রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে

ড. সাকিল আহাম্মেদ

বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে

বাংলাদেশের এক বিশাল এলাকা এখন বন্যাকবলিত।  পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ অন্যের বাড়িতে, আশ্রয় কেন্দ্রে বা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো পরিবার টিনের চালে ও খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বাসস্থান, খাদ্য, পানীয় ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যায় ভুগছে এসব এলাকার অধিকাংশ পরিবার। বিশেষ করে গরিব ও দুস্থ পরিবারগুলো।

যে কোনো দুর্যোগেই সাধারণত শিশু-নারী-বৃদ্ধ-প্রতিবন্ধী-গর্ভবতী নারী এবং অসুস্থ মানুষ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বন্যায় এসব মানুষের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বন্যাদুর্গতদের সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হলো— আশ্রয় কেন্দ্র, যেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে বানভাসি পরিবারগুলো নিরাপদে দিবা-রাত্রী যাপন করতে পারে। এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশু, নারী ও যুবতী মেয়েদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে থাকতে পারে তেমন একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গবাদিপশুর জন্যও নিরাপদ আশ্রয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, বাটপারি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। শিশুরা যাতে পানিতে ডুবে না মারা যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আশ্রয় কেন্দ্রে কিছু স্বেচ্ছাসেবক গঠন করে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিলে আশ্রয় কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা সহজ ও সুন্দর হবে।

বন্যাদুর্গতদের জন্য দ্বিতীয় যে প্রয়োজন, তা হলো খাদ্য। সাধারণত শুকনা খাবার যেমন— চিঁড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট এবং সহজে রান্না করা যায় ও পরিবেশন করা যায় এমন খাবার যেমন— খিচুড়ি, ডাল-ভাত ইত্যাদি বানভাসি মানুষের সবার জন্য নিশ্চিত করা। শিশুদের জন্য শিশুখাদ্য যেমন— দুধ, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট ইত্যাদি নিশ্চিত করা। গৃহপালিত পশুপাখির খাবার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এসব খাবার শুধু আশ্রয় কেন্দ্রেই নয়, যারা আপন আপন বাড়িঘরে অথবা অন্য বাড়িতে এখনো রয়ে গেছে খোঁজখবর নিয়ে তাদের দোরগোড়ায় এসব খাবার পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে সাহায্যকারীদের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা জরুরি। তা না হলে কেউ বেশি পাবে, কেউ কম পাবে অথবা কেউ পাবেই না।

তৃতীয় যে প্রয়োজন, তা হলো— চিকিৎসা। সাধারণত বন্যাদুর্গত এলাকায় জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া-আমাশয়, চুলকানি ইত্যাদি রোগ বেশি হয়ে থাকে। আশ্রয় কেন্দ্রে ও আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে দুর্গত এলাকায় চিকিৎসা ক্যাম্প এমনকি নৌকায় ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প করে হলেও বন্যাজনিত রোগ বা সম্ভাব্য অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থাগুলো ছাড়াও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ম্যাটস, প্যারামেডিকেল কলেজ, ক্লিনিক, কোনো ব্যক্তি বা চিকিৎসক এসব আয়োজন করতে পারেন। এ সময় পানিতে ডোবা, সাপ, পোকামাকড়ের কামড় ইত্যাদিও বেড়ে যায়। এসব বিষয়েও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। শিশু, গর্ভবতী মা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে বিশেষ সচেতন থাকতে হবে, যাতে করে তারা কোনো দুর্ঘটনার শিকার না হয়।

বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশেষ করে দরিদ্র অনেক নারী-পুরুষকে এক কাপড়ে থাকতে হয়। অনেককে গোসল করে পরনের কাপড় পরনেই শুকাতে দেখা যায়। তাই দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলোর জন্য এ সময় একটি শাড়ি ও একটি লুঙ্গি দিয়ে সহযোগিতা করা যেতে পারে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে শাকসবজি এবং আউশ ধানের। কৃষকের এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য সরকারি পর্যায়ে, বেসরকারি পর্যায়ে এবং যাদের সুযোগ আছে তেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে উঁচু জায়গা বা যেসব এলাকায় বন্যার প্রভাব পড়েনি সেসব এলাকায় ধান, বেগুন, লাউ, কুমড়া ইত্যাদির বীজতলা প্রস্তুত করে চারা তৈরি করা। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ বীজ এখনই সংগ্রহ করা। যাতে করে বন্যা নেমে যাওয়ার পরপরই বন্যাকবলিত কৃষকদের মাঝে যার যেটা প্রয়োজন সে অনুযায়ী বীজ বা চারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরবরাহ করা যায়। এতে করে বন্যা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। কৃষকরা ক্ষতি দ্রুত পুষিয়ে উঠতে পারবে, কৃষি শ্রমিকরা কাজ পাবে। এতে করে দেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি কমে আসবে এবং দরিদ্র কৃষি শ্রমিকদের ত্রাণের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে।

আমাদের দেশে এক্ষেত্রে এখনো কৃষকের দুঃখ রয়ে গেছে। বন্যা নেমে যাওয়ার পরপরই কী ধরনের সহযোগিতা পেলে তারা দ্রুততম সময়ে ফসল উৎপাদন করতে পারবে সে পরামর্শ বা সে সহযোগিতা পায় না। সাধারণত সরকারি ব্যাংক ও এনজিওগুলো বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষকদের জন্য ঋণের টাকা দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু এর পাশাপাশি যেটা খুব বেশি প্রয়োজন, সেটা হলো কৃষির ওই জমিতে লাভজনক ও অল্প সময়ে কী ফসল উঠে আসতে পারে সেই সব ফসলের বীজ, চারা, সার এবং পরামর্শ দ্রুত সরবরাহ করা।

আমাদের দেশে সবকিছুতে সরকারের ওপর নির্ভর করা বা সরকারের ওপর দায় চাপানোর একটা প্রবণতা বেড়ে গেছে।  অথচ এদেশের সমাজে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক সহমর্মিতা সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে পারস্পরিক দুঃখ-কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং একসঙ্গে সংগ্রাম করে জেগে ওঠার ইতিহাস সুগভীর এবং গৌরবপূর্ণ।

লেখক :  গবেষক।

email: dr [email protected]

সর্বশেষ খবর