শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

স্ত্রী উদ্ধারে সার্চ ওয়ারেন্ট

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

স্ত্রী উদ্ধারে সার্চ ওয়ারেন্ট

বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য তল্লাশি ওয়ারেন্টের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। এ ধারাটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক রাখা হয়েছে— যা রীতিমতো অপরাধের শামিল, তাহলে তিনি একটি তল্লাশি ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবেন। তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। বয়সের দিক থেকে আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য এই ধারা ব্যবহার করা যাবে না। স্ত্রী তার পিতা-মাতার সঙ্গে বা অন্য কোনো কারণে কারও সঙ্গে থাকা অবস্থায় তাকে উদ্ধারের জন্য স্বামীর আবেদনক্রমে তল্লাশি ওয়ারেন্ট ইস্যু করা সম্পূর্ণ বেআইনি। অথচ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা এ ধারাটির যথেচ্ছা ব্যবহার করছেন। কারও স্ত্রী যদি আইনগত কোনো কারণ ছাড়াই তার স্বামীর সঙ্গে একত্রে বসবাস না করেন, সে ক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। ১৭ ডিএলআরের ৫৪৪ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। নিয়মিত আদালত অর্থাৎ এ বিষয়ে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মোকদ্দমা আনয়ন করতে হবে। সিআরপিসির ১০০ ধারার মাধ্যমে এ বিধানকে অবলম্বন করা যায় না এবং পারিবারিক আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার বিষয়ে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করতে পারেন না।

পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল জার্নাল, ১৯৭৭-এর পৃষ্ঠা ১১১-তে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, স্বামী পরিচয়ে কোনো ব্যক্তি কোনো মহিলাকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করলে উপযুক্ত প্রমাণাদি ছাড়া ওই আবেদন বিবেচনা করা যাবে না। তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের এ ধরনের অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে অত্র আইনের ধারা ৪৩৫ ও ৪৩৯ (ক)-এর বিধানমতে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করা যায়। দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় বাদীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি নির্দোষ ও নিরীহ মনোভাব নিয়েই আদালতের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারেন স্বামী তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, তবে স্বামী ডিক্রি পাবেন না। নিষ্ঠুরতার আকার-প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, ওই অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে যাওয়া নিরাপদ নয়, তখন তা হবে একটি উত্তম বৈধ প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি।

আশু দেনমোহর যতক্ষণ পর্যন্ত পরিশোধ করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে ও তাকে দাম্পত্য মিলনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করতে পারেন। দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে স্বামী তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে সেই ক্ষেত্রে দেনমোহর অপরিশোধিত রয়েছে বললে আনীত মামলায় এটি একটি উত্তম প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি হবে এবং আনীত মামলাটি নাকচ করা হবে। কিন্তু স্ত্রীর অবাধ সম্মতিক্রমে দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটি দায়ের করা হলে ‘আশু দেনমোহর’ প্রদানমূলক শর্তমূলক দাম্পত্য অধিকারের পুনরুদ্ধারসংক্রান্ত ডিক্রি দেওয়া যাবে। তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব থাকতে হবে।সস্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্নকালে তালাকের নোটিস প্রত্যাহার করা না হলে এ মামলা চলে না। এ মামলায় আদালত বিবেচনা করেন যে পরস্পরের প্রতি আরোপিত দায়িত্ব পালন করা হয়েছে কিনা। অনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এ রকম হলে তালাক নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩৯ সালের বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা প্রমাণ করতে পারলে স্বামী এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনেন, এ যুক্তি সত্য হলে দাম্পত্য অধিকার উদ্ধারে আদালত ডিক্রি জারি করতে পারে। তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মস্তান হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকারের মোকদ্দমা অচল হবে এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নন। দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে আইনবিদদের মধ্যে রয়েছে দ্বিমত। বিভিন্ন মামলার নজিরেও ভিন্নমত পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগ উঠেছে, কেউ যদি স্বাধীনচেতা হন, পূর্ণাঙ্গভাবে আলাদা থাকতে চান এতে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একতরফা দাবির কোনো সংঘাত হবে কিনা।

১৮ বিএলডি (১৯৯৮)-এ খোদেজা বেগম বনাম মো. সাদেক মামলার রায়ে বলা হয়, ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারস্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ হোসেন জাহান বনাম মো. সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮) বলা হয়, ‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী মামলা করতে পারেন।’ আরেকটি মামলার (১৬ বিএলডি, ১৯৯৬ পৃষ্ঠা ৩৯৬-৩৯৮) লিপিবদ্ধ বর্ণনায় নিম্ন আদালত থেকে স্বামীর পক্ষে ডিক্রি এবং আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে স্ত্রী রিভিশন মামলা করলে হাই কোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ (বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বজলুর রহমান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত) এ ডিক্রি বাতিল করে এবং দাম্পত্য অধিকার মোকদ্দমা ডিসমিস করে। ওই রায়ে সৈয়দ আমির আলীর ‘মোহামেডান ল’ গ্রন্থ থেকে বিয়ের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করা হয় এবং বলা হয়— ‘কোনো দেওয়ানি বা ধর্মীয় আইনের চোখে ইসলামী আইন অধিক কঠোর, যা একজন মহিলাকে তার বিবাহিত জীবনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। ইসলামী আইনে এ অত্যাচার স্বামী কর্তৃক কেবল দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার বোঝায় না, স্বামীর সঙ্গে বসবাসে স্ত্রীর অনিচ্ছুকতাও বোঝায়।’

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

সর্বশেষ খবর