শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুসলমানের দুয়ারে ফিরে এলো কারবালা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মুসলমানের দুয়ারে ফিরে এলো কারবালা

নাফ নদের তীরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে লাশের গন্ধ। ওপারে ঘর পুড়ছে, পুড়ছে মুসলমানও; এপারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে কাটছে মুহাজিরদের জীবন। শুধু রোহিঙ্গাই নয়, লাখো কোটি মুসলমান আজ ঘরহারা, সহায়হারা শরণার্থীর জীবনযাপন করছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, লেবাননসহ সর্বত্রই আজ মুসলমানরা নির্যাতিত-নিপীড়িত।  এসব মুসলমানের দুর্ভোগ কাটাতে এগিয়ে আসছে না সামর্থ্যবান মুসলিম দেশগুলো। মুসলিম সংগঠনগুলোও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। ওআইসি, রাবেতা আলমের মতো সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কার্যকরী উদ্যোগ নেই। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলা হজের খুতবায়ও বলা হয়নি রোহিঙ্গা মুহাজিরদের জন্য একটি শব্দ।

এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ সম্পদ মুসলমানদের হাতে। তেল, গ্যাস, সোনা, কয়লার মতো প্রাকৃতিক সম্পদগুলো আল্লাহতায়ালা মুসলিম ভূখণ্ডে দান করেছেন। মুসলমানদের এত এত সম্পদ দিয়েছেন যাতে তারা পৃথিবীতে মানবতা এবং সাম্যের চর্চা করতে পারে। নিজের খাদ্য-বস্ত্র অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আজ ধনাঢ্য মুসলিম দেশগুলো নিজেদের পেট ও পীঠ বাঁচাতেই ব্যস্ত। নির্যাতিত মুসলমানদের দিকে ফিরেও দেখছে না তারা। আরও ভয়াবহ কথা হলো, কেউ কেউ নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মুসলিম নিধনের ইন্ধন জোগাচ্ছে। নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করছে। মুসলমানে মুসলমানে লড়াই বাঁধিয়ে দিচ্ছে। নির্যাতিত মুসলমানদের আহাজারি শুনেও তারা না শোনার ভান করে নিজেদের গদি আঁকড়ে পড়ে আছে।

ক্ষমতার জন্য অন্য মুসলমানদের ভুলে যাওয়া এটা কোনো নতুন ইতিহাস নয়। নিজের ভাইকে মেরে গদি দখল করা শত শত বছরের কলঙ্কিত মুসলিম ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি মাত্র। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ ইমাম হোসাইন (রা.)কে হত্যা করে পাপের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, তেমনি আজও মুসলিম নেতারা মুসলমানদের হত্যা করেই নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখছে। ইয়াজিদ বাহিনী যখন হোসাইন (রা.)কে হত্যা করেছে, তখনো ফোরাতের তীরে, ইরাক শহরে, দামেস্ক রাজ্যে কোটি মুসলমান বেঁচে ছিল। অথচ তারা কেউই নবীর নাতির পক্ষে দাঁড়ায়নি। হাজার হাজার মুসলমানের মুখোশপরা ইয়াজিদ সৈন্য ফোরাতের তীর অবরুদ্ধ রেখে একফোঁটা পানিও নবী পরিবারকে পান করতে দেয়নি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হোসাইন (রা.) আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হাল মিন নাসরিকুম। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ আছ কি?’ এ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো একজন মুসলমানও ফোরাতের তীরে ছিল না সেদিন। ইমাম হোসাইন ধর্মের জন্য শহীদ হয়ে প্রমাণ করে গেছেন, নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষেই তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। যুগে যুগে নির্যাতিত মুসলমানের কণ্ঠেই তিনি সুর ফোটাবেন—‘হাল মিন নাসরিকুম অর্থাৎ আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ আছ কি?’

আফসোস! আজ মুসলমানদের দুদর্শা দেখে মুসলমানরাই আরও দূরে সরে যায়। অথচ কথা ছিল, মুসলমানের পাশে মুসলমান এসে দাঁড়াবে সবার আগে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল মুসলিমু কা জাসাদিল ওয়াহিদি। পৃথিবীর সব মুসলমান হলো একটি দেহের মতো।’ এরপর রসুল (সা.) বলেন, দেহের এক অঙ্গে ব্যথা হলে যেমন পুরো দেহই কষ্ট পায়, তেমনি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে একজন গরিব মুসলমানও যদি কষ্ট পায় তবে অপর প্রান্তের সম্ভ্রান্ত মুসলমানের হৃদয়ও কেঁদে উঠবে। অথচ আজ ঘরের পাশেই মুসলমানের দুর্ভোগ আমাদের সবার চোখে পড়ছে না। সত্যি বলতে কী, মুসলমানরা যদি দরদি হৃদয়ের চর্চা করতে পারত, তবে কোনো বেইমানেরই সাহস হতো না মুসলমানের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

এ বড়ই আফসোস! আজকের পৃথিবীতে হোসাইনি মুসলমানের বড় অভাব। তাই তো নাফের তীরে ফিরে এসেছে ফোরাতের কারবালা। লাখ লাখ নির্যাতিত মুসলমানের চোখে-মুখে একই ভাষা, ‘হাল মিন নাসরিকুম’ জবাবে তারা তেমন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।  শুধু দেখা যাচ্ছে, এখনো মুসলিম বিশ্ব ভোগের পেয়ালা এবং ক্ষমতার মসনদে বিভোর হয়ে আছে। যত দিন না আমাদের থেকে ভোগ ও ক্ষমতার মোহ কাটবে ততদিন পৃথিবীর বুকে কারবালা আসতেই থাকবে।  মুসলমানের চোখের জলে বুকের রক্তে পৃথিবীর নদীগুলো বয়ে যাচ্ছে নিরবধি। মহররমের চাঁদ ডেকে ডেকে এ কথাই যেন বলে যাচ্ছে পৃথিবীর মুসলমানকে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর