সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইতিবাচক ইচ্ছেগুলোর স্ফুরণ প্রয়োজন

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী


ইতিবাচক ইচ্ছেগুলোর স্ফুরণ প্রয়োজন

বিশ্বখ্যাত নারী-ব্যক্তিত্ব শেরিল স্যান্ডবার্গ ফেসবুকের যিনি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কয়েক বছর আগে তার অসামান্য-প্রেমিক টগবগে যুবক-স্বামীটি হঠাৎ জিমে ব্যায়াম-চর্চার সময়কালে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। শেরিলের কাছে তা ছিল আকস্মিক মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া এক দুর্যোগ যার কোনো তুলনা মেলে না। তার স্বামী-প্রেম এমনি যা বিশ্বের শতভাগ পুরুষই তার স্ত্রী/প্রেমিকার কাছে প্রত্যাশা করে, প্রত্যাশা করে অনেকেই তার সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে হলেও, কিন্তু বেশির ভাগের কপালেই তা জোটে না। শেরিলের স্বামী-রত্নটি ভাগ্যবান, বলা চলে মহাভাগ্যবান—শেরিলের স্বামীর হঠাৎ চলে যাওয়ার পরে তার নিজের বর্ণনায় যা এসেছে গণমাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাতে বলা চলে ওই ভদ্রলোক ছিলেন তার স্ত্রীর বিশ্বসেরা প্রেমিক, আর স্ত্রী-রত্নটি ছিল স্বামীর বিশ্বসেরা প্রেমিকা। সম্ভবত বিশ্বের প্রায়-সব পুরুষই শেরিলের স্বামীটিকে ঈর্ষা করে তার স্ত্রী-ভাগ্য নিয়ে। আসলে শেরিলের স্বামী-প্রেম, তার স্বামীর স্ত্রী-প্রেম এই দুনিয়ার সবচেয়ে ইতিবাচক ঘটনা, সবচেয়ে আশার জায়গা সেটা— মানুষকে প্রবলভাবে শান্তি দেয়, স্বস্তি দেয়, হানাহানির জগতের কুিসত মনের, মানসিকতার দোর্দণ্ড প্রতাপের মাঝে।

শেরিলের স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পরে সন্তানদের নিয়ে নিদারুণ বিপাকে পড়ে যান তিনি, প্রায়-মানসিক-অবসাদগ্রস্ত দশায় চলে যাওয়ার অবস্থা তার। সেই বেদনাবিধুর হতাশার পরিস্থিতি থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী হয়ে, নিজের ভিতরে অসম-সাহসী হওয়ার প্রেরণা সৃষ্টি করে, নিজের হৃদয়ে-মগজে ধারণ করেছেন এক অসাধারণ ইতিবাচক ভাবনার চেতনা যার তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’-র সেই মহান-দর্শন বাণী— “সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।” এই মহান নারী শেরিল সেই রকম ‘কঠিন-সত্য’ জীবন-দর্শন নিয়ে সন্তানদের বুকে আগলে রেখে বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করেছেন— এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে। শেরিল বলেন, “যদি এর চেয়েও খারাপ কিছু হয়ে যেত তার এবং তার সন্তানদের জীবনে, তাহলে তো তা-ও মেনে নিতে হতো।” তাই তিনি স্বামীর সেই অসহায় মৃত্যুকে মেনে নেন জীবনের এক অনিবার্য ট্র্যাজেডি হিসেবে। তিনি সবাইকে পরামর্শ দেন, প্রত্যেকে যেন নিজের জীবনের প্রতিটি ঘটনা/দুর্ঘটনায় ভেঙে না পড়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করে সাহসের সঙ্গে লড়ে যান, জীবনের পরের দিনগুলোকে সফল করার লক্ষ্যে, নিজের সন্তানদের মানুষ করতে, স্বজনদের প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি বহু বক্তৃতায় ও লেখায় দুনিয়ার হতাশাগ্রস্ত লাখো মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়েছেন, তার ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। অগণন মানুষ তা থেকে যে ইতিবাচক দিনযাপনের প্রেরণা নিয়েছেন তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না এবং এমন অনেক মহামানবই তাদের ‘ইতিবাচক’ জীবন-দর্শনের প্রেরণা দিয়েছেন মানবসমাজকে যুগে যুগে। শেরিল স্যান্ডবার্গ/শ্যেনবার্গ বিশ্বসেরা শত-ব্যক্তিত্বের মধ্যে স্থান পেয়েছেন, তিনি সেই মাপের ব্যক্তিত্বই বটে। শেরিল উন্নত-বিশ্বের এমন এক রাষ্ট্র, এমন এক সমাজে বাস করেন যেখানে মানবিক সমাজ আছে, যেখানে মানুষ সুশাসন পায়, ন্যূনতম বিচার-সুবিধা পায়, নিজের শ্রম বিক্রি করে ন্যূনতম মজুরি পায়, যেখানে নিজের মেধার, নিজের উদ্যমী উদ্যোগের মূল্য পায়, যেখানে নারী-পুরুষে ভেদ নেই। মোট কথা, ওই সমাজে প্রতিটি নাগরিক নিজের চেষ্টায়ও শিক্ষালাভ করে, নিজে মানুষের মতো বাঁচার মতো উপার্জন করতে পারে। নিজের চেষ্টায় ব্যবসায়-বাণিজ্য বা শিল্প-উদ্যোগ গড়ে তুলে তা দাঁড় করাতে পারে, রাষ্ট্র তাতে সহযোগিতা করে অকাতরে।

কীভাবে ওইসব রাষ্ট্র ও সমাজ নাগরিকদের জন্য এসব সুযোগ সৃষ্টি করল? উন্নত-দুনিয়ার এসব দেশে সঠিক জনপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সরকার-ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, বেশির ভাগ দেশেই যথার্থ গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে, আমাদের মতো ‘মেকি-গণতন্ত্র’ নিয়ন্ত্রিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় না তাদের সরকার-প্রশাসন ব্যবস্থা। ফলে তারা প্রত্যেকেই শেরিলের ‘ইতিবাচক জীবন-চর্চার’ সুযোগ নিতে পারে সহজে। কিন্তু আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোর অগণতান্ত্রিক সমাজে যেখানে অবিরাম বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিদ্যমান, সুশাসনের বদলে নিদারুণ কুশাসন বহাল তবিয়তে রয়েছে যেখানে, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি-চর্চায় যেখানে নিদারুণ দারিদ্র্য বিরাজমান, যেখানে অনেক কষ্টে শিক্ষা লাভ করেও উপযুক্ত কর্মসংস্থান হয় না, ব্যবসায়-উদ্যোগ বা শিল্প-উদ্যোগ তো দূরের কথা, সর্বোচ্চমানের মেধা ও পরিশ্রমের ক্ষমতা থাকলেও একটা উপযুক্ত কাজ জুটিয়ে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থাটুকুও হয় না সহজে, যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরে অশেষ দুর্বৃত্তায়ন নিরীহ, ভদ্রজনকে পীড়ন করে চলে অবিরাম, সেই সমাজে কে কতটা ইতিবাচক-দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারবে মনে-প্রাণে!

আমাদের বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে— আগামী বছর-পাঁচেকের মধ্যেই তা সম্ভব হতে পারে হয়তো। আর মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হতে হয়তো আরও বছর দশেক (বা কাছাকাছি) লাগতে পারে। কিন্তু এই দেশটিতে সুশাসন বলতে কি কিছু আছে!

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসছে, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক-বিতণ্ডা— সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিয়ে। নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক, সব দলের জন্য ‘লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি ইত্যাদির জন্য ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’ অপরিহার্য কিনা তা নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে। তবে আমাদের আশঙ্কা অন্য জায়গায়। এ নির্বাচনটি সুষ্ঠু হলেও কি সুশাসন আসবে! না, আসবে না। আমরা দেখেছি— ১৯৯১ সালের নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের (দ্বিতীয়) নির্বাচন বা ২০০১ সালের নির্বাচন মোটামুটি (প্রায় নব্বই শতাংশ) সুষ্ঠু হয়েছিল, কিন্তু মানুষ কি ওই সরকারগুলোর কাছে সুশাসন পেয়েছিল? না, পায়নি। কারণ, সরকারের ভিতরের রাজনীতিকদের মধ্যে এবং তাদের সহায়ক প্রশাসন-পরিচালনাকারী আমলা-গোষ্ঠীর মধ্যে দুর্বৃত্তায়নের বিষের এতটুকু ঘাটতি ছিল না। এখনো যে তার কোনো পরিবর্তন হবে সে ভরসা কোথায়!

তবে ভরসার একটা জায়গা আছে—যদি সে সঠিক কাজটি করে যথাসময়ে। আমাদের তারুণ্যের মধ্যে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা; বিশেষভাবে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত তরুণরা দেশে-বিদেশে মেধা ও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছে নাসা ও অন্যসব বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা-কর্মে। আমাদের বরগুনার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের উঁচু-মেধাবী তরুণ-বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার রসায়ন শাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করে এখন আমেরিকার ‘নাসা’-র মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা-কর্মে বিশাল অবস্থান লাভ করেছেন যা বাংলাদেশের গর্ব। আমাদের দেশের তিন-কন্যা (রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও ড. রুপা হক) ব্রিটেনে দুবার এমপি নির্বাচিত হয়ে তাদের রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। আমাদের দেশের তরুণ এখন বিশ্বসেরা মডেলের তালিকায় উঠেছেন— মুম্বাইয়ে তার জয়জয়কার। আমাদের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মাশরাফি-রা সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের মাকসুদুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) পাটের ‘জিন’ আবিষ্কার করে বিশাল অবদান রেখেছেন কৃষি উৎপাদনের গবেষণায়। গলফ-বয় থেকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বিশ্বমানের গলফার (গলফ-খেলোয়াড়) হয়েছেন বাংলাদেশের অদম্য-তরুণ সিদ্দিকুর রহমান। আমাদের দেশের এক তরুণ-শিল্পী নাফিজ বিন বাশার (শিল্পী মোস্তফা মনোয়ারের পরিবারের নিকটাত্মীয়) অ্যানিমেশন-ফিল্মে (কার্টুন-ফিল্মে) বিপুল মাপের কাজ করে ফেলেছেন, তিনি বিশ্বখ্যাত অস্কার পুরস্কার জিতেছেন। এভাবে বিশ্বসভায় আমাদের তরুণ-যুবারা  মেধা ও দক্ষতার, শ্রমদানে অধ্যবসায় ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করে চলেছে। আমাদের ছাত্র-তরুণ-সমাজই ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের স্বাধিকার-আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে উজ্জ্বল অবদান রেখেছে আমাদের জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েও ছাত্রসমাজের অবদান বিশাল। সেই শিক্ষিত তরুণ সমাজই পারে আমাদের দেশে নবরাজনীতির উন্মেষ ঘটাতে। আমাদের দেশের রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র যখন দুর্বৃত্তায়নে ডুবুডুবু-দশায়, যখন দেশে রাজনীতির নামে, আমলা-প্রশাসনের কাজের প্রক্রিয়ার নামে লুটপাটতন্ত্র চলে অবাধে, সাধারণ মানুষ যখন প্রশাসনিক জটিলতায় রাষ্ট্রীয় বিধিসম্মত সুযোগ-সুবিধা পেতে ব্যর্থ সারাক্ষণ, যখন এই সমাজে এতটুকু ইতিবাচক জীবন-ভাবনার সুযোগ নেই আমাদের কাছে, তখন একমাত্র শিক্ষিত তরুণ সমাজ ও উচ্চ বিদ্যায়তনের ছাত্ররা পারে প্রতিবাদের বজ্রমুষ্টি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রুখে দাঁড়াতে। তারা পারে একটা নতুন জাগরণ ঘটাতে, একটা উজ্জীবন ঘটাতে, রাজনীতির ও আমলা-প্রশাসনের মধ্যকার দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে, এক সুশাসন-চেতনার উন্মেষ। সেই পরিস্থিতিতেই আমরা মহান-নারী শেরিলের এবং তারই মতো অন্যসব মহান ব্যক্তির জীবন-দর্শন  ‘ইতিবাচক জীবন-ভাবনা’-এর প্রেরণা হৃদয়ে-মগজে ধারণ করে সামনে এগোতে পারব, অন্যথায় কখনই নয়।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর