রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুখ উল্লাসে শোক বিনাশ

মোস্তফা কামাল

সুখ উল্লাসে শোক বিনাশ

শোকাবহ আগস্টকে ঘিরে বিশাল বিশাল ব্যানার-পোস্টার। পাড়া-মহল্লা থেকে শহর-বন্দর, জনপদ এমনকি প্রবাসেও। রাজধানীর অলি-গলি থেকে বিভিন্ন স্টেশন, টার্মিনাল। দেয়াল, রাজপথের ডিভাইডার, আইল্যান্ড, ল্যাম্পপোস্ট থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, মানুষের ঘর-বাড়ির গেট। বেশির ভাগ পোস্টারেই বাঙালিকে কাঁদার আহ্বান। কিন্তু তারা নিজেরা কি শোকগ্রস্ত? অন্তর শোকাবহ তাদের? নিজের হাস্যোজ্জ্বল রঙিন ছবি দিয়ে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ শিরোনাম।  এমন নাদুসনুদুস চেহারায় কান্না বেমানান। সুখমাখা তাগড়া মুখে মানুষকে কাঁদানোর এমন আহ্বান কি শোকের সঙ্গে মানায়? না শোককে খেলো করে ফেলছে? বিবেকমান মানুষ মাত্রই প্রশ্নবিদ্ধ। এই অপরিণামদর্শিতার পণ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাসের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের কোনো জাতশত্রুর পক্ষেও আগস্টের শোকাবহতার এমন সর্বনাশ ঘটানো সম্ভব? আওয়ামী লীগবিরোধী অগুনতি মানুষের কাছেও আগস্ট স্পর্শকাতর। এ মাসটিতে অন্তত নীরব থাকে তারা।

বঙ্গবন্ধুকে হেয় এমনকি কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা দেশে কম হয়নি। কিন্তু তা সফল হয়নি। ইতিহাস তার সুবিশাল উচ্চতা থেকে ছিটকে ফেলেনি শেখ মুজিবুর রহমানকে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির বাইরে এ মাসটি আরও কিছু কারণে বেশ সংবেদনশীল। শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৫-২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাও এ মাসটিতেই (২১ আগস্ট)। ১৫ আগস্টে নিহত বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও শেখ কামালের জন্ম মাসও আগস্ট (৮ ও ৫ আগস্ট)। মাসটি তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বড় কষ্টের। এসব উল্লেখ করতে গিয়ে আবেগের তাড়না ধরে রাখতে পারেন না তিনি। কেঁদে ওঠেন শিশুর মতো। প্রতিপক্ষ তার কান্নায় একাত্ম না হলেও নীরব থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনাধারী কথিত অনুসারীরা? তাদের আগস্টকে খেলো করার অসম্ভবকে সম্ভব করার সাম্প্রতিক জ্বলন্ত চেষ্টা উদ্বেগজনক। আগস্ট তাদের কাছে শোকের চেয়ে কর্মসূচি পালন ও ঘটা আয়োজনে বাহাদুরি ফলানোর উপলক্ষের মওকা। আতিপাতি, চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে বড় কেউ কেউও শরিক এই অপখেলায়। বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান আর বন্দনার আড়ালে নিজেদের হিরো হওয়ার সার্কাসে কেউই পিছিয়ে থাকতে নারাজ।

এবারের আগস্টজুড়ে চলা শোক আলোচনা, স্মরণসভাগুলোর চিত্র কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিল ভয়াবহ। লাস্ট চান্স হেলায় নষ্ট না করার মতো দিগম্বর রেস। শোকের রেশ-লেশের চেয়ে বিরোধী মতের গুষ্টি উদ্ধারই মুখ্য। ফ্রি-স্টাইল গালমন্দ। আর উল্লাসের শোডাউন। কর্মসূচিগুলোতে শোক আমেজের ছবি বা কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ পেতেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে টিভি ক্যামেরাপারসনদের। বলে-কয়েও না-কি মঞ্চে আসীনদের শোকাবহের লাইনআপে আনা যায় না। শোকমঞ্চ ও আশপাশে শুধু মোজ-মাস্তি। সুখের পোজ। সেলফি তোলার হিড়িক। ভুলেই যান শোকায়োজনে আছেন তারা।

শোকের মাসে দুঃখজনক ও কাকতালীয়ভাবে এবার বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের টপলিস্টেও আওয়ামী বা কোনো না কোনো লীগের নেতা-কর্মীর নাম। পয়লা আগস্ট থেকে প্রায়ই শিরোনামে তাদের এ ক্রিয়াকর্ম। শেষ জুলাইতে বগুড়ার তুফানের পর ২ আগস্টে সিরাজগঞ্জের সোহেল আর কাজীপুরের আশরাফের কাণ্ড। একটির রেশ না কাটতেই আরেকটি। এর মাঝেই গজবের মতো বরিশাল বানারীপাড়ার সুমন মোল্লার ঘটনা। টাঙ্গাইলের সখীপুরে তরুণীকে ছয় মাসেরও বেশি সময় আটকে রেখে ধর্ষণের খবরটিও ঘটনাচক্রে বাজারে এসেছে এ সময়টাতেই। এ ঘটনার শিরোমণি বাদল মিয়া একদিকে ওই কিশোরীর চাচা। আরেকদিকে ক্ষমতাসীন দলের নাম বেচে খাওয়া হোমড়াচোমড়া। জয়বাংলা লীগ নামের একটি সংগঠনের টোটকা নেতা। মৌসুমের কারণে চাচা পরিচয় ছাড়িয়ে বেশি বাজার পেয়েছে তার সরকারদলীয় পরিচিতিটাই।

দেশে এমন কী ঘটল এ সময় তাদের এভাবে বেসামাল হওয়া? আর চাঁদাবাজির খবর তো নিয়মিতই। শোক কর্মসূচি পালনের অজুহাতে চাঁদার রেটও বেড়েছে। এসবের কিছু কিছু তথ্য আসছে গণমাধ্যমে। চাঁদার হাটে কোথাও কোথাও ছাড় দিচ্ছে না নিজ দলের লোকজনকেও। বরগুনার তালতলীতে চাঁদা না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে ৬ আগস্ট আচ্ছামতো পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে এক ছাত্রলীগ নেতা। দুপুরে সানলাইটে বাজারের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা নয়ন বেপারি ও তার প্রাইভেট বাহিনীর সদস্যদের হাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পিটুনি খাওয়ার লাইভ দেখেছে স্থানীয়রা। এলাকার সবাই তোয়াজ করে নয়ন বাহিনীকে। চাঁদাবাজিতে বেশ নিরপেক্ষ তারা। ছাড় দিয়ে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না। ছোট-বড় ব্যবসায়ী তাদের জন্য একটা ভাগ রাখেই। আগস্টে তা করা হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু ভেজাল বাধিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব জোমাদ্দার, আবুল কালাম ও জাহাঙ্গীর হোসেন। তালতলীর খোট্টারচর এলাকায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৩০০ একর জমি কেনাকাটার মধ্যস্থতায় সোহরাব, জাহাঙ্গীর ও কালামরা বেশুমার টাকা হাতালেও নয়নবাহিনীকে ডেমকেয়ার করেছিলেন। নয়ন বেপারি ভালোয় ভালোয় তাদের কাছে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা চায়। কিন্তু তারা একটা কানাকড়িও দেননি। উপরন্তু বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তাই উচিত বিচার, নগদে শাস্তি। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে হাসপাতালে প্রেরণ। স্থানীয়ভাবে এ নিয়ে জম্পেশ আলোচনা।

এবার মাসটির শুরুতেই চাঁদাবাজির বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শোকের এ মাসে দলের একটি চক্র চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে অপ্রিয় সত্যটি উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন, শোকাবহ আগস্টে চাঁদাবাজি করলে ছাড় নেই। ওবায়দুল কাদের কী বলেছেন, আর মৌসুমি অনুসারীরা কী শুনেছে? কি-ই বা বুঝেছে? তিনি বলেছেন, আগস্টে চাঁদাবাজি করলে ছাড় নেই। তারা শুনেছে, আগস্টে চাঁদাবাজিতে ছাড় নেই। নয়তো এমন হুঁশিয়ারির পর তারা চাঁদাবাজিতে কেন আরও তেজি? কোথাও কোথাও প্রতি রাতকে চাঁনরাত মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শোকের মাসে প্রতিদিন কর্মসূচিতে বহু খরচ। এর দুই-এক দিন পরই ঈদ। কোরবানিসহ হাত খরচ অনেক। এ বিবেচনায় তারা চাঁদার ন্যায্য হকদারই! উল্লেখ্য, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারির সঙ্গে ওবায়দুল কাদের দেশবাসীকে একটি পরামর্শও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কোথাও নেতা-কর্মী কারও চাঁদাবাজির খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে পার্টি অফিসে জানাতে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের কোথাও চাঁদাবাজিতে আক্রান্ত কেউ আওয়ামী লীগ অফিসে এমন কিছু জানিয়েছে কি? তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার মানে চাঁদাবাজি করছে না ক্ষমতাসীন দলের কেউ। করলেও দল দোষমুক্ত। আর দায়ী চাঁদাদাতারাই। কারণ আগেভাগেই বলে দেওয়া হয়েছিল, চাঁদা চাইলে ব্যাপারটা পার্টি অফিসে জানাতে।

মাসজুড়ে শোকব্রতের বদলে এবার পথেঘাটে বেশি বেপরোয়া-অসহিষ্ণু শোক আয়োজকরা। একটুতেই চেতনায় চেত এসে যায় পাগলা পীরের মতো। কোথাও সমীহতে সামান্যতম কমতি হলেই ক্ষেপে ওঠে। ঘটিয়ে বসে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। চা পাঠানোর হুকুম না মানার অপরাধে ১০ আগস্ট এনএস কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের কাণ্ড টক অব দ্য নাটোর। দোকানের বাইরে চা না পাঠানোয় তারা কলেজসংলগ্ন চায়ের দোকানি মোস্তফা ও তার ভাই রুস্তমের গায়ে গরম পানি ঢেলে শিক্ষা দিয়েছে। ভেঙে চুরমার করেছে দোকানটি। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষ এ নিয়ে কি সব বলাবলি করছে, ছি, ছি করছে। দল বা সরকারের কি জানা আছে? এর আগে, রাজধানীর পলাশীর ঘটনাও নির্মম। ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় দুই বোন (ইডেন কলেজের ছাত্রী) ও তাদের একজনের স্বামীর ওপর হামলে পড়েন ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা। বাজারে হাঁটার সময় ছাত্রীরা ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান পিকুলকে সালাম দেয়নি। সমীহ করেনি। এমনকি পিকুলের সঙ্গে তাদের একটু ধাক্কাও লাগে। এতে পিকুল ক্ষেপে যান। কেন তার মতো একজন নেতাকে চিনবে না ওরা? তাই অকথ্য গালাগালসহ অপদস্তকরণ। দুই বোন প্রতিবাদ করলে পিকুল আরও মাইন্ড করেন। ওয়ান-টুর মধ্যে নগদে দেখিয়ে দেন তার কেরামতি। কল করে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ে আসেন ১০-১৫ জন সাঙ্গপাঙ্গকে। আচ্ছামতো শিক্ষা দেন দুই ছাত্রীসহ স্বামী বেচারাকে। টানাহেঁচড়ার একপর্যায়ে ছাত্রীদের জামাকাপড়ের কিছু অংশ পিকুলের হাতেই থেকে যায়। আশপাশের লোকজন মজমার মতো দেখেছে বাঘের বাচ্চা ছাত্রলীগ নেতাটির হিম্মত। ওই দিনই গফরগাঁওয়ের গয়েশপুর কলেজে ধোলাই খায় হৃদয় নামে এক খুচরা ছাত্রলীগ নেতা। সে কদিন ধরে পিস্তলবাজি শিখেছে। মাঝেমধ্যেই মহড়া দিয়ে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক তৈরি করে। সেদিন সংঘবদ্ধ হয়ে ছাত্ররা তাকে ধরে ফেলে। মার দেওয়ার পর ধরা পড়ে পিস্তলটিও ভুয়া। সেটা একটা খেলনা পিস্তল। কিন্তু ততক্ষণে ধোলাই এবং ছাত্রলীগের বদনাম যা হওয়ার পুরোটাই হয়েছে। ওই এলাকায় বেশ রসঘন আলোচিত বিষয়টি।

অহর্নিশ দলবাজিতে লিপ্ত এই শ্রেণিটির শোকের নামে উৎসবের ডুবসাঁতারে শরীয়তপুর, ঝিনাইদহ, ছাতকসহ কয়েক জায়গায় এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। লাশও পড়েছে। সোনার টুকরাদের এ ধরনের সোনালিকাণ্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্থানীয় পর্যায়ে মারাত্মক। লায়াবিলিটি বা গজবের মতো হয়ে দাঁড়ালেও দেশের আনাচে-কানাচে এরা আওয়ামী লীগের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। নিজ নিজ এলাকায় এরা পরাক্রমশালী। গোটা দলকে আটকে ফেলেছে নিজেদের জালে। তাদের কাণ্ড-কারখানায় আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কোনো কোনো এলাকায়ও দলের সামাজিক ভিত্তিতে পড়ে গেছে খরার টান।  এই সুখভোগীদের ধারে-ভারে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কবেই ছিটকে পড়েছে উচ্ছিষ্টের খাতায়। আফসোস আর মনোবেদনায় ভোগা ছাড়া তাদের কিছু করার সামর্থ্যও নেই।  লজ্জিত, বিব্রত বা মনে মনে ক্ষুব্ধ হওয়াই এই ফোঁড়খাওয়াদের নিয়তি। মাথা নিচু করে চলতে হচ্ছে তাদের।  মুখ দেখাতে লজ্জা পান। কিন্তু মুখ না দেখিয়ে অন্য কিছু দেখানোই বা কি সম্ভব?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

ই-মেইল : mostofa71¦gmail.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর