রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চেরিটি বিগিনস অ্যাট হোম

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

চেরিটি বিগিনস অ্যাট হোম

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন ধূমপান বা মাদক সম্পর্কে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বিটিভি বা বেতারে শুরু করি তখন থেকে একটি কথাই গুরুত্বসহকারে অনুষ্ঠান শেষে বলতাম আর সেটা হচ্ছে— ‘পিতা-মাতাই পারেন সন্তানকে ধূমপান বা মাদকাসক্তি থেকে দূরে রাখতে।’ এটা যে আমার কথা তা কিন্তু নয়, পৃথিবীর অনেক বড় মনীষী বা গবেষকরা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন।  তবে গবেষণায় আরও প্রকাশিত হয়েছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৪৪ ভাগই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। সত্যি কথা হচ্ছে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার নাম হলো বাসস্থান। এ বাসস্থানে দুজন শিক্ষক থাকেন, তার একজন হচ্ছেন মাতা অন্যজন হচ্ছেন পিতা, কখনোবা আরও বেশি শিক্ষক থাকেন যাদের একান্নবর্তী পরিবার থাকে। যেখানে কাকা শিক্ষক, কাকি শিক্ষক অথবা মামা শিক্ষক, মামি শিক্ষক। আবার সেই সঙ্গে বড় ভাই বা বড় বোনও শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, তা হলো— ‘charity begins at home’ করলে বলা যায় আপনি আপনার পরিবারের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন, যাতে তারা ছোটকাল থেকে সঠিক শিক্ষা পেয়ে বড় হতে পারে। কিন্তু আমরা কি তা করতে পারছি। আজকাল বেশির ভাগ পরিবারের সন্তান বড় হয় বাড়ির বুয়াদের কাছে। ফলে সন্তান যে আদর্শ শিক্ষাটা পেয়ে বড় হওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছে না। কারণ উপার্জনের জন্য হোক বা সামাজিক কাজে হোক যারা থাকেন চাকরির কাজে ব্যস্ত আর যারা থাকেন চাকরি বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত, কারণ তারা মনে করেন একটু নামকরা স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করে দিতে পারলেই হলো। সন্তানের দায়িত্ব তখন স্কুলের। কিন্তু স্কুল কি সন্তানকে সেই শিক্ষা দিচ্ছে। নাকি কয়েকটি বই কেতাব মুখস্থ করানোর জন্য বা পরীক্ষা পাসের জন্য গতানুগতিক একটি রুটিন মেপে পড়াশোনা করায়। সেখানে কোনো মানবিক মূল্যবোধ সৃজনশীল সংস্কৃতির বিকাশ লাভ করার কারিকুলাম থাকে না। আমাদের সময়কার কথা বলি ষাটের দশকের কথা— মা চাকরি করতেন, নিজে পড়াশোনা করতেন, নিজে সংসার করতেন হাঁড়িপাতিল পরিষ্কার করা থেকে রান্না পর্যন্ত শেষ করে আমাদের নিয়ে পড়াতে বসাতেন। স্কুল থেকে ফিরে ক্লাসের হোম ওয়ার্কটা পর্যন্ত দেখাতে হতো মা-বাবাকে। বিকালে খেলতে গেলে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরে পড়তে বসতে হতো। নতুবা বকুনি। বন্ধু কে, কোথায় যাচ্ছি, দেরিতে ফিরলাম কেন, সময়মতো ঘুম থেকে উঠছি কিনা বা ঘুমাতে যাচ্ছি কিনা সবই তো বাবা-মা দেখভাল করতেন। আবার তারা নিজেরাও সংসারের জন্য আয় করতে বাইরে চাকরি করতেন, শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকেও শত কষ্ট হলেও চেষ্টা করে অর্জন করেছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে কষ্ট করতে হয়, সাধনা করতে হয়, এটা অন্যের ওপর ছেড়ে দিলে চলে না। আজকাল আমাদের পরিবারের সন্তানদের বিপথগামী হওয়ার পেছনে মূল কারণটাই হচ্ছে তাদের আমরা প্রাথমিক শিক্ষাটা অর্থাৎ গৃহ শিক্ষাটা দিতে পারছি না। তার কারণ অনেকগুলো— অর্থনৈতিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি। আমাদের সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধের অভাব আজ আমাদের সমাজের এত কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে। সেই সুযোগে আমাদের কোমলমতি সন্তানদের একদল লোক বা একটি গোষ্ঠী মগজ ধোলাই করছে।  মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তে তারা সন্তানদের ভুল তথ্য দিয়ে বশীভূত করছে। তাদের মাদকাসক্তির মতো কঠিন নেশায় বুঁদ হয়ে মরে যেতে বাধ্য করছে।  শুধু তাই নয়, তাদের জীবনের মূল্যবোধকে অপব্যাখ্যা দিয়ে আত্মঘাতী হতেও বাধ্য করছে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- মানস, সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এবং জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড।

mail : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর