবি মেনে নিতে পারেনি বলে কী এমন নাজেহাল হচ্ছে না তো! তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পায়নি তাই খোঁড়া অভিযোগ তুলে শায়েস্তা করার অছিলা না তো! মেধা বিবেচনায় ইউএনও কারা হয়, উকিল কারা হয় তা সবারই জানা। এভাবে মেধাবীদের হয়রানি কোনোভাবে জাতির মঙ্গল ডেকে আনবে না। বরং প্রশাসন ও রাজনীতিকের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত তফাত বাড়াবে। রাজনীতিকদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘যত্নে রত্ন মিলে’। মামলা করে নেতা হওয়ার খায়েশ ডিজিটাল যুগে অচল পয়সার মতো। অনেক নেতা ঠিকাদারি পেয়ে রডের বদলে বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার জাতিকে শেখালেন। জাতি গঠনের সময় রাজনীতিকরা জাতির সঙ্গে মশকারি ইয়ার্কি করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে না। কিছুদিন আগে ফেনীর পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ওপর আক্রমণ করা হলো। তার কিছু আগে আরও একজন ইউএনওকে নাজেহাল করা হলো। সরকারি কর্তারা ঝুঁকি নিয়ে কী করে প্রশাসন চালাবে। এসব অনাচার দেখার কি কেউ নেই। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে পুনরাবৃত্তি হতো না। টাউট বাটপারদের আয়-রোজগারের প্রধান হাতিয়ার এখন পাইকারি দরে দল বিক্রি করা। নব্বয়ের পর থেকেই রাজনৈতিক টাউটদের এই আস্ফাালন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

১৯৯৬ সালে যশোর জেলা প্রশাসক আবদুল মালেকের এক অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম। প্রশাসনে প্রশ্নাতীত নির্লোভ, সৎ, অসীম সাহসী অফিসার হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি বক্তৃতায় বললেন কী প্রতিকূল অবস্থায় প্রশাসন চালাতে হয়। বিএনপির আমলে তিনি পাবনায় ডিসি থাকা অবস্থায় একটা মামলায় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বসতে রাজি হচ্ছে না বিএনপির ক্যাডারদের ভয়ে। বিএনপির ক্যাডাররা এক ব্যক্তিকে রাম দা দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে চলে যায়। সে মামলায় দলীয় সবাই জোটবদ্ধ হয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ও জোরপূর্বক জামিন দাবি করছিল। ডিসি নিজে কোর্টে বসলেন জামিন নামঞ্জুর করে আসামিকে জেল-হাজতে পাঠালেন। সন্ধ্যায় পিপি ক্রোধের কণ্ঠে টেলিফোনে বললেন, ডিসি সাহেব আপনার সঙ্গে কথা আছে আমি এখন আপনার বাসভবনে আসব। তিনি বিষয়টি এসপিকে বললেন, এসপি বললেন তাদের সঙ্গে বসেন, আমি পুলিশ দিয়ে আপনার বাংলো ঘিরে রেখেছি। পিপিসহ দলীয় নেতারা চার-পাঁচ মাইক্রোবাস ভর্তি ক্যাডার সফরসঙ্গী করে তার ওপর জামিনের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। তিনি অনড় অবস্থানে রইলেন। পরিস্থিতির অবনতি দেখে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিনকে ফোন করে বলেন, স্যার আমরা পারব না, আপনি আপনার দলের লোক দিয়ে প্রশাসন চালান। মন্ত্রী মতিন সাহেব ফোনটি উকিলকে দিতে বললেন। মন্ত্রীর গালি খাওয়ার পর শুড় শুড় করে গোদ গোদ করতে করতে তারা ভবন ত্যাগ করে। সেই সাহস আর সততা দেখিয়ে তিনি সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি। যশোরে ডিসি হয়ে আসার পর এক এমপি মহোদয় অভিযোগ করলেন, তার থানার ইউএনও জামাতি তাকে এখান থেকে বদলি করুন। তিনি জানতে চাইলেন জামাতি কি করে বুঝলেন। এমপি মহোদয় বললেন, মুখে দাড়ি জামাতি ঘরানার লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে। আমি ইউএনও বদলি করি না, আমার দায়িত্বও না। আপনি এমন জামাতিদের একটা তালিকা দেন আমি ঢাকায় বদলির জন্য লিখে পাঠাব। বিধি হলো ঢাকা থেকে ইউএনও বদলি করা। এমপি মহোদয় ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন, আপনার কাছে আমার আইন শিখতে হবে এখন। ছোট্ট একটা বাস্তব ঘটনা তুলে ধরলাম কর্মকর্তা সালমনের মনোবল অটুট রাখার জন্য। নৈতিকভাবে আপনার জয় হয়েছে জাতির বিবেকের কাছে আপনি নির্দোষ। যথাযথ কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা প্রশংসার দাবিদার। আমরা চাইব নেতা নামধারী যে সব অর্বাচীনরা সরকারের  জন্য বিড়ম্বনা ডেকে আনছে— তাদের শক্ত হাতে থামানো হবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর