শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী


বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে

টিভির স্ক্রিন, সংবাদপত্রের পাতা, ফেসবুকের ওয়াল— কোথাও চোখ রাখা যায় না। থেকে থেকে বন্যাকবলিত মানুষের আহাজারি-রোনাজারির স্থিরচিত্র, ভিডিও চিত্র ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আহ! কী দুর্ভোগ মানুষের। কত কষ্ট পানিবন্দী মা-বোন, বাবা-ভাইদের। ছোট ছোট শিশুদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ।  গবাদিপশুগুলো মরে পড়ে আছে এখানে-ওখানে। চাষের জমি তলিয়ে গেছে ফসলসহ। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে প্রবল স্রোতে। বন্যাকবলিত মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এবারের বন্যা বিগত বছরের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মোকাবিলা করা মানুষের সাধ্যাতীত। তাই প্রকৃতির স্রষ্টা আল্লাহর কাছে আমাদের কাতর প্রার্থনা— ‘ওগো দয়াময় খোদা! আমাদের ওপর দয়া করুন। নূহ নবীর উম্মতের মতো আমাদের ওপর প্রলয়ংকরী বন্যা নামক আজাব চাপিয়ে দিয়েন না। আমরা তো আপনারই বান্দা। আপনার প্রিয় হাবিবের গোনাহগার উম্মত। তাঁর উসিলায় সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করুন আমাদের।’

মোনাজাতে বুক ভাসালে আর চোখ ভেজালেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। আমরা যারা এখনো সুস্থ-সুন্দর, শুকনো পরিবেশে আছি, আমাদের ফরজ কাজ হলো— যার যা আছে, যতটুকু আছে, তা নিয়ে, ততটুকু নিয়েই বন্যার্তদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়া। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো ইমানের দাবি। এ দাবিকে উপেক্ষা করলে ধর্মজীবন কলংকিত হবে আমাদের। প্রশ্নবিদ্ধ হবে ইমান-নামাজ-রোজার মতো মৌলিক ইবাদতগুলোর যথার্থতা। আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চর্চা মুসলমানদের চেয়ে বেশি আর কারা দেখিয়েছে? মুহাজিররা যখন সর্বস্ব ত্যাগ করে নিঃস্ব অবস্থায় মদিনায় হিজরত করেন, তখন রসুল (সা.) মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে মুহাজিরদের ‘ধর্ম ভাই’ সম্পর্ক গড়ে দেন। সেদিন মদিনার মুসলমানরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে, ভাইয়ের জন্য ভাই কীভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে। যার যা ছিল তাই নিজের ধর্ম ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সমানভাবে। শুধু কী তাই? যাদের দুজন স্ত্রী ছিল, একজনকে তালাক দিয়ে ধর্ম ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে পর্যন্ত পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই হলো মুসলমান। এই হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এই হলো ‘ইন্নামাল মুমিনুনা ইখওয়াতুন। মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ আয়াতের বাস্তব আমল।

একটি পাঠকনন্দিত পত্রিকার প্রধান শিরোনামে দেখেছি, ‘বন্যাদুর্গতের প্রয়োজন খাদ্য, ত্রাণ পৌঁছেনি এখনো।’ ভিতরের পাতায় পাওয়া যায় আরও নির্মম-নির্দয় সংবাদ। সেখানে বলা হয়, বন্যাকবলিত মানুষের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই ত্রাণ পৌঁছেনি আশ্রয় কেন্দ্র এবং আক্রান্ত এলাকাগুলোতে। বানভাসিরা সংবাদকর্মীদের কাছে অনেকটা ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেই বললেন, ‘কেউ কেউ পঞ্চাশ-ষাট প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসেন। দেখে মনে হয়, বিশাল ব্যানারে ফটোশুট করাই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। ছবি তোলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিতরণ কাজও শেষ হয় তাদের। সত্যিকার ত্রাণ দেওয়ার নিয়তে বা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সর্গীয় অনুভূতি নিয়ে ছুটে আসা মানুষের সংখ্যা দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে আমাদের দেশে। একবার মক্কায় ভয়াবহ দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আবু লাহাব, উতবা-শায়বার মতো নেতৃত্বস্থানীয় কাফেররা পর্যন্ত অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করেছে। তারা খবর পেয়েছে মদিনায় মুহাম্মদের কাছে অপ্রতুল খাদ্যভাণ্ডার আছে। কিন্তু কে যাবে মুহাম্মদের কাছে? কার সাহস আছে মুহাম্মদের সামনে দাঁড়ানোর? কদিন আগেই তো মুহাম্মদকে হত্যার নেশায় মরিয়া ছিল মক্কাবাসী। কোনো রকম পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচে এতিম মুহাম্মাদ। আজ কোন মুখে তার দয়ার ভিখারি হব আমরা? এসব ভাবনা যখন মক্কাবাসীর মনের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে দিল, ঠিক তখনই শুনতে পেল কে যেন ঘোষণা করছে— ‘হে মক্কাবাসী! মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের জন্য অল্প দামে খাবার পাঠিয়েছেন। এসো লুফে নাও। তৃপ্ত হও।’ তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.)-এর সময়ে আরেকবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাধারণ জনগণ এসে বলল, ‘হে মহামান্য সরকার প্রধান! আপনার কাছে প্রচুর খাবার আছে। দয়া করে এগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করুন। আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।’

ওসমান (রা.) বললেন, ‘আমি একজন ব্যবসায়ী। ভালো মুনাফা পাওয়া আমার মূল লক্ষ্য। এখন দুর্ভিক্ষের সময়। লাভবান হওয়ার এটাই সুযোগ। তোমরা কী দশগুণ বেশি মূল্যে খাবার কিনতে আগ্রহী?’ শত শত সাহাবি এবং হাজার হাজার মুসলমান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল খলিফার দিকে। ক্ষোভ আর দুঃখ মিশানো কণ্ঠে তারা বলল, ‘মান্যবর খলিফা! দশগুণ বেশি মূল্যে খাদ্য কেনার সামর্থ্য আমাদের কারোই নেই। যদি মূল্য আরেকটু কমাতে পারেন তবে আমাদের জন্য বড়ই ইহসান হবে।’

মুচকি হেসে খলিফা বললেন, ‘দশগুণ বেশি দাম দেওয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু অসীম ধনভাণ্ডারের মালিক আল্লাহর পক্ষে তো  অসম্ভব নয়। আমি আমার সব খাবার ও পানীয় আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিলাম।’

হে বাংলার সামর্থ্যবান-মুসলমান! এ দুটো ঘটনা থেকে কি আপনাদের কিছুই শেখার নেই? জামানার উসমান থেকে কি সাধ জাগে না আপনাদের? উসমান হওয়ার, আনসার হওয়ার, আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার সুযোগ কিন্তু বার বার আসে না ভাই।  মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মানবদরদি বান্দা হিসেবে কবুল করুন।  কবুল করুন জামানার উসমান, হাজী মহসিন আর হাতেম তায়ী হিসেবে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর