রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছে কি!

মোশাররফ হোসেন মুসা

মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছে কি!

একজন ব্যক্তি ক্রয়সূত্রে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে একটি বাড়ির মালিক হলেই যে তিনি প্রকৃত মালিক হতে সক্ষম হবেন এমন কোনো কথা নেই। প্রথমে বাড়িটিকে নিজের মনে করতে হবে, শুধু নিজের মনে করলেই হবে না, বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্য সদস্যরা যেন ভবিষ্যতে মালিকানা পরিচালনা করতে সক্ষম সে বিষয়েও তাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশটাও বড় সংসারের মতো। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের জনসাধারণই দেশের প্রকৃত মালিক। কিন্তু তাদের মালিকানাবোধ জাগ্রত করতে জনগণের অগ্রগামী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা কতটুকু দায়িত্বশীল? কিংবা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের চেতনার মধ্যে মালিকানাবোধ আছে কিনা সেটাও এখন প্রশ্ন।

মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ আরেনডেন্ট (Hannah Arendt) ‘ফ্রিডম’ নামক এক প্রবন্ধে বলেছেন— ‘স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব’। অন্য এক মনীষী বলেছেন— ‘স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক মুক্তি’। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে এদেশের জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি উভয়েরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও রাখেন। তিনি যদি সেদিন উত্তাল জনগোষ্ঠীকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার আদেশ দিতেন তাহলে সেদিনই পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটত। কিন্তু সেটা হতো হটকারী ঘটনা। কারণ এতে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা থাকত। সেই সঙ্গে প্রমাণ হতো আওয়ামী লীগ অগণতান্ত্রিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে না পালিয়ে সঠিক মালিকানার দৃষ্টান্তও রেখেছেন। এর আগে তিনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে মালিকানা পরিচালনার বৈধতা পেয়েছেন। তিনি কেন বাড়ি ছেড়ে পালাবেন? অথচ এ দেশে তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী (তাদের মধ্যে একজন বড় মাপের তাত্ত্বিকও রয়েছেন) দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছেন— ‘ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের আদেশ না দিয়ে এবং বাড়ি ছেড়ে না পালিয়ে তিনি আপসকামিতার পরিচয় দিয়েছেন। আসলে তিনি স্বাধীনতা চাননি।’ তাদের এ অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের কেউই মালিকানাবোধ, দায়িত্বশীলতা, স্বাধীনতা, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় মালিকানাবোধের বহু পরিচয় রয়েছে (তার আত্মজীবনীতেও অনুরূপ বহু ঘটনা রয়েছে)। তিনি জীবিত থাকলে দল ও জনগণকে দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন কিনা সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয়। তবে তার কন্যা শেখ হাসিনা বার বার বলছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি সম্প্রতি ছাত্রলীগ কর্তৃক জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বলেছেন, ‘একুশ বছর পর ক্ষমতায় আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের মডেল। এটি এমনি এমনি ঘটেনি। এটা হয়েছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, দেশকে ভালোবাসা, দেশের উন্নয়নে কাজ করা এবং দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। যে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার সাহস থাকা’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। এর আগে ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের কয়েকদিন পর তিনি নিউজউইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন— ‘যদি কোনো মানুষ মৃত্যুভয়ে ভীত থাকে তাহলে সে জীবনে কোনো মর্যাদা পাবে না।’ তিনি বহু সভা-সেমিনারে ছাত্রলীগকে ত্যাগী ও সৎ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটছে। ছাত্রলীগের আচার-আচরণ কত ন্যক্কারজনক হতে পারে তা যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গেলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। বর্তমানে ‘আমি’ আর ‘আমরাবাদ’ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু দেশের কোথাও ‘আমরাবাদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। স্বাভাবিক কারণেই মালিকানা প্রতিষ্ঠার দায়ভার তাদেরই বেশি থাকার কথা। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বর্তমান রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকায় সরকারি দলে যোগ্য ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের জায়গা হচ্ছে না। তারপরেও রয়েছে দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ফলে তৃণমূলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও এখন বখাটেদের দখলে। দল করা মানে দুই-তিন মাসে একটি ‘অন-টেস্ট’ হোন্ডার মালিক হওয়া। এখন পদব্রজে কোনো মিছিলে হয় না, হয় হোন্ডার মিছিল। নেতা-কর্মীদের ভিতরে মালিকানাবোধ জাগ্রত না হওয়ার জন্য দায়ী কে? এরকম নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে জনগণইবা কী শিক্ষা নেবে? প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছেন, ‘তাকে ছাড়া সবাইকে কেনা যায়।’ বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়।’ ঝুড়িটি তলাবিহীন না হলেও তলাতে অসংখ্য ছিদ্র আছে তা জোর দিয়েই বলা যায়। তা নাহলে মাত্র ১০-১২ বছরে হঠাৎ করে শত শত কোটিপতি সৃষ্টি হয় কীভাবে? এমতাবস্থায় দুটি পথ খোলা আছে, তাহলো- বড় দল দুটির নেতৃত্ব মেনে নেওয়া অথবা বিকল্প দল গড়ে তোলা। নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার পেছনে একশ্রেণির মানুষের যুক্তি হলো— ‘এসব দলের নেতা-কর্মীরা একসময় বিবেকের তাড়নায় সংশোধিত হয়ে যাবে এবং অবৈধ অর্থ দিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলবে।’ বিপক্ষ দলের যুক্তি হলো— ‘এরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে না এবং সংশোধনও হবে না।’ কাজেই বর্তমান অবস্থায় নতুন করে দল তৈরি করে ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কারণ বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য ২০-২৫ বছরের অবিরাম সংগ্রামের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ছোট দলগুলোর নেতৃবৃন্দের অধিকাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। সেজন্য ছোট দলগুলোর উচিত হবে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তাদের ঘোষণা দিতে হবে, তারা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় যেতে চায় এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়া প্রয়োজন ছিল সেগুলো তারা প্রথমেই বাস্তবায়ন করবে। একই কারণে তাদের সর্বাগ্রে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরতে হবে। তাছাড়া মালিকানা কী এবং মালিকানা কীভাবে রক্ষা করতে হয় তা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর