২০০০ সাল থেকে শুরু করে আমি আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বহুবার কলাম লিখেছি। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ থেকে ১৭ বছর আগে আমি পত্রিকান্তরে বলেছিলাম, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দুই প্রতিবেশী দেশকে খোলা মনে আলোচনায় বসতে হবে। রোহিঙ্গারা বার বার বাংলাদেশে চলে আসার কারণে বাংলাদেশ বার বার আর্থিক এবং সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের বন কেটে উজাড় করছে, কক্সবাজার এবং বান্দরবানে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে এবং বড় কথা, দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে—যা কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য নয়। রোহিঙ্গা সমস্যাকে জিইয়ে রেখে দুই নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে সুসম্পর্ক আশা করা যায় না। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শান্তি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা ১৯৭৮ সালে একবার বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্য থেকে কতজন নিজ দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। কোন যুক্তির ভিত্তিতে তৎকালীন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়েছিল সেই তথ্য সরকারের কাছে সংরক্ষিত আছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গা যদি নিজ দেশে ফেরত না গিয়ে থাকে তাহলে ফেরত না যাওয়া রোহিঙ্গারা কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং তাদের নাগরিকত্বের পরিণাম কি হয়েছিল সে সম্পর্কে সরকার কি ওয়াকিবহাল আছে? এসব তথ্য-উপাত্ত সরকার যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে থাকলে এখন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা অনেক সহজ হয়ে যেত। তখন যদি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিয়ে ফেরত নিয়ে থাকে তাহলে সেই নাগরিকদের এখন তারা অস্বীকার করবে কোন যুক্তিতে?
১৯৯২ সালে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ঘোষণা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ১৯৯২ সালের পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, শরণার্থী সমস্যার শুরুতে ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক শরণার্থী ঘোষণা করেছিল। সেই সঙ্গে বিশাল আয়োজনে তাদের বাসস্থান এবং আহারের জোগান দিয়ে যাচ্ছিল। রোহিঙ্গারা যাতে আরামসে শরণার্থী ক্যাম্পে বছরের পর বছর ঘাঁটি গেড়ে বাস করতে পারে সে জন্য সরকারের মধ্যে তারা সুবিধাভোগী আমলা বাহিনী সৃষ্টি করেছিল। স্থানীয় মানুষ রোহিঙ্গাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাতে মারমুখী হয়ে না ওঠে সে জন্য ইউএনএইচসিআর কক্সবাজার এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় বাসিন্দাদের খুশি করার জন্য অ্যাসিস্ট্যান্স ফর বাংলাদেশি ভিলেজেজ প্রকল্প বানিয়ে রাস্তা বানানো এবং পানি সরবরাহের নামে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে টাকা ছড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের অত্যাচারে বন উজাড় হচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হলে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগের নামে তড়িঘড়ি করে পাঁচ কোটি টাকা ছাড় করেছিল যার কোনো হিসাব বন বিভাগ কাউকে দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইউএনএইচসিআর কোনো দিন সেই টাকার হিসাব চাওয়ারও তাগিদ বোধ করেনি। জামায়াত আহলান ওয়া সাহলান লিখে রোহিঙ্গাদের এ দেশে ডেকে এনেছিল আর তার পেছন পেছন ইউএনএইচসিআর কালবিলম্ব না করে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার মতলবে বাংলাদেশে হাজির হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের ঘিরে বিএনপি-জামায়াত সরকারের হয়তো বিশেষ রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল বলে সরকার মিয়ানমারকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও বিষয়টি কেন ঝুলে থাকল সে জবাব আওয়ামী সরকার ভালো দিতে পারবে। রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে জামায়াতের রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ইউএনএইচসিআরের জামায়াত এবং রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতা ব্যাখ্যা করার সাধ্য আমার নেই। ইউএনএইচসিআরের অতি আগ্রহের বিষয়ে সরকারের কৌতূহলী হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সেটি কোনো সরকার আমলেই ঘটেনি। বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই জানত শরণার্থী আশ্রয়-প্রশ্রয়ের নামে আদতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোকে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯২ সালে স্থাপিত ২০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কোনো কোনো ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোকে রীতিমতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বলে সে সময় পত্রিকাগুলোতে সংবাদ ছাপা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছিল। তাদের আন্তরিক সদিচ্ছার কারণে সে সময় ২ লাখ ৫০ হাজার শরণার্থী থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী প্রত্যাবাসিত হয়েছিল। শরণার্থী প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় এর চেয়ে ভালো কোনো রেকর্ড ইউএনএইচসিআর অন্য কোনো দেশে দেখাতে পারবে? প্রত্যাবাসিত শরণার্থীরা যাতে মিয়ানমারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে সে জন্য ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে তাদের অফিস চালু করে নিয়মিত কর্মসূচি নিয়েছিল। সেই কর্মসূচির আওতায় প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যথেষ্ট সহযোগিতা দেওয়া হলে রোহিঙ্গারা আবার শরণার্থী হতে বাধ্য হচ্ছে কেন ইউএনএইচসিআরের কাছে সে প্রশ্নের জবাব চাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের আছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সফর শেষে বললেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাই করার কাজে মিয়ানমারকে সহযোগিতা করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার এসব ভালো কথার রেশ কাটার আগেই পুরোদমে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ সরকারের কাঁধে নতুন করে চেপে বসল। বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য কামনা করলেন। সরকারের দুজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর উদাত্ত আহ্বানের প্রতি সম্মান রেখে আমার প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক মহল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে মানবিক সাহায্য দিলে কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে? সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা যায়, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আবেগের বশে কথা বলার মতো বাস্তবতা আর নেই। বিচ্ছিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেবে। সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে শরণার্থীদের বেঁচে থাকার উপকরণ সরবরাহ করতে পারে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য অত্যন্ত জোরালো কূটনৈতিক তত্পরতা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ সপ্তাহে একটি ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য তিনি কারও মুখাপেক্ষী হয়ে সময় নষ্ট না করে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করার জন্য নিজে মিয়ানমার চলে গিয়েছেন এবং বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা শেষ করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৮৪ সালে মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক কারেন শরণার্থী থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৯৫ সালের মধ্যে তাদের বড় একটি অংশ আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশে রয়ে যাওয়া ২১ হাজার রোহিঙ্গার মধ্য থেকে গত ৩০ বছরে মাত্র ৯০০ শরণার্থী আমেরিকা, কানাডা কিংবা আয়ারল্যান্ডে আশ্রয় পেয়েছে। অনেকে মনে করে, সামান্য সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী উন্নত দেশে আশ্রয় পাওয়ার ফলে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে থাকে। কারেন শরণার্থীদের মধ্যে যারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত আসতে চেয়েছিল তারা মিয়ানমারে ফেরত গিয়েছে এবং তাদের অনেকে মিয়ানমারের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। ইউএনএইচসিআর মিয়ানমার অফিস থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠান থাইল্যান্ড থেকে প্রত্যাগত শরণার্থীদের মিয়ানমারে থিতু হয়ে বসবাস করার জন্য ১০ বছর ধরে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা নিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করে চলেছে। যেসব শরণার্থী থাইল্যান্ড থেকে নিজ দেশ মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছে তারা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের টেকসই পরিকল্পনার সুফল পাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়। থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া কারেন শরণার্থী সমস্যার সম্মানজনক সমাধান দেখার পরে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাওয়া রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার কাজে ইউএনএইচসিআর কি ইচ্ছা করে অবহেলা করেছে?
আমার ধারণা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নিজস্ব কোনো এজেন্ডা আছে, যা আমরা জানি না। তবে বাংলাদেশ সরকার যদি গুরুত্বসহকারে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় তাহলে আন্তর্জাতিক মহল এক সময় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। আমি আবার বলছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেমন আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্যের আশায় অপেক্ষা না করে নিজে মিয়ানমার গিয়ে সে দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশকেও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।