কারবালার প্রান্তরে রসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার পরিবার-পরিজন পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সৈন্য দলের হাতে প্রাণ হারান। ১০ মহররমের পবিত্র আশুরার দিন এ হত্যাকাণ্ডের কারণে শোকাবহ দিন হিসেবে বিবেচিত হয় মুসলিম উম্মাহর কাছে। চতুর্থ খলিফা ও রসুল (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.)-এর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত হাসান (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন। সিরিয়া ও মিসরের শাসক মুয়াবিয়া হাসান (রা.)-কে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। হজরত হাসান (রা.) মুয়াবিয়ার (রা.) বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার কূটকৌশলে সে বাহিনী বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে। এ অবস্থায় হজরত হাসান (রা.) ইসলামী খিলাফতের ঐক্য রক্ষায় মুয়াবিয়ার (রা.) সঙ্গে আপস-মীমাংসার উদ্যোগ নেন। দুই পক্ষের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় হজরত হাসান (রা.) খিলাফত ত্যাগ করবেন এবং তার বদলে মুয়াবিয়া (রা.) নতুন খলিফা হবেন। তবে মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর খলিফা হবেন হজরত হাসান (রা.)-এর ছোট ভাই হজরত হোসাইন (রা.)।
হজরত হাসান (রা.) মুয়াবিয়ার (রা.) সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পর মদিনায় ফিরে যান। মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদের প্ররোচনায় হজরত হাসান (রা.)-কে তার স্ত্রী বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। এ হত্যার উদ্দেশ্য ছিল খেলাফতের দাবি থেকে হজরত আলী (রা.) তথা নবী (সা.)-এর বংশ হাশেমীয়দের বঞ্চিত করা।
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ৬৭৯ সালে হজরত হাসান (রা.)-এর সঙ্গে তার সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে নীতিজ্ঞানহীন মদ্যপ ও দুশ্চরিত্র পুত্র ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকার নিয়োগ করেন। এ নিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মদিনার বিশিষ্টজনরা। মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর ইয়াজিদ ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানান। প্রথমদিকে আপত্তি করলেও হজরত আবু বকর (রা.)-এর পুত্র আবদুর রহমান ও হজরত ওমর (রা.)-এর পুত্র আবদুল্লাহ ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু হজরত ইমাম হোসাইন নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পাপাসক্ত ইয়াজিদের কাছে মাথানত করতে রাজি হননি।মক্কা ও মদিনার মুসলমানরা আগে থেকেই উমাইয়া শাসক গোষ্ঠীর অনৈসলামিক রীতিনীতি ও পাপাচারে ক্ষুব্ধ ছিল। ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণ তাদের ক্ষোভ বৃদ্ধি করে। তারা খলিফা হিসেবে মহানবীর (সা.) নাতি ইমাম হোসাইনকে সমর্থন জানায়। ফলে পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের সঙ্গে হজরত হোসাইন (রা.)-এর সংঘাত দানা বেঁধে ওঠে। কুফার অধিবাসীরা ইয়াজিদি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। হজরত হোসাইন (রা.)-কে তারা কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। তিনি তার পরিবার-পরিজনসহ কুফার উদ্দেশে রওনা করলে ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় ইয়াজিদ বাহিনী তাদের অবরুদ্ধ করে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর পরিবারের সব পুরুষ সদস্য ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নিহত হন। হোসাইন (রা.) তাঁর এক শিশুপুত্রের তেষ্টা মেটাতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে ফোরাত নদীর দিকে যাওয়ার সময় ইয়াজিদের সৈন্যদের তীরের আঘাতে কোলের মধ্যে সে মারা যায়। এ সময় তিনি বসে পড়েন এবং ইয়াজিদি সৈন্যের ছোড়া বর্শার আঘাতে প্রাণ হারান। মহানবী (সা.)-এর চাচা হামজার লাশ চিরে কলিজা বের করে চিবিয়েছিল উমাইয়া দলপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। কারবালার প্রান্তরে নবী বংশের ওপর একই ধরনের নৃশংসতা প্রদর্শন করে হিন্দার দৌহিত্র পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সৈন্যরা। তারা হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) লাশের মস্তক কেটে ফেলে। তার পবিত্র দেহকে পদদলিত করার ধৃষ্টতাও দেখায়। হোসাইন (রা.)-এর খণ্ডিত মস্তক ইয়াজিদের নিযুক্ত গভর্নর ওবায়দুল্লাহুর পদতলে উপস্থিত করা হয়।
কারবালা যুদ্ধের পর ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ও মদিনায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইয়াজিদ বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে মহানবী (সা.)-এর প্রিয় নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। চার খলিফার আমলে খেলাফতের রাজধানী মদিনায় যেসব মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্থাপনা তৈরি হয়েছিল সেগুলো বিনষ্ট করা হয়। মদিনাবাসীর ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয়। ইতিহাসবিদ আমির আলীর মতে, “যে শহর রসুলে খোদাকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং যা তার জীবন ও কার্যকলাপের সংস্পর্শে পবিত্রতা অর্জন করেছিল তা সম্পূর্ণরূপে অপবিত্র হলো।”
মদিনা ধ্বংসের পর পাপিষ্ঠ উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া বাহিনী পবিত্র নগরী মক্কা আক্রমণ করে। দুই মাস ধরে মক্কা অবরোধ করে রাখে পাপিষ্ঠরা। তারা ইসলামের পবিত্রতম মসজিদ কাবাগৃহে অগ্নিসংযোগ করে। ইতিহাসবিদ হিট্টি বলেন, “অবরোধকারীরা কাবাগৃহে অগ্নিসংযোগ করে, পবিত্র কৃষ্ণপ্রস্তুর তিন খণ্ড হয়ে যায়। কাবাগৃহ ক্রন্দনরত রমণীর ভগ্ন হৃদয়ের রূপ লাভ করে।”
পবিত্র মক্কা নগরীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় পাপিষ্ঠ শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ মক্কায় পৌঁছে। ফলে ইয়াজিদ বাহিনী তাদের নৃশংস অভিযান বন্ধ করে দামেস্কে ফিরে যায়।
ইতিহাসবিদ উইলিয়ামস মূর বলেন, “ইয়াজিদের (সাড়ে তিন বছরের) রাজত্বকালে ইসলামের কোনো প্রসার ঘটেনি।” ইতিহাসবিদ ইবনুত তিকতাকা বলেন, ‘ইয়াজিদ সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করেন। প্রথম বছরে তিনি হজরত আলীর পুত্র হোসাইন (রা.)কে হত্যা করেন। দ্বিতীয় বছরে মদিনা আক্রমণ করে ধ্বংস এবং তৃতীয় বছরে কাবা শরিফ বিধ্বস্ত করেন।’
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।