শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিচার বিচারক ও বিচার বিভাগ

আবু হেনা

বিচার বিচারক ও বিচার বিভাগ

এখন থেকে ১৪০০ বছর আগের কথা। মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন আল-খাত্তাব একজন জ্ঞানী-গুণী, সৎ এবং সজ্জন ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে একটি প্রশ্ন করলেন, ‘আমি যদি এমন কোনো অপরাধ করি, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তাহলে আপনি কী করবেন? একদণ্ড অপেক্ষা না করে তিনি উত্তর দিলেন, ‘তলোয়ারের এক কোপে  আপনার মস্তক দেহ থেকে ছিন্ন করে দিব।’ ওমর তাকেই প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত করেছিলেন। সারা ভারতের সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। নূরজাহান মানেই জগতের আলো, একদিন রাজপ্রাসাদের ফটকে রক্ষিত ঘণ্টা বেজে উঠল।  যে কোনো ফরিয়াদি বিচারপ্রার্থী এই ঘণ্টা বাজালে জাহাঙ্গীর দরবারে বসে অভিযোগ শুনতেন এবং তাত্ক্ষণিক সুবিচার করতেন। এবারও তিনি দরবারে এসে দেখলেন একজন নারী করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অভিযোগ, তার স্বামীকে তীরের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, কে সেই হত্যাকারী? জবাবে তিনি বললেন, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তার স্বামীর হত্যাকারী। বাদশাহ নূরজাহানকে হাজির করলেন। তিনি বললেন, হরিণ শিকার করতে যেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তীর এই দুঃখিনীর স্বামীকে আঘাত করেছে। জাহাঙ্গীর সিংহাসন থেকে নেমে এলেন, তারপর একটি তীর ধনুক সেই নারীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আপনি নূরজাহানের স্বামীকে একইভাবে হত্যা করুন।’ ফরিয়াদি ভারতেশ্বরের মহানুভবতায় মুগ্ধ হলেন, বাদশাহ তার পরিবারের পূর্ণ দায়িত্ব নিলেন। নূরজাহানের হরিণ শিকার বন্ধ করে দিলেন।

বর্তমান বিশ্বেও এই নজির বিরল নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া একটি আদেশ জারি করেছিলেন এই বলে যে, বিচার প্রক্রিয়ায় শত অপরাধী মুক্তি পেয়ে গেলেও একজন নিরপরাধী ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়। এসব কারণেই বিচারকের ভাবমূর্তি এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে আদালতে তার আসনটি অসামান্য মর্যাদা লাভ করেছিল। আদালতে তিনি ধর্মাবতার, মাই লর্ড, মহামান্য আদালত, এসব সম্বোধনে ভূষিত হন। অতীতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে বিচারক অনেক সময় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করতেন, ফাঁসির আদেশে সই করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। তাদের মনে শঙ্কা ছিল, তাদের রায় যদি সঠিক না হয়, তাহলে তা হবে হত্যার সমতুল্য, যার জন্য পরকালে ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে।

এর বিপরীতে রোম সম্রাট ক্যালিগুলার নৃশংসতার কাহিনী আছে। একদিন ক্যালিগুলা তার প্রাসাদের ব্যালকনিতে বসে রোম নগরীর দিকে চেয়ে চেয়ে মৃদু হাসছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সারা রোম নগর আমার কৃপার পাত্র। আমার আঙ্গুলের একটি ইশারায় কারও গলা অক্ষত থাকবে না।’ তাকে তার দেহরক্ষীরা হত্যা করে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করেছিল। রাশিয়ার জার আইভান একটি প্রাচীর বেষ্টিত শহরের মূল দরজা বন্ধ করে দিয়ে দিনের পর দিন নগরবাসীর ওপর নির্যাতন প্রাসাদে বসে উপভোগ করতেন।

আজ প্রায় সব সভ্য দেশেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আফ্রিকার কেনিয়ার মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে আদালতের আদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল বাতিল করা হয়েছে এবং পুনর্নির্বাচনের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আদালতের নির্দেশে পদত্যাগ করেছেন। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একইভাবে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট। এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন।

২০১৬-এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে রাশিয়ার মদদপুষ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই সাতটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ ভিসা বাতিল হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিমানবন্দরে আটকা পড়ে গেল হাজার হাজার যাত্রী। মাঝপথে বিভিন্ন দেশে একইভাবে আটকা পড়ে ফিরে যেতে হলো অসংখ্য যাত্রীকে।

বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার এবং শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৭ জানুয়ারি সদম্ভে ঘোষণা করলেন : “By the authority vested in me as President by the Constitution and the laws of the United States of America including the Immigration and Nationality Act ..., and to protect the nation from terrorist activities by foreign nationals admitted to the United States.” It is hereby ordered as follows:

ক্ষমতার বলে অন্ধ হয়ে ট্রাম্প যে Immigration and Nationality Act এর কথা বললেন, তা ১৯৫২ সালে প্রণীত হয়। এই আইনটি ১৯৬৫ সালে এভাবে সংশোধিত হয় :

“No person shall receive any preference or priority or be discriminated against in the issuance of an immigrant visa because of the person’s race, sex, nationality, place of birth or place of residence.”

সাতটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে ১৯৬৫ সালের সংশোধনী অগ্রাহ্য করলেন। তা ছাড়া তার এই মুসলিম বিদ্বেষী আদেশ সংবিধানের ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টের সরাসরি লঙ্ঘন। ট্রাম্প তার আদেশে ‘নাইন ইলেভেনের’ সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনা তুলে ধরেছেন অথচ এই ৭ দেশের কোনো নাগরিক ‘নাইন ইলেভেন’ ঘটনায় জড়িত ছিল না।

এই যুক্তিতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারি হওয়ার পরই মেরিল্যান্ডের ফেডারেল জেলা জজ এই আদেশের ওপর টেম্পোরারি রেস্ট্রেনিং অর্ডার ইস্যু করে। এরপর স্টেট অব ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। যার সঙ্গে মিনেসোটাও যোগ দেয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প বনাম ওয়াশিংটন মামলার শুনানির পর পশ্চিম ওয়াশিংটনের জেলা জজ জেমস ওয়াটসন একটি রুলিংয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ সাময়িকভাবে অকার্যকর ঘোষণা করেন। একই দিনে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট (আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়) জজ ওয়াটসনের রুলিং বাতিল করে জরুরি ভিত্তিতে একটি স্থগিতাদেশ জারি করার জন্য ইউএস কোর্ট অব আপিলস ফর নাইনথ সার্কিট কোর্ট বরাবর আবেদন করলে সার্কিট কোর্ট এই আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর দুদিন পর দীর্ঘ শুনানি শেষে ৯ ফেব্রুয়ারি ইউএস আপিল কোর্ট ফর নাইনথ সার্কিট কোর্ট ফেডারেল জেলা জজ রবার্ট এর আদেশ বহাল রাখেন।

১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ভার্জিনিয়া ফেডারেল জেলা জজ লেওনি ব্রিস্কেমা আজিজ বনাম ট্রাম্প মামলার শুনানির পর ট্রাম্পের আদেশকে ইউএস সংবিধানের এস্টাবলিশমেন্ট ক্লজের সরাসরি লঙ্ঘন বলে রায় দেন। ১৫ মার্চ হাওয়াইয়ের ফেডারেল জেলা জজ ডেরিক ওয়াটসন একই এস্টাবলিশমেন্ট ক্লজের বরাত দিয়ে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ নং ১৩৭৮০ অকার্যকর ঘোষণা করেন। হাওয়াইয়ের অ্যাটর্নি জেনারেল জনসমক্ষে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ প্রকৃতপক্ষে একটি ‘মুসলিম ব্যান’। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের আদেশের অংশবিশেষ শর্তসাপেক্ষে বাস্তবায়নযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন।

পৃথিবীর সর্বত্র যখন বিচার বিভাগ জাতীয়  স্বার্থ ও সংবিধান সমুন্নত রাখার স্বার্থে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে চলেছে তখন এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখেছে। এর আগে বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ এবং জাতীয় সংসদ সম্মিলিতভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করার প্রচেষ্টা চালায়। এই সংশোধনীর পেছনে যুক্তি ছিল এই যে, যেহেতু সামরিক ফরমান দ্বারা সাধিত সংবিধানের সংশোধনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলরের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল সে কারণে উক্ত সংশোধনী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনার পরিপন্থী। অথচ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে একই সংসদ সুুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে পাকাপোক্তভাবে সংবিধানে সংরক্ষণ করে। অতএব সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখন বাংলাদেশ সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো সামরিক ফরমান নয়। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয় ৯৪(৪), ১১৬ক এবং ১৪৭ অনুচ্ছেদেও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। এর লক্ষ্য নির্বাহী বিভাগের সব দুরাচার থেকে নাগরিক অধিকার এবং সংবিধানের সার্বভৌমত্বকে সংরক্ষণ করা। এ বিষয়ে আলেকজান্ডার হামিলটনের কথাগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট : “The independence of the judges, once destroyed, the Constitution is gone; it is dead letter, it is a vapor which the breath of faction in a moment may dissipate.”

হামিলটন বলেছেন, “যদি একটি স্বাধীন বলিষ্ঠ এবং সর্বব্যাপী বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তির দুরাচার নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে বেয়োনেট ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’

রাষ্ট্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের তিন বিভাগ, অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ, সংসদ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে কৃতসমূহের পৃথকীকরণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আদিকাল থেকেই বিতর্ক চলছে। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনটেস্কুর মতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে হতে হবে, কথায় নয়। আর সে কারণেই বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের সব অনধিকার চর্চা থেকে দূরে রাখতে হবে। একই কারণে এ দেশের বিচারপতিদের অভিশংসন কোনো ক্রমেই সংসদের কাছে ন্যস্ত করা সমীচীন নয়। এ বিষয়ে অষ্টম সংশোধনীতে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে :

“Removal of judges by the President consequent upon a report of the Supreme Judicial Council is a unique feature because the judge is tried by his own peers, thus there is secured freedom from political control.”

আর এ বিষয়ে শেষ কথাটি হাউস অব লর্ডস এর লর্ড টেইনের :

“The threat of impeachment proceedings is subject to exploitation by politicians seeking to influence judges. Removing a judge from office must be done exclusively through a proceeding that guarantees the independence of the judge in his tenure. Such a proceeding should be run by judges, not politicians. It should be run as a trial in every way.”

অবশ্য শেষ অবধি লর্ড অ্যাকটন এর রায়টিই শিরোধার্য :

“All powers tend to corrupt. Absolute power corrupts absolutely.”

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে আজ্ঞাবহ করে বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ সর্বক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল।  বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তাদের সেই দুঃস্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়ে এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রশংসনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন।  তার জন্য সমগ্র জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এ রায় সারা বিশ্বকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সঠিক পথ-নির্দেশনা দেবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর