শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের নতুন ধোঁকা

মেজর আখতারুজ্জামান (অব.)

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের নতুন ধোঁকা

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যে প্রকাশ্য বৈঠক ডেকেছিল তা কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনায় কখনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির নেই। ফলে অশ্বডিম্ব প্রসবই সার হয়েছে। দেশীয় গণমাধ্যমে ঘটা করে প্রচার হয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার খবর।  বলা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্ক বা আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। ৯টি দেশের অনুরোধে ডাকা হয়েছে ওই বৈঠক। ওই ৯টি দেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য শুনতে চায়। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানার জন্য এ বৈঠক। এজেন্ডা থেকেই বোঝা যায় সেখানে মহাসচিব যে রিপোর্ট পেশ করেছেন তার ওপর উন্মুক্ত বিতর্ক হয়েছে। বিতর্কে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পেয়েছে, ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণের ভাষ্য অনুযায়ী আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখার অঙ্গীকারের কারণে। এর ফলে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা টিকিয়ে রেখে ত্রাণবাণিজ্য অব্যাহত রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে এমনটিই ভেবেছে জাতিসংঘ। পক্ষান্তরে মিয়ানমার বিতর্কে অংশগ্রহণ করে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নয়, তারা বাঙালি অনুপ্রবেশকারী এবং সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতির কথাও নিরাপত্তা পরিষদকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত আলোচনা বা বিতর্কে পাল্টাপাল্টি প্রশ্নের কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু মিয়ানমার যে বক্তব্য দিয়েছে তা বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দেওয়ার ক্ষেত্রেই কার্যত ভূমিকা রেখেছে। তাই এ উন্মুক্ত আলোচনা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা উদ্বাস্তু সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি নিতে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনের জন্য সহায়ক হবে এই উদ্দেশ্যমূলক বৈঠক।

ইতিমধ্যেই মানবিকতার নামে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে জামাই আদর দেওয়া হচ্ছে তাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে আর অত্যাচার করতে হবে না, এমনিতেই সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসবে। তার ওপরে বাংলাদেশে তো দলমত নির্বিশেষে সবাই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয় ও ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা ঐক্যবদ্ধভাবে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন ও দেশের সুধী সমাজ কেউই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেনি। সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে ১০০ ভাগ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন যে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তে জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন। আগামীতে দেশে ও বিদেশে কেউই প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তের বিরূপ কোনো সমালোচনাও করতে পারবে না। যদিও শুরু থেকে আমরা কেউ কেউ (যদিও খুব নগণ্য সংখ্যক) বলে আসছি, সরকারের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী এবং চীন-ভারতের পাতানো ফাঁদে পা দেওয়া। রোহিঙ্গারা কখনই আর বাংলাদেশ থেকে নিজেরা যাবে না আর মিয়ানমারের নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

নিরাপত্তা পরিষদের বৃৃহস্পতিবারের আলোচনায় রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যার কোনো সমাধান এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। বিষয়টি শুধু আলোচিত হয়েছে মাত্র। সিদ্ধান্ত না আসায় মিয়ানমারই লাভবান হয়েছে। ফলে চীন বা রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই হয়নি। তবে যদি জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্ট ও তার ওপর উন্মুক্ত বিতর্ক না দিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগের ওপরে মিয়ানমার সরকারের জবাব দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের কার্যধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত সভা আহ্বান করা হতো তাহলে সমাধানটি বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবশ্যই আসত এবং তখনই চীন-রাশিয়ার ভেটোর প্রশ্ন আসত।

তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিরাপত্তা পরিষদের নিয়ম অনুযায়ী একটি বিবৃতি দিতে পারত, যা রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যার সমাধানের একটি পথ বেরিয়ে আসত।

এ উন্মুক্ত আলোচনা বা বিতর্ক না করে নিরাপত্তা পরিষদ যদি তাদের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় বা বাংলাদেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গা ত্রিপক্ষীয় আলোচনা বা ডায়ালগের ব্যবস্থা করত তাহলে রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যার সমাধানের একটি পথ বেরিয়ে আসত। কিন্তু সরকারের ভুল কূটনৈতিক কৌশল এবং বিদেশি উদ্বাস্তু ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দেওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের জাতিগত সমস্যার সমাধানের পথ আলোচনার মাধ্যমে অর্জনের সুযোগ দৃশ্যত রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন বাকি থাকছে সংঘাত বা যুদ্ধের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতিগত সমস্যার সমাধানের পথে হাঁটা। আমি ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গাদের তথা মানবতা ও শান্তির জন্য যুদ্ধের পক্ষে। যেমন ছিলাম ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদারদের বিপক্ষে। সেদিন বয়স কম ছিল বলে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম কিন্তু ৬৭ বছর বয়সে তা এখন পারছি না।  তবে রোহিঙ্গা যুবক ও তরুণদের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, যদি সাহস থাকে তাহলে নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়। জয় হবেই হবে।  আমি বিশ্বাস করি শক্তির বিপক্ষে শক্তি ছাড়া টিকে থাকা যায় না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

 

সর্বশেষ খবর