শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আলু সংরক্ষণে প্রাকৃতিক হিমাগার

শাইখ সিরাজ

আলু সংরক্ষণে প্রাকৃতিক হিমাগার

এই তো কিছু দিন আগের খবর। বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের কৃষক হিমাগারে আলু রেখে পড়েছেন লোকসানের মুখে। আলু নিয়ে প্রতি বছর আমরা দেখি কৃষকের লোকসানের চিত্র। এ দেশে আলু বেশি উৎপাদন হওয়ার কারণে আলু নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আলু নিয়ে বাড়ে উদ্বেগ। উৎপাদন খরচের সঙ্গে আলুর দামের তারতম্যের কারণে কৃষকের পড়ে মাথায় হাত। এ যেন প্রতি বছর অবিকল একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিনিয়োগ করে কৃষক আলু আবাদ করে সমূহ ক্ষতির শিকার হয়। কৃষক পাশে কাউকে না পেয়ে তারা রাস্তায় আলু ঢেলে প্রতিবাদ করে। এ ছাড়া নানান প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে।

দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী আলু আবাদি এলাকা মুন্সীগঞ্জে এমন চিত্র আগেও দেখেছি। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে সবজি-ফসল উৎপাদন পর্যায় পর্যন্ত সাফল্য ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ কথা ঠিক, এক মৌসুমে একটি ফসলে লাভের মুখ দেখলে পরের মৌসুমে হাজারো কৃষক ঝুঁকে পড়ে সেই ফসলে। এতে সেই ফসলের উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বাজার চাহিদা স্বাভাবিক থাকলে কৃষক লাভ পায়, উৎসাহ টিকিয়ে রাখতে পারে, স্বাভাবিক না থাকলে কৃষকের পুঁজিপাট্টা জলে যায়। পরে সে ধার-দেনা করে লাভজনক ফসল খুঁজতে থাকে। এ ক্ষেত্রে কৃষক বরাবরই অসহায়। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। বাজার মূল্যের নিশ্চয়তা সরকারের কাছেও নেই। ফসল চাষ-পূর্ববর্তী পর্যাপ্ত গবেষণা ফসল আবাদ বিষয়ে কৃষকদের উদ্দেশে কোনো দিকনির্দেশনার ব্যবস্থাও নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আলু উপদেষ্টা বোর্ড রয়েছে। ওই বোর্ড চাইলেই মৌসুমভিত্তিক আলু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, উৎপাদন পরিস্থিতির আগাম পর্যালোচনা, সংরক্ষণ-ব্যবস্থা ও বাজার মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। কিন্তু কার্যত এর কোনো প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না।

প্রিয় পাঠক! আলু নিয়ে কৃষকের এই বিড়ম্বনার অন্যতম একটি জটিল জায়গা হচ্ছে হিমাগারে সংরক্ষণের বিষয়টি। নিজের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করতে না পারার কষ্টে কৃষক নাজেহাল হয় পদে পদে। এক মৌসুম থেকে আরেক মৌসুমে যাওয়ার আগে কিছুটা লাভের আশায় আলু সংরক্ষণ করার সুযোগ সে পায় না। এ প্রসঙ্গে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সিডিপির (ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রোগ্রাম) আলু সংরক্ষণের একটি প্রাকৃতিক উদ্যোগের কথা। মুন্সীগঞ্জে বাঁশের মাচাঘর করে আলু রাখার একটি পদ্ধতি চালু করেছিল তারা। বাঁশের বাতা দিয়ে ফাঁক রাখা হয়েছিল প্রাকৃতিক বাতাস ও আলো ঢোকা আর বের হওয়ার জন্য। তবে এ পদ্ধতিতে একজন কৃষক সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করতে পারে, যা বাজার ধরার জন্য যথেষ্ট সময় নয় বলে কৃষক মনে করে। যা বলছিলাম লেখার শুরুতে, বগুড়ায় হিমাগারে আলু রেখে লোকসানের মুখে পড়েছেন বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের কৃষক। এ অঞ্চলে কমেই চলেছে আলুর দাম। জাতভেদে প্রতি বস্তা আলুতে কৃষকের ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। সে কারণে হিমাগার থেকে আলু তুলছেন না অনেক কৃষক। অন্যদিকে যেসব কৃষক হিমাগারে আলু রেখে ঋণ নিয়েছিলেন তারা ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় হিমাগার কর্তৃপক্ষ কৃষকের বিরুদ্ধে নোটিস পাঠাচ্ছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে কৃষক। সাধারণত বছরের এই সময়টিতে এ অঞ্চলে হিমাগারের ৮০ শতাংশ আলু বের হয়ে যায়। সেখানে ৩০ শতাংশ আলু বের করতে পারেনি কৃষক। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানাচ্ছে, দেশে ১ কোটি টনেরও বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে যার মধ্যে ৩৯০টি হিমাগারে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে।

পাঠক! বছর দুয়েক আগে আমি আধুনিক কৃষির সূতিকাগার নেদারল্যান্ডসে গিয়েছিলাম। নেদারল্যান্ডস সরকারের আমন্ত্রণে সেই সফরে কৃষির বেশ কিছু অত্যাধুনিক কার্যক্রম, হাইটেক ফার্মিং, গ্রিনহাউস অপারেশন দেখার সুযোগ হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন বিখ্যাত ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। চিত্র ধারণের একপর্যায়ে আমার কাজ পড়ে টেসেলে। ছোট্ট একটা দ্বীপ, যাকে অনেকে ভেড়ার রাজ্যও বলে। নর্থ সির কিছুটা পার হয়ে যেতে হয় সেই দ্বীপে। টেসেলে লবণসহিষ্ণু ফল-ফসল, ভেড়ার খামার ইত্যাদি বিষয়ে কাজ সেরে রওনা হই লেলিস্টাড নামের এক শহরের দিকে। আপনারা জানেন নেদারল্যান্ডস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক নিচে থাকা একটি দেশ। যখন যাচ্ছিলাম লেলিস্টাডে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে বিশাল লেক দেখছিলাম। কী দারুণ সুন্দর। সেতু পার হয়ে দিগন্তজোড়া মাঠ। প্রকৃতির অপার এক সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে চলছিলাম। সঙ্গে ছিলেন পুরনো বন্ধু বাংলাদেশে অবস্থিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক প্রতিনিধি অ্যাড স্পাইকার্স। খুব ভোরেই লেলিস্টাডের দিকে যাত্রা করেছি বলে প্রকৃতির এই অপরূপ চিত্র যেন আমাদের সামনে নিজেই মেলে ধরছিল ধীরে ধীরে। পৌঁছলাম পিপিও লেলিস্টাড নামের এক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। কৃষি নিয়ে গবেষণা এখন এত উচ্চ পর্যায়ে গিয়েছে তা ভাবাই যায় না। আর এটি পরিচালনা করছে ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়।

ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা হাব বলা চলে এই সেন্টারটিকে। ব্রিডিং, চাষ পদ্ধতি, মাটি পরীক্ষা, গ্রিনহাউস, উইন্ড টারবাইন, জৈব বালাইদমন পদ্ধতি, কীটনাশকের ব্যবহার— পৃথিবীর আধুনিকতম কৃষি গবেষণা চলছে এখানে। নতুন সব ফসল নিয়ে ল্যাবগুলোয় চলে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গবেষণা কেন্দ্রে জীববৈচিত্র্য নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ছিলেন ওয়ান ডো হুপ। লেলিস্টাডের ফ্লেভোল্যান্ডে অবস্থিত এই গবেষণা কেন্দ্রটি প্রগতিশীল কৃষককে বেশ সহযোগিতা করে আসছে। সে রকম একজন কৃষকের সঙ্গেও পরিচয় হলো। নাম হ্যারি শ্রুডার। তার পরিচয় তিনি একজন আলু চাষি। আর এই লেখায় তাকে যুক্ত করার কারণ লেলিস্টাডের সহযোগিতায় তিনি আলু সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার ব্যবহার করছেন। যেখানে প্রকৃতি আর প্রযুক্তির মিশেলে সংরক্ষিত হয় ফসল। হ্যারি ৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করেন আলু, সুগার বিট, পিয়াজ, গম আরও কত কী! তবে আলুই তার প্রধান ফসল। আর তার সংরক্ষণের জায়গাটি তার অর্থ জোগানের প্রধান কেন্দ্র। আমরা যেখানে সর্বোচ্চ আড়াই মাস পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করতে পারি প্রাকৃতিক হিমাগারে, সেখানে হ্যারি তার প্রাকৃতিক সংরক্ষণ কেন্দ্রে আলু রাখতে পারেন ছয় মাস। এটি কৃষকের জন্য একটি বিরাট পাওয়া। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন ফসল তোলার সময় ছিল না। প্রতি হেক্টরে ৬০ টন আলু উৎপাদন হয় তার জমিতে। পাঠক! প্রতি হেক্টরে যেখানে আমাদের দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ২০-২৫ টন। হ্যারি তার জমিতে আলাদা করে কোনো সেচ দেন না। তবে হ্যারি বলছেন, প্রাচীন কৃষিই আসলে সবকিছুর উৎস। কৃষকের ছেলে হ্যারি বললেন, নেদারল্যান্ডসের উত্তরাঞ্চলে তাদের আদিবাস। ১৯৬৭ সালে তার বাবা ফ্লেভোল্যান্ডে চলে আসেন এবং আরও বিস্তৃত কৃষিতে মনোনিবেশ করেন। তার কোল্ড স্টোরেজ নিয়েও অনেক কথা হলো। তবে সেটা ভিতরে গিয়েই। হ্যারি বলছেন, ১০ টন এদিক-ওদিক নষ্ট হয়। জলবায়ু পরিবর্তনকেই দূষলেন হ্যারি। সবচেয়ে বড় কথা এখানে পানির কোনো অভাব নেই। তাই সেচের পেছনে বাড়তি টাকার বিনিয়োগ নেই। কথা বলতে বলতে প্রাকৃতিক কোল্ড স্টোরেজে ঢুকে পড়লাম। হ্যারি পুরো প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা দেখালেন আমাকে। স্টোরেজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানালা খোলে, বন্ধ হয়। আলু, সুগারবিট, গাজর— যে ফসলের জন্য যখন যতটা বাতাসের প্রয়োজন, তা-ই সম্ভব এই প্রাকৃতিক স্টোরেজে। এই স্টোরেজে ৭০০ টন পর্যন্ত ফসল মজুদ করা সম্ভব। এখানে আবার হিটারের ব্যবস্থাও রয়েছে। পাঁচটি বড় ফ্যানই পিয়াজের জন্য কাজ হয়ে যায়। আলুর জন্য তিনটি ফ্যান। যা চালায় প্রাকৃতিক বাতাস। স্বয়ংক্রিয় হচ্ছে শুধু ভিতরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য কম্পিউটারের সাহায্যে অটোমেটিক জানালা খোলা-বন্ধের বিষয়টি। এ ছাড়া পুরো বিষয়টি ঘটছে প্রকৃতির সাহায্যে। ময়েশ্চার (আর্দ্রতা), ভেনটিলেশন (বাতাস সঞ্চালন), তাপমাত্রা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। হ্যারির মতে বাংলাদেশেও এমন কোল্ড স্টোরেজ সম্ভব যদি উন্মুক্ত মাঠ পাওয়া যায়।

প্রিয় পাঠক! হ্যারির প্রাকৃতিক আলু বা অন্য ফসলের সংরক্ষণাগার দেখে অভিভূত হলাম। ভাবলাম এমন তো আমার দেশেও সম্ভব। আলু উৎপাদনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আলু সংরক্ষণ। কৃষক যেখানে হিমাগারের দেনা শোধ করতে না পেরে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশে, সেখানে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় উন্মুক্ত প্রান্তরে এমন প্রাকৃতিক হিমাগার তো হতেই পারে। ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখার মতো নানা কর্মসূচি নিয়ে আমরা কথা বলি। সেখানে এ রকম একটি অভিনব উদ্যোগ যা স্বল্প খরচেই সম্ভব, তা আমরা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতেই পারি। এবারও আলুর ব্যাপক ফলন হয়েছে। হিমাগারে তো আছেই, কৃষকের ঘরেও মজুদ রয়েছে বিপুল আলু। কিন্তু প্রাকৃতিক হিমাগার যে পুরো আলু উৎপাদন-পরবর্তী বাজারজাতকরণের চিত্র বদলে কৃষককে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে, তার ফসলের নিরাপত্তা দিতে পারে, তা ভাবার এখনই সময়। যত দ্রুত এসব দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে, ততই মঙ্গল।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর