ফরাসি ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক ভিক্টর হুগো। ইংরেজ মহাকবি শেকসপিয়রের সঙ্গে পৃথিবীর আর যে চারজন লেখকের তুলনা চলে ভিক্টর হুগো তাদের মধ্যে অন্যতম। বাকি দুজনও ইউরোপের। জার্মান লেখক গ্যেটে ও রুশ লেখক লিও তলস্তয়। তৃতীয়জন হলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৫ সালের ২২ মে শ্রমিকের মলিন পোশাকে প্যারিসের ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছেন হুগো। একটি মেয়ে তাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বলল— কী আশ্চর্য! তোমাকে তো দেখতে একদম ভিক্টর হুগোর মতো লাগছে। আমি তো ভেবেছিলাম কোন কালে মরে গেছেন তিনি। মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলেন হুগো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। সেদিন রাতেই মৃত্যু হলো ভিক্টর হুগোর। কোরবানি ঈদের আগে-পরে প্রয়াণ হলো দেশের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তির। এ পৃথিবী ছেড়ে তারা পাড়ি জমালেন অনন্তধামে। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ও কলামিস্ট কাজী সিরাজ, সঞ্জীব চৌধুরী, লেখক সালেহ চৌধুরী। যেহেতু প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার জানা-পরিচয় ও সখ্য ছিল সেহেতু তাদের মৃত্যুতে আমি কষ্ট পেয়েছি। হয়েছি শোকাভিভূত। তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় না থাকলেও তার সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে আমি পরিচিত এবং তার দেহাবসানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য। মৃত্যু আসলে কী। মৃত্যু কি শুধুই একজন মানুষের এ পৃথিবী থেকে অন্তর্ধান। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মৃত্যুকে বলেছেন- সম্ভাবনা। কিন্তু মৃত্যু সম্ভাবনা হলেও হাইডেগারের ভাষায় তা হলো এক বিকল্পহীন সম্ভাবনা। কারণ সম্ভাবনার একাধিক বিকল্প থাকতে পারে কিন্তু মৃত্যুর কোনো বিকল্প নেই। তা অমোঘ ও অনিবার্য। মৃত্যুকে নিয়ে সংশয়ে ভুগেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুকে নিয়ে তিনি রসিকতাও করেছেন কখনো-সখনো। মাঝেমধ্যে অজ্ঞাত মৃত্যুর কথা ভেবে ভয়ার্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি লিখেছেন— মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ওরে। পাশাপাশি তিনি সান্ত্বনা খুঁজেছেন, স্বস্তি পেতে চেয়েছেন মৃত্যুর নতুন ব্যাখ্যা খুঁজে। তখন তিনি মৃত্যুকে দেখতে চেয়েছেন একজন দার্শনিকের দৃষ্টি দিয়ে। তিনি লিখেছেন— স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে/মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।
সত্যি বলতে কী, সমাজে এমন মানুষ ক’জন আছেন যারা দিনে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও মৃত্যুর কথা ভেবে শঙ্কিত হন। আমার তো মনে হয় এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো হাজারে দুই-একজনের বেশি পাওয়া যাবে না। অথচ চোখ দুটি বন্ধ করে একটু ভাবলেই কিন্তু আমাদের সবার উপলব্ধি হওয়ার কথা— এই যে এত আয়োজন, এত সাজসজ্জা, সুখ-ঐশ্বর্য, প্রেম-ভালোবাসা সবকিছু কিন্তু মৃত্যুর দিকেই ধাবমান। মানুষকে একদিন আত্মাহুতি দিতেই হবে মৃত্যুর পদতলে।
প্রসঙ্গক্রমে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা মনে পড়ে গেল। মৃত্যুর কিছুকাল আগে তার সঙ্গী-সাথীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন— মৃত্যুর পর তার হাত দুটো যেন কফিনের বাইরে বের করে রাখা হয়। যাতে করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দেখতে পায় অর্ধেক পৃথিবীর যিনি অধীশ্বর তিনি আজ কবরে যাচ্ছেন একেবারে শূন্য হাতে। অন্যদিকে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের বিশাল আবিষ্কারক প্রতিভা স্টিভ জোবসের সেই করুণ আর্তির কথা মনে পড়ে। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় তিনি বলেছিলেন— যদিও আজ আমি হাজার কোটি টাকার মালিক অথচ আমার সব সম্পদ মৃত্যু দেবতার হাতে অর্পণ করেও আরও একটি রাত বেশি বাঁচার কোনো উপায় নেই। অথচ কে বলবে এ স্টিভ জোবসই ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করে বলেছিলেন— “এই জগতে কেউ মরতে চায় না, এমনকি যারা ভাবে মরে গেলে স্বর্গে যাবে, আর স্বর্গ হচ্ছে দারুণ একটা সুখের জায়গা, তারাও চায় না মরতে।”এই যে আমি বলতে চেয়েছি দাম্ভিক শাসকদের মৃত্যু ভয় নেই। কথাটি কিন্তু আংশিক সত্য। দাম্ভিকদের মৃত্যুভয় নেই সেটি বোধকরি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারেন মৃত্যু এখন তাদের দোরগোড়ায় তখন কিন্তু ঠিকই তারা ভয়ে কুঁকড়ে যান। জোসেফ স্তালিন মারা যান ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে স্তালিন ভয়াবহভাবে হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হন। তারপর তিনি বিছানা থেকে পড়ে যান মেঝেতে। শহর থেকে দূরে একাকী বাস করতেন বলে ১০টা-১১টা নাগাদ তার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে মূত্র ও বিষ্ঠা মাখামাখি অবস্থায়। তখনো পর্যন্ত তিনি জীবিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। মৃত্যুশয্যায় তার পাশে ছিলেন কন্যা সেভেত্লানা। তিনি আমাদের জানিয়েছেন মৃত্যুর পূর্বে কেমন আচরণ করেছিলেন স্তালিন। চোখ খুলেই নাকি ডান হাতটি উপরের দিকে তুলে গো গো শব্দ করতে থাকেন তিনি। মনে হচ্ছিল যেন আগত মৃত্যুর প্রতি হুঙ্কার দিচ্ছিলেন স্তালিন। কেন তাকে আজ এভাবে ভূপাতিত করা হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মৃত্যু সামনে চলে এসেছে বুঝতে পেরে ভয়ে মুখবয়ব ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার। এরপর তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। মুসোলিনী তো জনসাধারণের রোষানল থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হায়! জনগণের হাত থেকে বাঁচা কি এত সহজ। ধরা পড়ে গেলেন সাধারণ মানুষের হাতে। গুলি করে হত্যার পূর্বে সাধারণ মানুষজন তাকে ও তার প্রেমিকাকে কী বীভৎসভাবে যে পিটিয়েছিল তার একটি আলোকচিত্র রাখা আছে মিলানের মর্গে, দেখলে গা শিউরে ওঠে। ইতিহাসের একসময়ের মহাপরাক্রমশালী অমিতবীর্যবান রাজা মহারাজা স্বৈরশাসক-শোষক কিংবা অতি সাধারণ প্রজা সবাইকেই কোনো না কোনো সময় নিজেকে আত্মবলি দিতে হয়েছে মৃত্যুর মুখে। একদিকে এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে দুঃসহ কষ্ট অন্যদিকে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকতে মানুষের অদম্য ইচ্ছা এই কারণেই হয়তো অনেক মানুষ রেখে যেতে চান তার স্মৃতি ও কীর্তি। যাতে করে তারা যুগ যুগ বেঁচে থাকেন মানুষের মনে ও স্মৃতিতে। ‘ক্রন্দসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সৃষ্টিরহস্য’ কবিতায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন— হয়তো মানুষ মরে কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয়। মৃত্যুর পরও কর্মের অমরত্বের বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কবি। এই প্রসঙ্গে মধ্যযুগের কবিদের একটি অদ্ভুত অভ্যাসের কথা মনে পড়ছে। তারা অনেকেই নিজের চেয়ে নিজের সৃষ্টিকে বেশি মূল্যবান মনে করতেন, ভাবতেন আমি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাই, আমাকে লোকে ভুলে যায় সে ঠিক আছে কিন্তু আমার কবিতা বা গান বেঁচে থাক, তা অনেক বেশি লোকের কাছে পৌঁছাক, সেটার সমাদর হোক। তাই তারা কোনো বিখ্যাত কবির নামের ভণিতা তাদের কবিতা বা গানের সঙ্গে জুড়ে দিতেন, সেই নামের বদৌলতে সে কবিতা অমর হয়ে থাকত। এভাবে চণ্ডীদাস কিংবা বিদ্যাপতির নামের সঙ্গে কত কবি যে তাদের কবিতাকে জুড়ে দিয়ে কবিতা বা গানকে সময়ের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছেন অথচ তাঁরা নিজেরা আজ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সাহিত্য বা কাব্য তখন মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হতো বলে হয়তো এ আকাঙ্ক্ষা একটু বেশি উৎসাহ পেয়েছে।
একটু ভিন্নভাবেও কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে। আমাদের প্রাণহীন অসাড় দেহটি কবরে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে দেহটি অধিকার করে নেয় মজ্জেরেলা চিজ রঙের অজস্র সব কীড়ে। সেসব কীড়ে একসময় মিশে যায় মাটিতে। সেই মাটি থেকে জন্ম নেয় বৃক্ষ। আমরা কিন্তু প্রকারান্তরে মিশে থাকি সেসব বৃক্ষের পত্র-পল্লবে, শাখা-প্রশাখা, ফুল কিংবা ফলে। কিন্তু মানুষ ওভাবে বেঁচে থাকতে চায় না। মানুষ চায় দৃঢ় ও প্রগাঢ়ভাবে বেঁচে থাকতে। যা হবে প্রচ্ছন্নভাবে দৃশ্যমান। আমি মৃত্যু ভাবনা নিয়ে বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে দু-একজন মনে করেন জীবন যখন এতটুকুই তখন যে কোনো মূল্যে জীবনকে উপভোগ করতে হবে। জীবনটাকে সম্পূর্ণ রূপে নিংড়ে আমোদ-আহ্লাদে ব্যাপৃত থাকতে হবে। তাদের দর্শন হলো, আমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচেই না থাকি তাহলে আমার এই বিত্ত, শিল্প, সাহিত্য, সৃষ্টি দিয়ে কী করব আমি। তাদের এই দর্শন যে কতটা বৈপরীত্যে ভরা তার একটি উদাহরণ দেই। এসব মানুষ যদি সত্যি সত্যি তাদের দর্শন সঠিক বলে মনে করে তবে কেন তারা তাদের সন্তানদের সবসময় আগলে রাখে নানা বিপদ-আপদ ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। জগৎ সংসারে প্রতিটি মানুষই তার নিজ নিজ আত্মজকে দেখভাল করে অতন্ত্র প্রহরীর মতো। যাতে করে ছেলেমেয়েদের শরীরে এতটুকু আঁচও না লাগে। মুখে এসব বললেও আসলে তারা তাদের সন্তানদের মনে করে তাদেরই আরেকটি বর্ধিত অংশ। অর্থাৎ মরে গেলেও তারা বেঁচে থাকবে তাদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে। মানুষের অবচেতন মনের এই আকাঙ্ক্ষাই প্রমাণ করে মৃত্যুর পর সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর মানুষও বেঁচে থাকতে চায়। যদিও তারা মুখে বলেন অন্য কিছু। তবে মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে দু’রকমের আচরণ লক্ষ্য করা যায়। এক ধরনের মানুষ আছেন যারা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। আবার অন্যদিকে কিছু মনীষী আছেন যারা জীবনে অতি নিকটজনদের মৃত্যুশোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে এই পৃথিবীকে উপহার দিয়ে গেছেন কালজয়ী কিছু সৃষ্টি। রোমান্টিক যুগের অন্যতম কর্ণধার ইংরেজ কবি শেলি একবার নৌবিহারে বেড়িয়েছেন ইতালির লেরিচি উপসাগরে। লিভোরনো নামক একটি স্থান হতে ফেরার সময় আকাশ ভেঙে ঝড় উঠল। উত্তাল ঢেউয়ের ভিতর শেলির পালতোলা নৌকা দেখে অন্য একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলে উঠলেন- “চলে আসুন আমাদের নৌকায়, নয় তো আপনার নৌকার পালগুলো নামিয়ে ফেলুন। পালগুলো নামিয়ে নিলে হয়তো বেঁচে যেতেন শেলি। কিন্তু তিনি বললেন- না। পাল আমি নামাব না। মৃত্যুকে আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। আজ আমি জিতব না হয় মৃত্যু। তিনটি পালসমেত নৌকা ডুবে গেল, শেলি, বন্ধু এডওয়ার্ড উইলিয়াম আর এক কিশোর নাবিককে নিয়ে। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন বলেই হয়তো আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ৬১ বছর বয়সে কিংবা ইংরেজ কবি সিলভিয়া প্লাত ও রুশ কবি মায়াকোভস্কি যৌবনের একেবারে মধ্য গগনে আত্মহত্যা করে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।
প্রচণ্ড রকম ব্যথা না পেলে বোধকরি কালজয়ী কিছু সৃষ্টি করা যায় না। ভিক্টর হুগো যেমন মেয়ের মৃত্যু শোকে ব্যাকুল হয়ে কবিতা লিখেছিলেন, যা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আরেক সন্তান হারানো কবি রবীন্দ্রনাথ- বেঁচেছিল হেসে হেসে/খেলা করে বেড়াত সে- হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হলো তোমার? ১৫৯৬ সালে মারা যায় শেকসপিয়রের একমাত্র পুত্র হ্যামনেট। হ্যামনেটের মৃত্যু যাতে তাকে পাগল করে না দেয় তাই হয়তো তিনি কাজে ডুবে যান। চার বছর পর প্রকাশিত হয় তার কালজয়ী নাটক হ্যামলেট। অনেকের মতে, এটাই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তবে এই চার বছরে তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নাটকও রচনা করেছিলেন। এডগার অ্যালান পো, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ এরা সবাই নিকটজনদের মৃত্যুতে ব্যথাতুর হয়ে রচনা করেছিলেন অসামান্য সব সাহিত্য কীর্তি। এ তো গেল মানুষের কথা অনেক ক্ষেত্রে প্রভুর মৃত্যুতে পশুও শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটি নিয়ে আসা হলো তাজমহলে। সঙ্গে ছিল শাহজাহানের প্রিয় হাতিটিও। হাতিটি ছিল বাইরে বাঁধা। এমন সময় মাহুত কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওরে আজ তোর বড়ই দুর্দিন। সম্রাট আর নেই। কে তোর পিঠে চড়বে, তুই তো আর এরকম প্রভু পাবি না?” হাতি সব কথা বুঝতে পারল। সে শুঁড় দিয়ে ধুলো এনে নিজের দেহে ছড়িয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। তারপর হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ল, আর উঠল না। ইতালিয়ান পরিব্রাজক মানুচি লিখে গেছেন এই ইতিহাস।
সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো ভালো কলাম লিখতেন। তিনি ছিলেন আমার দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক। দু-একবার তিনি আমার চেম্বারেও এসেছেন। যখন তিনি জানতে পেরেছেন আমি ব্যারিস্টার মীর হেলালের পরম বন্ধু তখন আমার প্রতি তার স্নেহের পাল্লাটিও একটু বেশি ঝুঁকে পড়েছে। কারণ হেলালের মামা আবু তাহের পুতু ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাঝে মধ্যে ফোন করে বলতেন- ব্যারিস্টার সাহেব কেমন আছেন আপনি? তার মৃত্যু সংবাদ শুনে মনে হলো আহারে! এমন করে কেউ আর আমাকে ডাকবে না কোনো দিন। আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। আমার শোক প্রকাশও তাই অতি সাধারণ। কিন্তু বিখ্যাত ব্যক্তিদের শোক প্রকাশও হয় ব্যতিক্রম। ফরাসি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো এবং ফরাসি আধুনিক কবিতার স্থপতি অ্যাপোলোনিয়ের ছিলেন দুজন পরম বন্ধু। পিকাসো কে পিকাসো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে অ্যাপোলোনিয়ের ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা। তিনি যথেষ্ট লেখালেখির মাধ্যমে পিকাসোর কিউবিজম একসঙ্গে হবে সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষদের সচেতন করে তুলেছিলেন। তো হয়েছে কি অ্যাপোলোনিয়ের মৃত্যুসংবাদ যখন পিকাসোর কানে পৌঁছল পিকাসো তখন স্নানাগারে দাড়ি কামাচ্ছিলেন। আয়নায় নিজের বীভৎস বিষাদাক্রান্ত মুখ দেখলেন তিনি। সেই শোকে পরবর্তী কুড়ি বছর আর আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেননি পিকাসো। আরেক ফরাসি লেখক রম্যাঁ রলাঁ যিনি ছিলেন অর্ধেক ফরাসি আর অর্ধেক বাঙালি। বাঙালি বললাম এ কারণে যে রম্যাঁ রলাঁ জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন আমাদের এই বঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও মহাত্মা গান্ধীর সাহচর্যে। নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার দুই বছর পরে। সেই রম্যাঁ রলাঁ ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর কথা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ফেলে রেখে বেশ কয়েক দিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছিলেন হুগোর বাড়ির চারপাশে। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালগুলো তার কেটেছিল হুগোর লেখা পড়তে পড়তে।
সত্যি বলতে কী মৃত্যু ভয়ে আমি নিজেও সর্বদা ভীত। তবে মৃত্যু ভয় যেমন তেমন অপমৃত্যুর ভয়ই আমার বেশি। দেশের এমন করুণ পরিস্থিতিতে আমার এই শঙ্কা নিশ্চয়ই অমূলক নয়। বিমানে ভ্রমণের সময় নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসহায় মনে হয় আমার। এর একটি কারণ হয়তো আমার উচ্চতা ভীতি আছে- এ জন্য। মনে পড়ে হাসি পায় যে, শেকসপিয়র ও ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুভয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন স্বেচ্ছানির্বাসনে। কিংবা মীর জাফরের মেয়েজামাই মীর কাশিম বাংলায় নবাব হয়ে মৃত্যু ভয়ে নিজের রান্না নিজেই করতেন। পাছে কেউ খাবারে বিষ প্রয়োগ করে তাকে আবার হত্যা না করে ফেলে। স্থায়িত্ব লাভের আশায় কেউ গড়ে পিরামিড, কেউ তাজমহল, কেউ আবার আইফেল টাওয়ার কিংবা মহাপ্রাচীর। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকার লোভ মানুষের জন্মগত। সে হোক, অসুবিধা নেই। তবে যেসব মানুষ এত সব সৌধ ও কীর্তি রেখে যেতে অক্ষম তারাও কিন্তু মানুষের মনে বেঁচে থাকতে পারে যুগ যুগ। শুধু ভালো কাজ করে ও ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন মানুষকে সমাধিস্থ করার পর যদি তার আশপাশের মানুষগুলো দুই ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করে বলে- ‘আহারে মানুষটি কত ভালো ছিল গো।’ সমস্ত জীবন বেঁচে থাকার এটাই হবে সে মানুষটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
ই-মেইল : [email protected]