শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আর্তমানবতার সেবায় ইসলাম

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

আর্তমানবতার সেবায় ইসলাম

পৃথিবীর বুকে মহান রব্বুল আলামিন অসংখ্য-অগণিত সৃষ্টির মাঝে মানব জাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ শ্রেষ্ঠ জাতি আল্লাহর হুকুম-আহকাম মানার মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে। তিনি অন্য সব সৃষ্টিকে মানব জাতির সেবায় নিয়োজিত করেছেন।  তারা সৃষ্টির সেরা মানব জাতির সেবা করবে। মানব জাতি মানবীয় মেধা-মননশীলতা, শিক্ষাদীক্ষা, বিবেক-বুদ্ধি, তাহজিব-তামাদ্দুন এবং আল্লাহভীতির মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে প্রমাণ করেছে। যা সম্পূর্ণই মহান রব্বুল আলামিনের দান।  এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য-অগণিত প্রমাণ রয়েছে। এখানে দু-একটি প্রমাণ উল্লেখ করা হলো। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বনি আদমকে অধিক মর্যাদা দান করেছি। স্থলে এবং সমুদ্রে (নৌপথে) তাদের চলাচলের বাহন প্রদান করেছি। তাদের উন্নত ও পবিত্র রিজিক দান করেছি। আর আমি এ মানব জাতিকে অন্যান্য সৃষ্টির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ৭১)। হজরত রসুলে আরাবি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ যার চরিত্র অধিক উত্তম।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহর আনুগত্যতা, তাকওয়া, পরহেজগারিতা, মানবীয় উত্তম চরিত্র, মানবতার সেবা, নির্যাতিত, নিপীড়িত আর্তমানবতার সেবাসহ অন্যান্য মানবীয় গুণাগুণ অর্জন করার দ্বারাই মানব জাতি শ্রেষ্ঠত্ব হাসিল করতে পারে। পক্ষান্তরে এসব বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলি যদি মানুষ অর্জন করতে না পারে বা অর্জন করার পর তা যদি এক সময় হারিয়ে ফেলে, তখন তারা মনুষ্যত্বের গণ্ডির বাইরে চলে যায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে— ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯)। বস্তুত মহান রব্বুল আলামিন তার বিশেষ রহমতে প্রতিটি সৃষ্টিজীবকে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন মানব জাতিকে। তাদের বিবেক-বিবেচনা করে আপন খালেক (স্রষ্টা)কে চেনার ক্ষমতাও দান করেছেন। আল্লাহর পথে সঠিকভাবে অটল থাকার জন্য দিয়েছেন ইসলাম ধর্ম। আর ইসলাম ধর্মের ওপর অটল-অবিচল থাকার জন্য প্রদান করেছেন আল-কোরআন ও হাদিসের বিশাল ভাণ্ডার। আমরা জানি নিঃসন্দেহে ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবতার মুক্তির দূত হজরত রসুলে আরাবি (সা.) মানবতা-ইনসানিয়াতের মুক্তির জন্য সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন। মানবতার মুক্তির জন্য পবিত্র কোরআন ও অসংখ্য-অগণিত হাদিসের ভাণ্ডার রেখে গেছেন। মানবসেবা কীভাবে করতে হয়, করলে প্রতিদান কী হবে? তা-ও বিস্তারিত বলে দিয়েছেন। প্রিয় পাঠক! চলুন মানবতা কী? তা বুঝতে চেষ্টা করি। আমার মতে, মানবতা হলো— মানুষের এমন গুণাবলি যার দ্বারা মানুষ পশু-পাখি ও অন্যান্য প্রাণীসমূহ থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পরিচিত হয়। সাধারণত মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকুলের প্রতি মানুষের হৃদ্যতা, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতাকেই আমরা মানবতা হিসেবে বুঝি। এক কথায় মানুষ হিসেবে মানবীয় সব দায়িত্ব পালন করাকেই মানবতা বলা হয়। এ উত্তম গুণের অধিকারী মানুষ অপর মানুষের সেবায়, বিপদ-আপদে দৌড়ে যাবে এবং আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়াই মানবতা-ইনসানিয়াতের দাবি। ইসলাম মানব জাতিকে তাই শিক্ষা দিয়েছে। কারণ ইসলাম মানবতা ও শান্তির ধর্ম। ইসলাম মানুষের কথা বলে, শান্তির কথা বলে এবং আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে যেতে বলে। পৃথিবীর যেখানেই মানবতা-ইনসানিয়াত ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, অসহায় মানবতার আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে, সেখানেই সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেছে ইসলামপ্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা। যার নমুনা আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। মুসলিম ভাইয়েরা তাদের সেবার জন্য কীভাবে এগিয়ে গেছেন এবং কীভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের সেবা করছেন। মুসলমানদের এমনই হওয়া উচিত। আর এটাই ইসলামের শিক্ষা। প্রিয় পাঠক! ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, ইসলাম আর্তমানবতার সেবায় এমন এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে যা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই। নির্যাতিত, নিপীড়িত, অসহায়, ক্ষুধার্থ প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যাপারে ইসলাম স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পেট পুরে খায়, আর পাশেই প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায় সে প্রকৃত মুমিন নয়।’ এমনিভাবে পিতৃ-মাতৃহীন, অসহায়, দরিদ্র এতিম শিশুদের প্রতিপালনে তাগিদ দিয়ে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি ও এতিমের জিম্মাদার, জান্নাতে দুই আঙ্গুলের মতো পাশাপাশি অবস্থান করব।’ অপর হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন কর, তাহলে আসমানের অধিবাসীও তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।’ অন্য হাদিসে এসেছে, সমগ্র সৃষ্টিজীবই আল্লাহর পরিবারের মতো, আর সর্বোত্তম হলো ওই ব্যক্তি যে তার পরিবারের প্রতি সদাচরণ করে।’ প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন! ইসলাম বা মুসলমানরা শুধু থিওরি বা দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করে না। বরং তারা নিজেরাই আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাস তার প্রমাণ বহন করে। এবং যুগে যুগে ইসলাম ও মুসলমানরা প্রমাণ করেছে, ইসলাম মানবতার ধর্ম। আমরা রসুল (সা.)-এর জীবনীর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব তিনি কীভাবে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই তো রসুল (সা.)-এর সব সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। হিজরতের পরবর্তী সময়ে মক্কার আনসাররা কীভাবে মুহাজের ভাইদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছেন। শুধু এতটুকুই নয়, নিজেরা ক্ষুধার্থ, অসহায়, দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও খাবার ও থাকার মূল অংশ অপর ভাইয়ের জন্য দিয়ে দিয়েছেন। নিজেরা মুমূর্ষু, প্রচণ্ড পিপাসক্ত হওয়ার পরও নিজের খাদ্য ও পানীয় অপর ভাইয়ের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার যে নজির স্থাপন করেছেন, তার নমুনা ইতিহাসের পাতায় বিরল। প্রিয় পাঠক! চলুন আমরাও নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামদের অনুসরণ করে আর্তমানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করি। বিশেষ করে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াই। সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করি।  আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার তৌফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর