বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটি দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে। প্রচার হয় প্রতি শনিবার রাত সাড়ে ৮টায়, ঠিক বাংলা সংবাদের পর। এ অনুষ্ঠানের কল্যাণে তরুণদের মাঝে হাঁস-মুরগি পালন, খাঁচায় মুরগির চাষ, মাছের খামার খুব ব্যাপক প্রসার ঘটে। সে সময় অপরিহার্য হয়ে পড়ে কৃষি জ্ঞানটাকে আরও নিবিড়ভাবে পৌঁছে দেওয়া অর্থাৎ কৃষি প্রশিক্ষণ। যেসব তরুণ নতুন খামার গড়তে আসছে তাদের কারিগরি কোনো জ্ঞান নেই। মুরগির খামার, মাছের খামার, গরু মোটাতাজাকরণ কিংবা নার্সারি যা-ই হোক। সবখানেই কারিগরি জ্ঞান প্রয়োজন। তখন দেশের যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো উপলব্ধি করল, আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণ দরকার। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয় হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ ও বনায়নের নতুন কিছু কোর্স শুরু হলো। তরুণরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয় যাচ্ছে।
এই প্রশিক্ষণের প্রসারও দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন প্রতিদিন বিকালের দিকে প্রচার হতো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রযোজিত ‘দূরশিক্ষণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান। ‘দূরশিক্ষণ’ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিদিন আধা ঘণ্টা সময় বরাদ্দ নেয়। কোনো দিন ইংরেজি, কোনো দিন গণিত, কোনো দিন ইতিহাস, কোনো দিন বিজ্ঞান, কোনো দিন ভূগোল, কোনো দিন কৃষি সম্পর্কে অনুষ্ঠান। খুব সম্ভবত ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসটা ছিল ঢাকা কলেজ চত্বরের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ভবনে। উপাচার্য ছিলেন ড. শমসের আলী। তিনি একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যেসব বিষয় আমি বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’-এ দেখাই, সেগুলোকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রশিক্ষণের মতো করে দেখানো যায় কিনা। যেমন— মাছ কীভাবে চাষ করতে হয়, গরু লালন-পালনের পদ্ধতিটা কী? গরু মোটাতাজাকরণের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো। খড় দিয়ে কীভাবে ইউরিয়া মোলাসেজ ব্লক বানাবে? এগুলো একেবারে নিবিড়ভাবে বোধগম্য উপায়ে প্রশিক্ষণ সিরিজ করা যায় কিনা। এটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তরুণ প্রজন্মের অনেক উপকার হবে। আমি বেশ আগ্রহী হলাম। কারণ, এর উপযোগিতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, সব ধরনের দর্শকের কাছে কৃষির এই শিক্ষা অতীব জরুরি। প্রিয় পাঠক! এই প্রেক্ষাপট বর্ণনার পেছনের কারণটি হলো, গত ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তার পথচলার ২৫ বছর পার করেছে। তাদের রজতজয়ন্তী পালনের সঙ্গে আমার নানামুখী কাজের সম্পর্ক রয়েছে। সেজন্যই এই লেখার অবতারণা। যা বলছিলাম, একদিকে বিটিভির সাপ্তাহিক ‘মাটি ও মানুষ’ আরেকদিকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান। চিন্তা করলাম পারব তো? ভেবেচিন্তে অনুষ্ঠানটির নাম ঠিক করলাম ‘কৃষি কৌশল’। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কোর্সের সঙ্গে যুক্ত করা হলো ‘কৃষি কৌশল’। এ অনুষ্ঠান প্রযোজনার জন্য বহিরাগত হলেও আমাকে ‘গেস্ট প্রডিউসার’ হিসেবে নিয়োগ করা হলো। ড. শমসের আলী সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রথম গেস্ট প্রডিউসার হিসেবে আমাকে নিয়োগ দিলেন। এ যাবৎকালে আমিই সম্ভবত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত গেস্ট প্রডিউসার। আমি যোগদান করার পর বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরকেও আগ্রহী করলাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার ব্যাপারে। সাগর ও আমি ড. শমসের আলীর কাছে একটি প্রস্তাব দিলাম ‘বাউবি ১২’ নামের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি প্রশ্নসমৃদ্ধ অনুষ্ঠান। উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার। সেটিও দূরশিক্ষণে যুক্ত হয়ে গেল। এই অনুষ্ঠানটিও খুব জনপ্রিয় ছিল।
একদিকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম, আর আমাদের যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ, আর একদিকে টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ এবং বাউবি দূরশিক্ষণের ‘কৃষি কৌশল’ রেডিওর ‘মাটির কাছে মানুষের কাছে’। সব মিলিয়ে এক জাগরণ সৃষ্টি হলো তরুণদের মাঝে। কৃষি নিয়ে গোটা দেশের মানুষের স্বপ্ন তৈরি হলো। আমি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘কৃষি কৌশল’ করতে গিয়ে নতুন একটি মডেল তৈরির সুযোগ পেলাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ ছিল মূলত উদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান। কৃৃষির ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতাম। নতুন চাষব্যবস্থা, নতুন কৌশল, নতুন ফসল, নতুন বীজ এসব বিষয় দেখে কৃষক দারুণ উদ্বুদ্ধ হতো। দেখত কৃষক নতুন কিছু করে পয়সা উপার্জন করছে। এসব দেখে দর্শক হিসেবে আরেকজন কৃষকও চাইত সেটা করতে। কিন্তু তার কাছে কৌশলটা ছিল না। কীভাবে করবে তা সে জানত না। বাউবি দূরশিক্ষণের কৃষি কৌশলটা ছিল সে রকম একটা বিষয়। ‘মাটি ও মানুষ’ প্রচার হতো শনিবার। মাটি ও মানুষের শেষে দর্শকদের আমি বলতাম, এ বিষয়ের বিস্তারিত যদি হাতে-কলমে পেতে চান আগামী বৃহস্পতিবারের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’ দেখুন। একই টেলিভিশনে ঠিক চার দিন পর দর্শক অপেক্ষা করে অনুষ্ঠানটি দেখত। দেখে সে আরও সমৃদ্ধ হতো। কৌশলটা শিখত। টেলিভিশনে দেখে যখন সে হাতে-কলমে করতে যেত অনেক সময় হিসাব বা তথ্য ভুলে যেত। তখন সেই দর্শককে আমি টেনে নিয়ে এলাম পত্রিকায়। তখন দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’ খুব দাপটের সঙ্গে চলছে। সেখানে ‘চাষবাস’ নামে একটা কলাম লিখতাম আমি। ‘চাষবাস’ কলামে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যা দেখালাম সেই তথ্যগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতাম। এতে প্রথম মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান দেখে কৃষক উদ্বুদ্ধ হতো, সে হাতে-কলমে কৌশল জানার জন্য দেখত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’। আর তথ্যগুলো কাগজে নিশ্চিতভাবে পাওয়ার জন্য তারা পড়তে শুরু করল জনকণ্ঠের চাষবাস কলাম। এটি হয়ে উঠল শতভাগ তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা ত্রিমুখী মডেল। তখনকার কৃষির উত্তরণে এই ত্রিমুখী কার্যক্রমের বড় একটি অবদান ছিল। দেশে অগণিত সফল খামারি রয়েছেন যারা সে সময়ের এই ত্রিমুখী সম্প্রসারণ কার্যক্রমের কল্যাণে কৃষিতে আসেন এবং উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করেন।
মনে পড়ে, সে সময় অন্যতম সফল একটি প্রচার ছিল বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন। নব্বইয়ের দশকে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে বায়োগ্যাস প্লান্টের ওপর একাধিক প্রতিবেদন করেছি। এতে বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে। সে সময়ে গ্রামীণ গৃহস্থালিতে জ্বালানির বড় অভাব। গ্যাস আজকের মতো এত সম্প্রসারিত ছিল না। আজ যেমন গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়, তখন তা ছিল না। অবাধে বৃক্ষ নিধন হতো। সে সময় বৃক্ষরোপণ নিয়েও বড় প্রচার হয়েছিল। সেই সংকটের সময়টাতে যখন বায়োগ্যাসের প্রতিবেদন তুলে ধরলাম, তখন মানুষের বাড়তি আগ্রহ তৈরি হলো।
তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’-এ বায়োগ্যাস প্লান্ট কীভাবে বানানো যায় তার আদ্যোপান্ত দেখানো হয়েছিল একাধিক প্রতিবেদনে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তখন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী। প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সঙ্গে তখন এ বিষয়ে আমার একাধিক বৈঠক হয়। তিনি বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ে বায়োগ্যাসের প্রদর্শনী প্লান্ট তৈরির উদ্যোগ নেন। অনেক উপজেলায় বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি হয়েছিল অবস্থাশালী কৃষকের বাড়িতে। তখন ক্যাম্পেইনটা শক্তিশালী ছিল বলে বায়োগ্যাস প্লান্ট সারা দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কৌশলের এমন বহু সাফল্যজনক প্রচার রয়েছে। আমাদের মতো দেশে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির দারুণ উপযোগিতা রয়েছে। এ দেশে একটি ‘দূরশিক্ষণ’ টেলিভিশন থাকা খুব দরকার। এতে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার আরও বেশি সম্প্রসারণ হতো। এতে আরও বেশি দক্ষ জনশক্তি তৈরি হতো।
‘কৃষি কৌশল’ করার সুবাদেই সে সময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হয়ে যাই। আমাদের জীবনের বিকাশেও ওই সময়টির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একসময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেরাম্যান হিসেবে যোগদান করে আমার ছোট ভাই নজরুল। সে সময় বড় একটি স্বপ্ন নিয়েই যাত্রা হয় প্রতিষ্ঠানটির। আজ সেই পথ ধরে অনেক সাফল্যেরই নজির তৈরি হয়েছে। পার হয়েছে ২৫টি দীর্ঘ সাফল্যমণ্ডিত বছর। সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষায় বড় একটি জনশক্তি গড়ে উঠেছে। আজও ২০-২৫ বছর পরে কাজের সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, গ্রামগঞ্জে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় পর্যায়ের ভবন দেখে মনে পড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির সূচনার সঙ্গে জীবনের কিছু অংশ জড়িয়ে আছে। সেদিন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরই কর্মী সোহেল আহমেদ জানাল, সে সময়ের ‘কৃষি কৌশল’ অনুষ্ঠানের বেশকিছু পর্ব ইউটিউবে দেওয়া হয়েছে। শুনে ভালো লাগল। সত্যিই কৃষির জাগরণের সে সময়টির প্রতিটি অধ্যায় সযত্নে সংরক্ষিত থাকা দরকার।
লেখক : উন্নয়ন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী
পরিচালক ও বার্তা প্রধান : চ্যানেল আই।