শিরোনাম
শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হবে

হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমান
সিনিয়র পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

তাওহিদের বিপরীত হচ্ছে শিরক। শিরক মানে অংশীদারিত্ব। ইসলামী শরিয়তে কোনো ব্যক্তি, বস্তু, শক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সত্তায় ও গুণাবলিতে, অধিকার ও মর্যাদায় অথবা ক্ষমতায় আল্লাহর সমান করাই হলো শিরক। শিরক করতে যারা মানুষকে হুকুম দেয় অথবা বাধ্য করে তারা হলো তাগুত। যেমন ফেরাউন, সে মানুষকে শিরক করতে বাধ্য করেছে। শিরক ও তাগুত হলো হারাম। কবিরা গুনাহ। তাগুত ও শিরিকের পরিণাম হলো আল্লাহর গজব ও আজাব। এদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম। এ শিরকের কারণে তাগুতের সঙ্গে আল্লাহর প্রেরিত সব নবী রসুলের সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়েছে। কারণ তারা আল্লাহর সঙ্গে শিরক করত অথবা নিজেরা তাগুত হয়ে অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার হুকুম দিত অথবা শিরক করতে বাধ্য করত। আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন, শিরক করার পর যে ব্যক্তি তা থেকে তওবা করবে না, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করার পাপ ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন (সূরা নিসা, ৪৮)। শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ হিসেবে বিবেচিত, এতে আল্লাহর গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুর তুলনা করা হয়। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করল সে প্রকারান্তরে তাকে আল্লাহর অনুরূপ ও সমকক্ষ বলে স্থির করল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা অন্যায় (সূরা লুকমান, ১৩)। সুতরাং যে গায়রুল্লাহর ইবাদত করে, সে মূলত ইবাদতকে তার আসল স্থানে না রেখে ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত নয় এমন কারও উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করে। আর এটা হলো সবচেয়ে বড় জুলুম এবং অন্যায়। শিরকের পরিণাম : মুশরিকদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন এবং তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই (সূরা মায়িদা-৭২)। শিরক সব আমলকে নষ্ট ও নিষ্ফল করে দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তারা শিরক করত তবে তাদের কাজকর্ম নিষ্ফল হয়ে যেত (সূরা আনয়াম-৮৮)। কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, ‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহের সংবাদ দেব না? আমরা বললাম, জী, অবশ্যই হে আল্লাহর রসুল! তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া (বোখারি হাদিস নং-২৫১১)। শিরকের প্রকারভেদ : ইসলামী শরিয়ত মুসলমানদের শিরিকমুক্ত এবং নির্ভেজাল তাওহিদবাদী করার জন্য শিরিকের বিভিন্ন প্রকার উল্লেখ করেছে। যেমন— ১. সত্তায় শিরিক, ২. গুণাবলিতে শিরিক, ৩. অধিকারে শিরিক, ৪. ক্ষমতায় শিরিক, ৫. মর্যাদায় শিরিক, ৬. ইবাদতে শিরিক। যত নবী আল্লাহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন তাদের সবার একটাই মিশন ছিল, মানুষকে শিরকমুক্ত করে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ করা। এ জন্য সব নবী রসুলের একটাই স্লোগান ছিল— ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ ইমাম তাহাভী রহ. (মৃ. ৩২১ হি.) বলেন, তার কোনো শরিক নেই। শায়খ আকমালুদ্দীন বাবেরতী রহ. (মৃ. ৭৮৬ হি.) বলেন, এখানে আল্লাহতায়ালা থেকে শরিককে বিদূরিত করার দ্বারা সব প্রকার শিরক বিদূরিত করা উদ্দেশ্য। কেননা, শিরক তিন প্রকার। ১. শিরক ফিজ জাত বা আল্লাহতায়ালার সত্তায় শরিক করা, অর্থাৎ দুজন সৃষ্টিকর্তা মানা। যেমন— দ্বিত্ববাদে বিশ্বাসী (মাজুসিরা) দুজন স্রষ্টার প্রবক্তা। একজন ভালোর স্রষ্টা, যাকে তারা ইয়াজদান বলে, আর অন্যজন মন্দের সৃষ্টিকর্তা, তাকে আহারমান বলে। ২. শিরিক ফিচ ছিফাত, মানে গুণাবলিতে শিরিক, আল্লাহর যেমন গুণ ও ক্ষমতা আছে অন্য কাউকে বা কোনো কিছুকে সেরকম গুণ ও ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করা। ইবাদতের যোগ্যতা ও নামের ক্ষেত্রে শরিক করা। যেমন— আরবের মুশরিকরা আল্লাহতায়ালার সঙ্গে মূর্তির ইবাদত করত। এবং মূর্তিকে ইলাহ বলত। অথচ তারা আল্লাহতায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকার করত। ৩. আল্লাহতায়ালার গুণের ক্ষেত্রে শিরক করা। যেমন মুজাসসিমারা আল্লাহতায়ালার জেসম বা আকৃতি এবং আরশের ওপর তার স্থান গ্রহণের কথা বলে। আল্লাহর ও বান্দার মাঝে সমতা স্থাপন করে থাকে। অথচ আল্লাহতায়ালা এসব কিছু থেকে নিজেকে পবিত্র ও মুক্ত করে বলেন, তারা আল্লাহতায়ালার ব্যাপারে যে গুণ সাব্যস্ত করে আল্লাহতায়ালা তা থেকে মুক্ত (শরহুল আকিদাতিত ত্বহাবিয়্যাহ, পৃ. ২৯-৩০)। ৪. শিরক ফিল এখতিয়ারাত, মানে অধিকারে শিরিক। ৫. শিরক ফিল হুকুম ওয়াল আমর, মানে ক্ষমতায় শিরক, যা ইচ্ছা তা করার ক্ষমতা, শাসন করার কথা বা বিধান ও হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহর যেমন আছে অন্য কাউকে সেভাবে ক্ষমতাবান মনে করা বা ক্ষমতা দেওয়া শিরক। ৬. শিরক ফিল একরাম, মানে সম্মান ও মর্যাদায় শিরিক, আল্লাহ যেমন মর্যাদাবান অন্য কাউকে সেভাবে সমান মর্যাদা দেওয়া বা তাকে সেভাবে মান্য করা শিরিক। আল্লাহ বলেন, সব ইজ্জতের মালিক আল্লাহ। ৬. শিরক ফিল ইবাদত, মানে ইবাদতে শিরিক, গোলামিতে, আদেশ পালনে, আনুগত্যে অন্য কাউকে কথায়, কাজে বা বিশ্বাসে অথবা ইবাদত-বন্দেগিতে আল্লাহর সমান বানিয়ে দেওয়া শিরিক। এ কারণে কেউ নামাজ পড়ার সময়, রোজা রাখতে অন্য কোনো জনকে দেখার জন্য যদি করে তা রিয়া হবে এবং তা হবে শিরকে খফি। যদি কোনো আমলে রিয়া তথা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য সংমিশ্রিত থাকে, তাহলে আল্লাহ তা বাতিল করে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সত্কর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরিক না করে’ (সূরা কাহাফ, ১১০)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের ওপর আমি যে জিনিসের ভয় সবচেয়ে বেশি করছি তা হলো শিরকে আসগর। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ!  শিরকে আসগর কি? তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা) (মুসনাদে আহমদ)।

প্রাক বয়ান : মুফতি ওসমান গনি সালেহী, মুহাদ্দিস। দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর