বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুই কিসিমের ডাক্তার

মাকিদ হায়দার

দুই কিসিমের ডাক্তার

গ্রামটির নাম ছাতিয়ানতলি, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণের জেলা মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের পূর্বদিকে, বিক্রমপুর নামটি মুন্সীগঞ্জের চেয়েও অনেক বেশি খ্যাতিমান। অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির জন্মভূমি, ধলেশ্বরী, পদ্মা আর ইছামতি নদীবেষ্টিত মুন্সীগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রাচীন অনেক শিল্পকর্ম প্রায় বিলীন হয়ে গেলেও বিলীন হয়নি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাশসহ অনেক গুণী ব্যক্তির নাম। মুন্সীগঞ্জের পশ্চিম দিকে এগিয়ে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত গেলেই চোখে পড়বে পদ্মা সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞ। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুত দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড এবং জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ গ্রহণ না করে, দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার লক্ষণীয়ভাবে উন্নতি হবে না বলে যারা একদিন সন্দিহান ছিলেন, আজ তারা নিশ্চুপ। বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা যে অপমানটা পুরো জাতিকে করেছিল, সেটি ছিল অভাবনীয়। তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল বিশ্বব্যাংক সেটি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বাঘের বাচ্চা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কিছুদিন আগে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল, সৈয়দ আবুল হোসেন নির্দোষ। বেহায়া বিশ্বব্যাংক যেসব উেকাচ গ্রহণের কথা বলেছিল, সেসব মিথ্যা অভিযোগের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন হয়তো রসিকতার ছলে বলা যেতে পারে, ‘গরিবের বউ সবার ভাবী’। বড়লোকের বউ বেগম সাহেবা ‘ম্যাডাম’। আমাদের নিকটবর্তী দেশ চীনে গিয়ে যদি বিশ্বব্যাংক, তাদের ওপরে দাদাগিরি করত তাহলে না হয় বুঝতাম কত বড় বাপের ব্যাটা। বিশ্বব্যাংকের এবং দাতাগোষ্ঠীর ইচ্ছে, যেন তৃতীয় বিশ্বের লোকজন সব সময় ব্যাংকের হুকুমেই চলাফেরা করে—সে ডাউল গলতে দেয়নি, সিদ্ধ হতে দেয়নি প্রধানমন্ত্রী।

কথাগুলো ভাবছিলাম মাওয়া ঘাটে গিয়ে, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন পদ্মা সেতুর অগ্রগতির কথা, এ ছাড়াও আমার শ্বশুরালয় খুলনা হওয়ার সুবাদে যেতে হয়েছিল, পদ্মা-যমুনা নদী দিয়ে। ইতিপূর্বে অনেকবার যমুনা ও পদ্মা নদী দিয়েই গিয়েছি এবং এসেছি, তবে এবারের যাত্রা যেন ভিন্নমাত্রা পেল, পদ্মা সেতুর অভাবনীয় অগ্রগতি দেখে।

বছর দুয়েক আগে বিক্রমপুরের ছাতিয়ানতলি গ্রামের বিশিষ্ট ছোট গল্পকার মাহবুব রেজা, এক শীতের সকালে তার গ্রামের বাড়িতে, ঢাকা থেকে আট-দশজনকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যখন ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ কর্মরত ছিলেন, তখন একদিন আমাকে বলেছিলেন, যদি বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জে আপনাকে নিয়ে যেতে চাই যাবেন কিনা, গেলে দেখবেন মাঠে মাঠে প্রচুর... নিজেকে থামিয়ে, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন এমন কিছু দেখাব যা দেখলেই আপনার মনে হবে আপনি ইউরোপের ছোট ছোট শিশুদের দেখছেন, দেখছেন তাদেরই গায়ের রঙের মতো একটি খাদ্যের রং, ওর কথায় সম্মতি দিলাম, তখনই জানালো উপন্যাসিক ছোট গল্পকার বুলবুল চৌধুরী, শেখ আবদুল হাকিম, প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান, শিল্পী ধ্রুব এষসহ আরও জনাকয়েক আগামী পরশু পুরানা পল্টনের মনি সিংহ ফরহাদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের মাইক্রোবাস। সঙ্গে একজন আমাদের ডাক্তার বন্ধুও যাবেন। তিনি নিজেও কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের সাহচর্য তার ভালো লাগে। নাম জানতে চাইলে জানালেন ডাক্তার রাহমাতুল বাড়ী। সম্মতি দিলাম, যাব।

বন্ধু বুলবুল আমার সহপাঠী ছিলেন, জগন্নাথ কলেজে (১৯৬৫-৬৭) শিক্ষাজীবনে আজিজও তাই, তবে বন্ধু হয়েছে শেখ হাকিম ও শিল্পী ধ্রুব এষ অনেক পরে। শেখ হাকিমের অনুজ আমাদের ভাগ্নিজামাই হওয়ায় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। ওদেরই অগ্রজ বিশিষ্ট অনুবাদক শেখ আবদুর রহমানও ছিলেন আমার সিনিয়র বন্ধু। মাহবুব রেজার কথানুসারে প্রায় শীতের শেষ দিকে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে, তাদের সেই ছাতিয়ানতলি গ্রামে।

অনেক দিন পরে সবুজ দেখলাম প্রাণভরে। সেই সঙ্গে গ্রামের মেঠোপথ। সেই পথে যেতে যেতে দেখি। দূর থেকে যেন মাঠের ভিতরে হাজার হাজার স্তূপাকারে এমন কিছু সাজিয়ে রাখা হয়েছে, দেখলেই মনে হবে শুধু ইউরোপীয় শিশুদের নয়, তরুণ, মধ্যবয়সী এবং শেষ বয়সী ছেলেমেয়েদের সেই খোলা মাঠে শুইয়ে রেখেছে। আবার রাতে শীতে ভিজে চুপসে গেছে শিম আর বটবটির ছেলেমেয়েগুলো। আমরা সদলবলে সেসব স্তূপাকারের কাছাকাছি যখন গিয়ে পৌঁছলাম দেখি, মুন্সীগঞ্জের সেই মেমসাহেব চেহারার হাজার হাজার ছোট মাঝারি দীর্ঘ সাইজের সাদা ধবধবে আলু। আলুদের এভাবে দেখা হয়নি, এমনকি বুলবুল, আজিজ এবং হাকিম ও ডাক্তার রাহমাতুল বারী জানালেন, আমার বাড়ি বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুর হলেও আমার রেজার সঙ্গে প্রায়শই এই গ্রামে বেড়াতে আসি। কেন আসেন প্রশ্ন করতেই তিনি জানালেন পরে বলবেন আমাকে, দিগন্ত মাঠ, মাঠে মাঠে হাজার হাজার টন বিস্তৃত সাদা আলু যেন আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে আর ভাবছে রাক্ষসের দল। একদিন আমাদের খেয়ে শেষ করবে। মেঠোপথে বেশ অনেক দূর হেঁটে গেলাম, মাহাবুব রেজাদের যে বাড়িতে উঠলাম, সেই বাড়িটি মাঠ থেকে প্রায় দশ-পনেরো ফুট উঁচুতে, প্রতি বছর বন্যায়-বর্ষায় বাড়িগুলোতে যেন পানি না ওঠে, সে জন্যই বানানো হয়েছে উঁচুতে।

বাড়িটির পূর্বদিকে পুকুর, আম-জামের বাগান। আরও কিছুটা দূরে এক বিত্তশালী রাজাকারের বাড়ি, আমাদের যাওয়া উপলক্ষে পুকুর থেকে বড় বড় মাছ ধরার ব্যবস্থা করেছেন মাহবুবের স্ত্রী। দুপুরে আহারের আগে খই, মুড়ি, পাটালি গুড়, চিতই পিঠা এবং চা এলো, সেই শীত সকালে ভালোই লেগেছিল, গল্প হচ্ছিল, মেম আলুদের নিয়ে। বগুড়ার আলু যে মুন্সীগঞ্জের আলুর কাছে কিছুই নয়, রেজা জানালে আমি বললাম, বগুড়ার আলু সুস্বাদু, লাল রং, বেঁটে বেঁটে ছোট ছোট হলেও আঠালো, গরম ভাত আর খাঁটি ঘি দিয়ে যদি একবার কেউ খায় আউশ-আমন চালের ভাত দিয়ে, মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত মনে রাখতে হবে বগুড়ার আলু আর ঘিতে ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা। বুলবুল, আজিজ, হাকিমসহ পুকুরের পূর্বদিকে গিয়ে তাসখেলার আয়োজন করার আগেই দেখলাম ওই ছাতিয়ানতলি গ্রামের হিন্দু, মুসলমান, জনাকয়েক গরিব মহিলা, মাহবুবদের বাড়ির উঠোনে এসে ঢুকে পড়লেন, আমাদের সঙ্গীদের কেউ কিছু বলার আগেই ডাক্তার রাহমাতুল বারী তাদের বললেন, মা সকল আপনারা বসুন।

আমরা চা-মুড়ি খাবার পরে, বুলবুলরা পুকুরের ওপারে তাসের আসর বসিয়ে দিলেও আমি আর ডাক্তার যাইনি। যেহেতু তাস খেলা কোনো দিনই ইচ্ছাকৃতভাবে শিখিনি। বিরক্তিকর একশেষ। নিজের দুটি হাত নিজের মুখের ওপর নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। বিশ্রী কাণ্ড। আগতদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে কাচারি ঘরটায় এসে লাইন ধরে, কেউ মাটিতে, কেউ বেঞ্চে, আবার কেউ কাচারি ঘরের বাইরে বাঁশের মাচায় বসে পড়লেন, আমি তখনো বুঝতে পারিনি, ওইসব দুস্থ মহিলার আগমনের হেতু কী? আর তখনই লক্ষ্য করলাম ডাক্তার বারী ওইসব মহিলাকে বললেন, মা সকল আপনারা একজন একজন করে আসুন, তাকিয়ে দেখি, যুবতী, মধ্যবয়সী অনেকেই আছেন। ডাক্তার আমাকে বিনয়ের সঙ্গেই জানালেন, আপনি বুলবুল ভাইদের ওখানে গিয়ে তাস খেলা দেখলে ভালো হয়, মা-বোনদের অসুখ-বিসুখের কথা ওরা বলবেন—তাই আপনাকে...। ডাক্তারের কথায় ভীষণ অভিভূত হলাম। তিনি দুপুরের আহারের আগ পর্যন্ত অতগুলো রোগী দেখলেন, বিনা পারিশ্রমিকে প্রেসক্রিপশন ও কিছু টাকা হাতে তুলে দিলেন দুস্থদের। ফেরার পথে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম অতগুলো রোগী যদি ঢাকায় আপনার চেম্বারে দেখতেন, পারিশ্রমিক কত পেতেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন একটু ঘুরিয়ে। তারপরও আমাদের ডাক্তারদের তো ‘কসাই’ বলেন আপনারা। মনে মনে বললাম, আপনাকে তো আমার মানুষই মনে হলো। মাহবুব জানাল, বারী ভাই প্রতি পনেরো দিন পর পর আমাদের গ্রামে আসেন, আমি তাকে নিয়ে আসি তার গাড়িতে।

বেশ অনেক বছর আগে বিসিক নকশা কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন শিল্পী এমদাদ হোসেন। বুড়িগঙ্গার ওপারে রহিতপুরে গিয়েছিলাম তার গ্রামের বাড়িতে। কিছুটা ঘোরার পরে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়েছিল ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আজিজপুর দিয়ে। এর অনেক কাল পরে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে ঢাকার ধানমন্ডির আনোয়ার খান মেডিকেল হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ভর্তি হয়েছিলাম। রাতে বোধহয় ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যথারীতি ভিআইপি কেবিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিছুই জানিনে, জানলাম সকালে একজন বক্ষব্যাধির ডাক্তার প্রফেসর এলেন আমার কক্ষে, সঙ্গে দুটি মেয়ে ছাত্রী ডাক্তার-দুটি ছাত্র ডাক্তার। আমার বুকে পিঠে থেটিসকোপ লাগিয়ে লাগিয়ে পরীক্ষান্তে বললেন, দশ দিন পরে সব রিপোর্ট দেখার পরে বলা যাবে আপনার ক্যান্সার হয়েছে কিনা? ভড়কে গেলাম। এবার আর রক্ষা নেই। হাসিমুখে ডাক্তার জানালেন, ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই জিজ্ঞাস করলাম, আপনার নাম কী? সদাহাস্য সুশ্রী ডাক্তার বললেন, নাম আবদুস শাকুর খান। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলি হেসে বললেন।

শ্বশুরবাড়ির কথাটাই আগে বলা ভালো, কী বলেন কবি সাহেব, বুঝলাম ডাক্তার আবদুস শাকুর রসে টইটম্বুর। আমি হেসে দিতেই—শাকুর বললেন, আমার বাড়ি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আজিজপুরে মিয়া বাড়ির ছেলে আমি, শ্বশুরবাড়ি আপনাদের উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁওয়ে। আরও জানালেন প্রতি মাসেই দুবার করে আমাকে যেতে হয় আমাদের আজিজপুরে। কেন, জানতে চাইলে জানালেন, বিনামূল্যে বিনা পারিশ্রমিকে দেখতে হয় স্থানীয়জনদের।

প্রতিবেশীদের মানবিক সেবা না করলে মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়তে হয়। বিশেষত ডাক্তারি পেশায় আমরা যারা আছি। তারপরও তো কথা শুনতে হয়। ডাক্তাররা মানুষ নয় কসাইয়ের অধম। আমি হাস্যোচ্ছলে বললাম, আপনাকে কি তাই মনে হয়? ইতিমধ্যে শাকুরের স্ত্রী এসে ঢুকলেন, জানলাম তিনিও পেশায় ডাক্তার, তাকেও যেতে হয়, মানবতার সেবায় ঠাকুরগাঁওয়ে উপরন্তু দুস্থদের দিতে হয় বিনামূল্যে ওষুধ এবং আর্থিক সাহায্য। সে দিনের সকালটাকে আমার কাছে মনে হলো, এই ধরনের শুভ সংবাদ দীর্ঘদিন শুনিনি। পেলাম হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।

বিসিকের চাকরিকালীন প্রথমে ছিলাম গণসংযোগ নির্বাহী পরে সংস্থার উপসচিব, শেষে পেয়েছিলাম প্রকল্প বিভাগের দায়িত্ব। বিভিন্ন জেলায় প্রায়শই যেতে হতো। একবার বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানায় যেতে হয়েছিল। ঘোড়াঘাট কোনো এক সময়ে মোগলদের শাসনাধীন থাকলেও পরবর্তী অনেক বছর বাদে ঘোড়াঘাটকে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ববঙ্গের দিনাজপুরের সঙ্গে যুক্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। যে গ্রাম দিয়ে আমাদের জিপ চলছিল হঠাৎ অভিমানী হয়ে জিপ দাঁড়িয়ে পড়ল। ভর দুপুর। পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল রাস্তার পাশেই চাপকল, পানি খেতে যাওয়ার আগে এক বয়স্ক লোক জিজ্ঞাসা করলেন— ‘কোথা থেকে আসা হলো। কেন আসা হলো, কী উদ্দেশে আসা হলো।’ তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। তিনি জানালেন, আমি সরকারের লোক ছিলাম। কিছুটা সময় লক্ষ্য করলেন জিপটার দিকে, কী ভেবে বললেন, আপনাদের তিনজনকেই আমার বাড়িতে একটু নাস্তা খেয়ে যেতে হবে, আমি বুঝতে পেরেছি জিপটি কাঁচামাটির ভিতর বসে গেছে, আমার ছেলেরা আপনার গাড়িটি ধাক্কিয়ে তুলে দেবে। যেন একটু স্বস্তি পেলাম ভদ্রলোকের কথা শুনে।

মুড়ি, চিঁড়া খেতে খেতে জানতে পারলাম গ্রামটির নাম রামপুর, টুবঘড়িয়া, থানা ঘোড়াঘাট, জেলা দিনাজপুর। তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ ছিলাম। সেই মুগ্ধতার ভিতরেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের ঘোড়াঘাটের দু-একজন কৃতীসন্তান, বিখ্যাত ব্যক্তির নাম যদি জানাতেন। তিনি হাস্যোচ্ছলে জানতে চাইলেন, তাতে আপনার লাভ কী? আপনি কি সাংবাদিক? জিপ দেখিয়ে বললাম, আমি ওসবের কিছুই নই। এমনি মনে হলো তাই জিজ্ঞাস করলাম। ভদ্রলোক বললেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় চোখের হাসপাতাল—লায়ন হাসপাতালের সবচেয়ে বড় ডাক্তার এই গ্রামের ছেলে, তিনি বসেন আগারগাঁওয়ে লায়ন চক্ষু হাসপাতালে, নাম জানতে চাইলে নাম বলার আগে ভদ্রলোক জানালেন, সেই ডাক্তার ভদ্রলোকের গুণের কথা। এই ঘোড়াঘাট এবং আশপাশে গ্রামের লোকদের প্রতিবছর বিনা টাকায় ২০০ থেকে প্রায় ৩০০ লোকের চোখ দেখেন এবং দেখেও আসছেন। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর চোখে ছানিপড়া। ক্যাটারাক হওয়া, দৃষ্টিশক্তি যাদের প্রায় যেতে বসেছে, সেসব দুস্থকে বিনামূল্যে অনেক সময় অপারেশন করেন— তা তো বছরে প্রায় আড়াইশ থেকে সাড়ে তিনশ হিন্দু, মুসলমান, স্থানীয় খ্রিস্টানসহ স্বজনদের সেই সঙ্গে দিয়ে থাকেন ফ্রি কালো চশমা। নগদ অর্থ, আমি আমার কৌতূহলটাকে দমিয়ে না রাখতে পেরে জানতে চাইলাম। সেই ডাক্তার ভদ্রলোকের নামটা কী? অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের সঙ্গে ভদ্রলোক জানালেন, প্রফেসর এম জিয়াউল করিম, গত বছর আমার চোখে গ্লুকোমা নাকি প্যাকো কী যেন হয়েছিল। জিয়া এই ঘোড়াঘাটে এলেই আমার খোঁজ নেন। বললাম, চোখের দুরবস্থার কথা। দিন-দুয়েকের ভিতরে ঢাকা থেকে গাড়িতে ওষুধ, কালো চশমা এবং কয়েকজন চোখের ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলেন ঘোড়াঘাটে, বসালেন আই ক্যাম্প। কোনো ডাক্তারই একটি টাকাও নিলেন না। কথার শেষে জানতে পারলাম তিনি একদা বিএডিসিতে করনিক ছিলেন।

আমার ধারণা, প্রফেসর রাহমাতুল বারী, প্রফেসর আবদুস শাকুর খান, কিংবা ঢাকার লায়ন হাসপাতালের চোখের ডাক্তার প্রফেসর জিয়াউল করিমসহ ঢাকার গ্রিন লাইফ হাসপাতালের প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া যখন তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা যান, তখন তাকেও বিনামূল্যে মানবতার সেবা করতে হয়। অনুরূপভাবে আরেকজনের কথা শুনেছি, তিনি প্রফেসর ডাক্তার শাহিনা সোবহান মিতুর কথা এবং সেতুর কথা। দুই বোনই ডাক্তার। বাড়ি জামালপুরের বকুলতলায়, এরা বোধ করি কসাই নন। কিছুদিন আগে লায়ন হাসপাতালে চোখ অপারেশন করতে গিয়ে সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম প্রফেসর জিয়াউল করিমের এবং প্রচণ্ড রকমের সহযোগিতা।

অপরদিকে অর্থলোভী ডাক্তাররা রোগীকে দুই-তিন মিনিটেই দেখা শেষ করে পরের জনকে ডাকেন, লম্বা সিরিয়াল, রাত ১টা-২টা বাজার পরে হয়তো তখন বউ-বাচ্চাদের কথা মনে হয়। হৃদরোগের ডাক্তার থেকে কর্ণকুহরের ডাক্তারদের ওই একই অবস্থা। অর্থলোভী চিকিৎসকদের অভাব নেই। তবে যাদের জানি, চিকিৎসক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নাকি শপথ নিতে হয়। মানবসেবার অর্থলোভী দুজন ডাক্তারকে একদা ব্যক্তিগতভাবে জানতাম, যারা তাদের চেম্বারে গিয়ে বসতেন, বিকাল ৫টায়, আর বাসায় ফিরে আসতেন মাঝরাতে, পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে। তারা দুজনই প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ গমন সবই ঠিক ছিল, ছিল না ঘরের স্ত্রী, অর্থবিত্ত এক জীবনে যে সুখ এনে দিতে পারে না সেই কথা ভেবেই হয়তো এক ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে। অপর ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী ধরেছিলেন আমার হাত, আসতে চেয়েছিলেন এই অধমের সঙ্গে। তখনকার দিনে সমগ্র দেশেই সুনাম অর্জনের চেয়ে দুর্নাম অর্জন করেছিলেন ডাক্তারদ্বয়, তবে যার স্ত্রী আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন তিনি একদা আত্মঘাতী হয়েছিলেন। ওই দুজনের নাম দীর্ঘদিন পরে বলা সমীচীন নয়। ইতিমধ্যে দুজনই গত হয়েছেন এবং কেউ যদি কখনো জানতে চান বলে দিতে পারি সেই অর্থলোভী ডাক্তারদের নাম।

            লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর