শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কারবালার সেই মর্মান্তিক ঘটনা

আবদুর রশিদ

ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ছিলেন ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের পৌত্র।  ওহুদের যুদ্ধে রসুল (সা.)-এর চাচা হামজা শহীদ হলে হিন্দা নামের যে রাক্ষসী নারী তার লাশের বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে প্রতিহিংসা দেখিয়েছিল, সে ছিল ইয়াজিদের দাদি। খ্রিস্টান মায়ের সন্তান ইয়াজিদ মুখে নিজেকে মুসলমান দাবি করলেও মদ্যপ ও লম্পট এ ব্যক্তিটির সঙ্গে ইসলামী জীবন বিধানের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পুত্র ইয়াজিদকে খেলাফতের উত্তরাধিকার করেন মুয়াবিয়া (রা.)। তার এ সিদ্ধান্তে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মক্কা মদিনা কুফার মুসলমানরা। রসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। কুফার জনগণও ইয়াজিদকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। হজরত ইমাম হোসাইন তাদের কাছে পাঠান জ্ঞাতি ভাই মুসলিমকে। তিনি হোসাইন (রা.) কুফা সফরের পরামর্শ দিয়ে চিঠি লেখন। ইমাম হোসাইন (রা.) কুফার দিকে যাত্রা শুরু করেন।

কুফার মরুপথ অতিক্রম করার পর হজরত হোসাইন (রা.) কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহর লোক কর্তৃক মুসলিমের হত্যার সংবাদ পেলেন। এতে তিনি বিব্রত হলেন, কিন্তু সফরে বিরত হতে পারলেন না। কারণ মুসলিমের আত্মীয়বর্গ এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাকে চাপ দিল। দুর্দশার মুখে বেদুইনরাও হুসাইনের দল ত্যাগ করল। অনেকের মতে, এ সময় হুসাইনের সঙ্গে মাত্র ৪০টি অশ্ব ও ২০০ ব্যক্তি ছিল। কিছু দল অগ্রসর হলে তামিম গোত্রের আল-হোর নামক আরব প্রধানের নেতৃত্বে কুফার অশ্বারোহী বাহিনী হুসাইনের পথরোধ করল। অগত্যা তিনি ক্ষুদ্র দলসহ কুফা ডান দিকে রেখে, ফোরাত নদীর পশ্চিম শাখার তীর বেয়ে চললেন। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ হুসাইন ও তার দলকে শহরের আশপাশে বিচরণ করতে দেওয়া সঙ্গত মনে করলেন না। তিনি ৪০০০ অশ্বারোহীসহ ওমর-বিন-সা’দকে প্রেরণ করলেন। মহররমের প্রথম দিন অবরুদ্ধ হুসাইন কুফার ২৫ মাইল, উত্তরে ফোরাত তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে তাঁবু ফেললেন। এ সময়ে আবদুল্লাহ হুসাইনকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের দাবি জানালেন এবং তাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার উপায় হিসেবে ওমর-বিন-সা’দকে ফোরাত নদীর তীর অবরোধ করার আদেশ দিলেন। হুসাইন শত্রুতা ও রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য প্রথমে আপস প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘আমি যে স্থান থেকে এসেছি আমাকে সেখানে যেতে দাও’ তা না হলে আমাকে ইয়াজিদের কাছে দামেশকে নিয়ে গিয়ে তার হস্তে আমার হস্ত স্থাপন করতে দাও, যেন আমরা মুখোমুখি আলোচনা করতে পারি। আর এ প্রস্তাবেও রাজি না হলে আমাকে দূরে কোথাও যুদ্ধের ময়দানে যেতে দাও, যেখানে আমি খলিফার বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি। ঐতিহাসিক মূর বলেছেন, ‘এ অনুরোধ রক্ষা করা হলে উমাইয়াদের মঙ্গলই হতো।’ কিন্তু তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলো। বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ না করলে ওবায়দুল্লাহ সীমারকে অবিলম্বে হুসাইনকে মৃত অথবা জীবিতাবস্থায় কুফায় নিয়ে যেতে আদেশ দিলেন। অতঃপর হুসাইনের শিবির অবরুদ্ধ হলো।

৯ মহররম। শত্রু পক্ষ নদীপথ বন্ধ করলে পানির অভাবে শিবিরে হাহাকার উঠল। হুসাইন অসহায় ও নিষ্পাপ শিশু এবং মহিলাদের প্রতি সদয় হতে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু শত্রুপক্ষ এ মানবিক আবেদনে এতটুকু বিচলিত হলো না। যুদ্ধ ছাড়া হুসাইন কোনো গত্যন্তর দেখলেন না। হুসাইন তার পরিবার-পরিজনকে মক্কায় পাঠিয়ে দিতে চাইলেন; কিন্তু কেউ তার সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইলেন না। ইমাম হুসাইনের শিশুপুত্র আজগর তখন জ্বরে পীড়িত; কিন্তু তার শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ভিজানোর জন্য এক বিন্দু পানিও জুটল না। নারী ও শিশুর হাহাকার এবং ভীতির মধ্যে একটি বিভীষিকাময় রাত অতিবাহিত হলো।

১০ মহররম। ভোরে নারী ও শিশুদের আর্ত হাহাকারের মধ্যে দুই অসম সেনাদলের যুদ্ধ শুরু হলো। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাসিম সর্বপ্রথম দুশমনদের আঘাতে শাহাদাতবরণ করেন। হুসাইনের পরিবারের সবাই একে একে শহীদ হলেন। অবশেষে তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্রকে কোলো নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তিনি দুশমনদের তীরের আঘাতে ফিরতে বাধ্য হলেন। তীরের আঘাতে পুত্র পিতার বাহুবন্ধনে শহীদ হলো। নির্মম দুশমনদের হামলা সামলাতে না পেরে হুসাইন তাঁবুর সামনে বসে পড়লেন। এ সময় একজন মহিলা তার সম্মুখে এক পেয়ালা পানি উপস্থিত করলেন। তিনি যখন তা মুখের কাছে তুলেছিলেন, তখন দুশমনদের বর্শা তার বুকে বিদ্ধ হলো। রক্তপাতে দুর্বল হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং খুনি দুশমন দল মরণোন্মুখ বীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা তার মস্তক ছেদন করল, দেহ দলিত করল এবং বর্বর হিংস্রতা সহকারে পবিত্র দেহকে সর্বপ্রকার অপমানিত করল। রসুল করিমের (সা.) প্রিয় দৌহিত্রের রক্তরঞ্জিত মস্তক ওবায়দুল্লাহর পদতলে উপস্থিত করলে জনতার মধ্যে ভীতির মনোভাব দেখা দিল। কঠিন হৃদয়ও এ দৃশ্যে বিগলিত হলো। এর পরবর্তী দৃশ্য এখনো মোমেনের স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে রয়েছে। গীবন বলেন, ‘সে সুদূর যুগে ও আবহাওয়ায় হুসাইনের মৃত্যু-বিয়োগান্ত দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের অন্তরেও সমবেদনার সঞ্চার করবে।’

এভাবে সে যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মানবের পতন ঘটল। একমাত্র রুগ্ন পুত্র জয়নুল আবেদীন ব্যতীত ইমাম হুসাইনের পরিবারের সব পুরুষের জীবনের সমাপ্তি ঘটল। ইমাম পরিবারের মহিলাগণকে শিশু জয়নুল আবেদীনসহ ইয়াজিদের রাজধানী দামেশকে প্রেরণ করা হলো। তাদের আর্ত হাহাকার ইয়াজিদকে বিচলিত করল। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি তাদের সম্মান সহকারে স্বগৃহে প্রেরণ করেন।

হুসাইন (রা.) এর মৃত্যু গোটা দুনিয়ার কাছে এক মহাশিক্ষার উৎস। ন্যায় ও সত্যের জন্য জীবন দান করে তিনি এ শিক্ষা রেখে গেছেন।  তিনি ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করলেই নিজের ও স্বজনদের জীবন রক্ষা করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তার নীতিতে অবিচল ছিলেন এবং সত্যের জন্য জান কোরবানি করলেন।  এটা মুসলমানদের জন্য এক মহাআদর্শ।

লেখক : ইসলামী গবেষক।

সর্বশেষ খবর