বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধনবান ক্ষমতাধরদের পুত্রদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় তুমুল জন-প্রতিবাদে তোলপাড় চলার প্রেক্ষাপটে ধর্ষকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে বিচারের উদ্যোগ সফলতার পথে— সেই ঘটনা প্রশংসিত হতে না হতেই বনানীতে আরও এক ক্ষমতাবান তরুণ আরেক তরুণীকে ধর্ষণ করে, সে-ও গ্রেফতার হয়ে বিচারের আওতায়। এ ঘটনা দুটো নগরবাসী তথা দেশবাসীকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। আমাদের পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ তৎপর হতে চেষ্টা করছে নারী-ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাধর ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের দাপট এতটুকু কমেনি। কয়েক দিন আগে বগুড়ায় এক শিক্ষার্থী তরুণী ধর্ষিত হয় তুফান নামে এক শ্রমিক লীগ নেতা কর্তৃক। এক ভয়ঙ্কর অপরাধী এই তুফান ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী শ্রমিক সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের দাপুটে নেতা। শুধু ধর্ষণ করেই সে থেমে থাকেনি। সে ওই ধর্ষিত তরুণী ও তার মাকে তার আখড়ায় তুলে এনে বেদম পিটিয়ে আহত করে এবং তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। কি সীমাহীন বর্বরতা!
তুফান মিয়া যেনতেন নেতা নন, তিনি খুন, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টাসহ ছয়টি গুরুতর অপরাধের মামলার আসামি, কিন্তু টাকা-পয়সা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বেশ বহালতবিয়তে আছেন, তাকে কেউই এতদিন আইনের আওতায় নিতে পারেনি, উল্টো তিনি তার ক্ষমতার দাপটে নিজের স্বজন-অপরাধীদেরও বাঁচিয়ে রেখেছেন আইনে সোপর্দ করার হাত থেকে।
বগুড়া ও অন্যসব জায়গায় এই বজ্জাতির বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ হতে থাকায় পুলিশ তুফান ও তার অপরাধ-সহযোগীদের গ্রেফতার করেছে, বিচার-প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দাপটশালী নেতা মানিকের— যে মানিক ক্ষমতার দর্পে বলেছিল— ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছি, কেউ আমার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি।’ ‘মাণিক’ ধর্ষণের সেঞ্চুরি (শত-ধর্ষণ) করেছিল ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে। ধর্ষক মানিককে সেই সময়কার সরকার একবারের জন্য গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করারও প্রয়োজন বোধ করেনি। শোনা যায়, ধর্ষক-মানিক দেশত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হয়েছে। সময়মতো ধর্ষক মানিকের বিচার হলে আজকে হয়তো ধর্ষণের ঘটনা এত অহরহ ঘটত না, ব্যাপক হারে কমে যেত।বেশ কয়েক বছর আগে পুলিশ যে উত্তরাঞ্চলের ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিল, তুমুল জন-প্রতিবাদ ও জন-প্রতিরোধের মুখে তাদের বিচার হয়েছিল, কয়েকজন শাস্তি পেয়েছিল। কিন্তু তারপর আমরাও দেখতে পেলাম— গাজীপুরে সম্প্রতি এক কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষমতাদর্পী অপরাধীর বিচার না হওয়ায় বাপ-মেয়ে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিয়েছে। কী নিষ্ঠুর সমাজে আমরা বাস করছি!
আমাদের এই দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্দশার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দশা কন্যাশিশু, বিশেষভাবে কিশোরী ও তরুণীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অবশ্য এটা বলা চলে, সামগ্রিকভাবে নারীর নিরাপত্তা এখানে বেশ বাজে অবস্থায়ই রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন এখানে যথেষ্ট হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পুরুষতান্ত্রিক অপব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে চরমে, নারী তাই এখানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক মর্যাদায়ই রয়েছে বাস্তবে। আর পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল চলচ্চিত্র, ইন্টারনেটে ও টেলিভিশনে ছড়ানোর ফলে কিশোর-তরুণদের মাঝে যৌন-বিকার ছড়াচ্ছে ব্যাপকভাবে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা আমরা নিতে ব্যর্থ হচ্ছি নিদারুণভাবে।
পাঠক, আমরা স্মরণ করতে পারি— বছর দেড়েক আগে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের মতো একটি সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে কলেজছাত্রী সংস্কৃতি-কর্মী তনুকে ধর্ষণ ও হত্যার পরে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, কিন্তু সেই বর্বর কাণ্ডটির বিচারের প্রক্রিয়াই শুরু করা যায়নি। এরকম অগুনতি ঘটনা আছে নারী-নির্যাতনের, ধর্ষণের, খুনের— যেগুলো ঘটেছে মূলত নারীর ওপরে যৌন নির্যাতনের লক্ষ্য নিয়ে, কিন্তু পুরুষ ধর্ষক বা ধর্ষক খুনি ক্ষমতাবান হওয়ায় বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতা মানে হচ্ছে অর্থবিত্ত বা রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাতে যে বা যারা বলবান তারা আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায় অকাতরে। আর ইভ টিজিং, মানে কিশোরী মেয়েদের ওপরে মানসিক-পীড়নের এক সীমাহীন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই দেশের পাড়ায়-মহল্লায়, বহু মেয়ের স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার পাঠ চুকে যাচ্ছে এই কিশোরী উত্ত্যক্তকরণের নির্মম ঘটনায়। বাবা-মা, অভিভাবক বাধ্য হচ্ছে এ ধরনের অবিরাম উৎপাতের থেকে বাঁচতে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কিশোরী মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিতে— একেকটি মেয়ের জীবন বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের ব্যবস্থাপনা এখানে খুবই দুর্বল তা তো আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। এখন অসংখ্য পরিবারে কন্যাশিশু, কিশোরী-তরুণী থাকা এক অভিশাপতুল্য বিষয়ে পরিণত।
কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তো কন্যাসন্তানের অধিকারী পরিবার, বাবা-মা বা অভিভাবক নয়, কিশোরীটি বা তরুণীটি নিজে তো নয়ই। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্ষমতার দুর্বলতাই তো এ জন্য প্রধান দায়ী। দায়ী সমাজ— যে সমাজ নারীকে যৌন ভোগসামগ্রী ভাবতে শেখায়, নারীকে সদা-দুর্বল ভেবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করতে শেখায়, নারীকে যৌনতার পণ্য ভাবতে শেখায়। তা না হলে একেবারে নিরেট-মগজ নিরক্ষর কিশোর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অবধি কিশোরী-তরুণী এমনকি বয়স্ক নারীকে অবাধে যৌন নির্যাতন করতে পারত না। আমরা কিছু খবর মিডিয়া-যন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, অগণন ঘটনা মেয়েরা চেপে যায়, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো চেপে রাখে, তথাকথিত ‘সমাজ-শাসনের’ ভয়ে, সমাজে একঘরে হওয়ার আতঙ্কে।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে— কয়েকটি কারণে জনসংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যাল্পতা, তাদের অপর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট, তাদের বেতন-পারিশ্রমিক স্বল্পতা এবং সেসব কারণে ও ‘লোভের’ জন্য তাদের ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়-নেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে পুলিশ বা আনসার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ানো বেশ কঠিন কাজ, তাদের লজিস্টিক-সাপোর্টও সীমিত থাকতে বাধ্য, সীমিত বাজেটের কারণে তাদের বেতন-ভাতা পর্যাপ্তভাবে বাড়ানোও অসম্ভব ব্যাপার। জাতীয় বাজেট প্রতি বছর পর্যাপ্ত হারে বাড়াতে পারলে হয়তো এ সমস্যার একটা সমাধানের বিষয়ে সুরাহা হতে পারে কিছুটা।
তবে সে জন্য বসে থাকলে চলবে না। প্রতিটি পরিবারকে, যাদের নারী-শিশু, কিশোরী বা তরুণী ঘরে আছে তাদের তো বটেই, যাদের নেই, তাদেরও তো বয়স্ক নারী ঘরে আছে, সেই বিবেচনায় বাল্যকাল থেকে প্রতিটি ছেলে-শিশুকে, কিশোরকে, তরুণকে অবিরাম বোঝাতে হবে— নারীর মর্যাদা রক্ষা প্রতিটি পুরুষের আবশ্যিক দায়িত্ব, যৌন-বিকারগ্রস্ততা থেকে বাঁচাতে প্রত্যেক বাবা-মাকে নিজের ছেলে-সন্তানকে অবিরাম কাউন্সিলিং চালাতে হবে, আসলে নিজ-ঘর হচ্ছে কাউন্সিলিংয়ের প্রথম পাঠ নেওয়ার আসল জায়গা।
প্রতিটি পরিবারকে নিজ নিজ কন্যাশিশু, বিশেষভাবে কিশোরী ও তরুণীদের নিরাপদে রাখার জন্য সতর্ক থাকতে হবে সদা। প্রতিটি কিশোরী ও তরুণীকে বোঝাতে হবে— কোটি কোটি নিরক্ষরের এই সমাজে, কোটি কোটি অশিক্ষিত, অসংস্কৃত, যৌন-বিকারগ্রস্ত, যৌন-অপরাধীও কোটি কোটি— এখানে এসব ক্রিমিনালদের লালসার হাত থেকে রেহাই পেতে নিজ নিজ নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে সদা-সতর্ক থাকতে হবে। পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কবে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হবে তাদের দায়িত্ব পালনে সেই ভরসায় বসে থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে— একটি নারী যখন ধর্ষিত হয়, সে যেভাবেই হোক না কেন, তার ধর্ষকটির বিচারে মৃত্যুদণ্ড হলেও তিনি কিন্তু যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পান না— মানসিক পীড়ন থেকে বাঁচতে পারেন না, আমৃত্যু তাকে জ্বালায় ওই নির্মম স্মৃতি। নারী-ধর্ষণের নির্মমতা ওইখানে— নারীকে হত্যার অধিক করা হয় ধর্ষণের মাধ্যমে।
আমাদের দেশে কিশোরী বা তরুণীরা ধর্ষণের শিকার হন নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে। অনেক কিশোরী বা তরুণী ধর্ষিত হন— বাবা-মা বা অভিভাবকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায়। উদাহরণ দেওয়া যাক— বাবা বা মা নিজের কিশোরী মেয়েটিকে বলল— ‘যা, তোর মামাবাড়ি (বা খালার বাড়ি বা ফুফুর বাড়ি) বেড়াতে যা।’ দুই মাইল বা তিন মাইল দূরে মেয়েটি রওনা হয়— পথিমধ্যে অপহূত হয় এবং যথারীতি যৌন বিকারগ্রস্ত এক বা একাধিক ছেলে বা বয়স্ক দুর্বৃত্ত কর্তৃক ধর্ষিত (গণধর্ষিত) হয়। এ ধরনের ঘটনা হরদম ঘটছে, পত্রিকায় এসেছে, আসছে। তারপর কাজিনদের সঙ্গে, দূর-সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে, তথাকথিত প্রেমিকের সঙ্গে, হবু বরের সঙ্গে বেড়াতে পাঠায় অনেক বাবা-মা, তখনো ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যায়— একটু সতর্ক হলেই।
আমাদের পুরো সমাজকে পুরুষতান্ত্রিকতার যৌন-বিকারগ্রস্ততার কবল থেকে মুক্ত করতে পুরুষ সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত সংশোধন করার উদ্যোগ নিতে হবে, সেটা না করা হলে আমাদের প্রত্যেকের, মা বা বোন বা স্ত্রী বা কন্যাটি নিরাপদ নয় এ বিশ্বে। আর তা না করতে পারলে এই দুনিয়া সভ্য পরিগণিত হবে না, ‘দুর্বৃৃৃত্তের গ্রহ’ বলে পরিচিত থাকবে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অবশ্যই নারী-নির্যাতনকারীর, ধর্ষকের কঠোর শাস্তি বিধানের বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই নারীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে চলবে না, তাকে দায়িত্ব নিতেই হবে, মানে সরকারকে অবশ্যই যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে নারী নির্যাতন ও নারী-ধর্ষণ বন্ধে।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক