কিছু দিন ধরে যেখানে যার সঙ্গে দেখা হয়, সব কথার মধ্যে একটি কমন প্রশ্ন থাকে— দেশের খবর কী, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? আমি তো চুনোপুঁটি, যারা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত অনেক বেশি লেখালেখি করেন (অধিকাংশ পত্রিকায় লেখার সঙ্গে লেখকের ছবিও ছাপা হয়) এবং যাদের প্রায় সব চ্যানেলেই টকশোতে দেখা যায়, তাদের অবস্থা নিশ্চয়ই আরও কাহিল। অনেক অচেনা লোকের মধ্যেও এ বিষয়ে জানার বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বোঝা যায়, মানুষের মধ্যে এমন একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে যে, জাতীয় রাজনীতি ও দেশের পরিস্থিতি কি জটিল কোনো পথে বাঁক নিচ্ছে? বেশ কিছু দিন সবারই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী তৎপরতার দিকে। বলতেই হবে সেদিক থেকে দৃষ্টি এখন সরে গেছে। দুটি সাম্প্রতিক বিষয় পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে— ১. গত ১ আগস্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়, ২. নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অংশীজনের সংলাপ শেষ হওয়ার আগেই (রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মাত্র সংলাপ শুরু হয়েছে) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নূরুল হুদার কিছু নেতিবাচক সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য। শেষেরটা দিয়েই শুরু করা যাক। এটা শতভাগ সত্য যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা আশাবাদ জাগ্রত হয়েছিল। এমন ধারণাই জন্মেছিল যে, এবার সত্যিকার অর্থেই একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। সবারই স্বীকার করা উচিত যে, এই আশাবাদটি জাগিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে হিংসা-হানাহানির আতঙ্কজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখ ঘুরিয়ে তিনি তা নির্বাচনী সড়কে তুলে দিয়েছিলেন নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সব নেতা-কর্মীর প্রতি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া ও মাঠে নেমে পড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও চমকে দিয়েছিলেন। বিস্ময়ের ঘোর সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলেও। সবার মনেই প্রশ্ন ছিল, এত আগে কেন? এমন একটা ধারণাও তৈরি হয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী হয়তো আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছেন। বিএনপির যে সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশা, এ অবস্থায় তাদের ভালো প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই হয়তো তিনি নির্বাচনটি সেরে ফেলতে চান। এমন কথাও রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর হয়েছিল যে, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন হয়ে যাবে এবং তাতে বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে যেতে পারেন। দুই বছরের বেশি জেল দণ্ড হয়ে গেলে আইনানুযায়ী তিনি শুধু পরবর্তী নির্বাচনই নয়, দণ্ড ভোগের পরও পরবর্তী পাঁচ বছর পার না হলে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সরকারি দল সে সুযোগটি হয়তো নিতে চায়। তারেক রহমান ইতিমধ্যেই একটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হয়ে গেছেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তিনি আপিলও করেননি। বিএনপি নিশ্চয়ই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তাদের নেত্রী ও দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতার রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছে। আগামী নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতির ক্ষতি তারা অবশ্যই বোঝে। বেগম খালেদা জিয়া এখনো বিএনপির ভোট-কারেন্সি। তিনি নির্বাচনী প্রচার অভিযানে নেতৃত্ব দিতে না পারলে দলের ফলাফল বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি কিন্তু আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে নেতিবাচক কোনো ভূমিকা নেয়নি। বরং তারাও তাদের দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে কার্যত নির্বাচনী মিশন নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে বেগম জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০ মাস দুয়েক আগে আবার বিস্তারিত ঘোষণা করা হয়েছে। এই ভিশন-২০৩০কেই বিএনপির আগামী নির্বাচনের খসড়া মেনিফেস্টো হিসেবে বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচার অভিযানে পুরোপুরি নেমেই পড়েছিল। তাদের দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বড় জনসভায় বক্তৃতা করে দলের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোর সফল সমাপ্তির জন্য আবারও তার দলকে সরকার গঠনে সমর্থন করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন করেছেন। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী মিনিস্টার ও শাসক লীগের দায়িত্বশীল নেতারাও দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে নৌকা মার্কায় ভোট চাচ্ছেন। বিএনপিও থেমে ছিল না। তারাও সীমিত সব সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নির্বাচনে দলের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করেছিল। ৬১টি কমিটি করে দল পুনর্গঠনের কর্মসূচির আড়ালে, বিশেষ করে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও পুরনো সদস্যপদ নবায়নের উসিলায় নির্বাচনের প্রস্তুতিই নিচ্ছিল। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় তারা সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু করেছিল। খবর আছে যে, লন্ডন থেকে তারেক রহমান একাধিক গোপন টিমের মাধ্যমে ইচ্ছুক প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করছেন— যে কাজটি অষ্টম সংসদ নির্বাচনেও তিনি করেছিলেন ‘হাওয়া ভবন’ থেকে। তাতে বিএনপি আশাতীত ফলও লাভ করেছিল। কিছু কিছু এলাকায় তিনি নতুন প্রার্থীও ঠিক করছেন বলে শোনা যায়, যাতে অনেক পুরনো নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের কপাল পুড়তে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপির যে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তা নিরসনের প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছে বিএনপি এবং এতে তারা সফলও হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় তারা রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের নির্বাচনমুখিতার প্রথম বার্তাটি দেয়। আমাদের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে সরাসরি বলা আছে যে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণীত হয়নি—
কোনো সরকারই তা করেনি। আবার সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ অর্থাৎ, এই দাঁড়াল যে (ক) নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো আইন সংবিধানের আলোকে থাকার কথা থাকলেও তা নেই (খ) রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবেন (গ) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ না করে তা তিনি করতে পারবেন না, (ঘ) প্রধানমন্ত্রী এমন কাউকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন না, যে কমিশন সদস্যরা নির্বাচনে তার দলের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারেন। বিএনপি এর সবই জানে। প্রয়াত মো. জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন, যার কোনো অস্তিত্ব সংবিধানে নেই। রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদও সেই ব্যবস্থাটি অনুসরণ করেন। প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সময় বিএনপি সার্চ কমিটি গঠন উপলক্ষে আহূত সভায় গিয়েছিল, কিন্তু বিষয়টি সংবিধানবহির্ভূত বিধায় তারা সার্চ কমিটিতে কোনো নাম প্রস্তাব না করে বলেছে রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান দেখাতেই তারা সভায় হাজির হয়েছে। এবারও ব্যবস্থাটি একই রূপ ছিল, আছে। সাংবিধানিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। সব কিছু সম্পর্কে অবহিত থাকার পরও বিএনপি এবার রাষ্ট্রপতির প্রতি শুধু সম্মান দেখানোর জন্যই বঙ্গভবনের দাওয়াত কবুল করেনি, এবারকার সার্চ কমিটিতে পছন্দের লোকের কথাও প্রস্তাব করেছিল। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর তারা শীতল প্রতিক্রিয়া জানালেও অন্যবারের মতো কমিশন প্রত্যাখ্যান করেনি বা এমন মন্তব্য করেনি যে, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। অথচ রেকর্ড আছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মনোনীত কমিশনের বিরুদ্ধে তারা হরতালও পালন করেছিল। আবু সাঈদ সাহেবের বেলায় তো একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ডই করে ফেলেছিল তাকে ‘বাকশাল গভর্নর’ হিসেবে চিত্রিত করে। অথচ তখন মনোনীত সিইসি আবু সাঈদ নন, বাকশালের গভর্নর ছিলেন পাবনার অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। শেখ হাসিনার ’৯৬-২০০১ সরকারে যিনি তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি মেনেই নিয়েছে বলা চলে।
দ্বিতীয় বিষয়টি জটিল তো অবশ্যই, অনভিপ্রেতও বটে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে নির্বাহী বিভাগ। বিশেষ করে রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার ও সরকারি দলে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হবে যদি তারা সুনির্দিষ্টভাবে আপত্তিকর বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে মানুষকে বোঝাতে পারে। পাকিস্তান প্রসঙ্গে তার বক্তব্য মিডিয়ায় যথাযথভাবে পরিবেশিত হয়নি বলে বলেছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি তাকে মিস কোট না করতেও অনুরোধ করেছেন। এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের বক্তব্যের পর বিষয়টি চুকেবুকে যাওয়া উচিত। কিন্তু সরকারি দলের অবস্থানে এখনো উত্তাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগস্ট মাসের প্রায় সবটা তারা এ ইস্যু নিয়েই সরব। নির্বাচনী সড়কের কথা মনে হয় ভুলে গেছে। রায় ঘোষণার পর থেকে আজ অবধি নির্বাচনের পক্ষে কোনো কথাই শোনা যায়নি সরকার ও সরকারি দলের কারও মুখ থেকে। এতে ভয় ঢুকছে জনমনে— জাতি কি নির্বাচনী সড়ক থেকে ছিটকে পড়বে? রাজনীতি কি আবার খুব ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে? অথবা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা কি কমে যাচ্ছে? অথবা সব কিছু কি আমাদের ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে? মানুষ কিন্তু ভয় পাচ্ছে, আতঙ্কে আছে। এটা ভালো নয়। আমরা সবাই যদি সংযত আচরণ করি, যেখানে থামা দরকার সেখানে থেমে যাই তাহলে সব আতঙ্ক-আশঙ্কাই কেটে যাবে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে জটিল করে তোলা ঠিক হবে না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : [email protected]