রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এই গুজব সেই পান্ডা গার্ডেন ষড়যন্ত্র

নঈম নিজাম

এই গুজব সেই পান্ডা গার্ডেন ষড়যন্ত্র

বাংলাদেশে কেবল ষড়যন্ত্রের গল্প শুনি। বেশির ভাগ ষড়যন্ত্রের কোনো বাপ-মা নেই। আগামাথা কোনোটাই নেই। মনে হয়, গুজবের ডালপালা গজায় গাঁজার পাহাড়ে নয়, সমতলে। গাঁজার নৌকা আমাদের চারপাশ দিয়েই যায়। এখন সত্য কথাতে অনেকের বিশ্বাস নেই। অসত্য মিথ্যাচারেই মানুষের আনন্দ। কিন্তু কারও কারও এই আনন্দে দেশে নেমে আসতে পারে বিষাদের ছায়া। সে দিন এক বন্ধু বললেন, ভাই খোঁজ রাখছেন কি? বললাম, কিসের খোঁজ? জবাবে ঢাকার অসুস্থ মেয়র আনিসুল হককে নিয়ে কাল্পনিক কিছু কথা বললেন। শুনে মনে হলো আমার বসবাস মায়ের পেটে। এখনো আমার জন্ম হয়নি। আজব! অসুস্থ গুজব আর মিথ্যাচারের এক যুগ চলছে। আর যেন গুজব রটিয়ে তারা আনন্দিত। ব্যক্তিগত জীবনে আনিসুল হকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা চমৎকার। দারুণ আড্ডাবাজ মানুষ। তার বাড়িতে দিনের পর দিন আড্ডা ছিল এক সময়। তাই এখন প্রতিদিন এই মানুষটার জন্য প্রার্থনা করি। আশাও করি দ্রুত সুস্থ হয়ে তিনি ফিরে আসবেন। আমার মতো ঢাকার অনেক মানুষই তার জন্য প্রার্থনা করছেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ আনিসুল হক মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়েছেন নগরবাসীকে। তিনি প্রমাণ করেছেন, চাইলেই এই শহরকে ইচ্ছাশক্তি আর পরিকল্পনা দিয়ে বদলে দেওয়া যায়। অনেক কাজ করেছেন। তারপর টানা পরিশ্রম আর ক্লান্তি নিয়ে লন্ডন সফরকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তার নিয়মিত খোঁজ রাখছি। লন্ডনে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। আত্মীয় পরিজন আছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধি মাসুম সক্রিয় সাংবাদিক। তারা আমাকে মেয়রের নিয়মিত খোঁজ দেন। এরপর যখন মেয়রকে নিয়ে কেউ গুজব ছড়ান তখন মনে মনে বিধাতাকে বলি : ওদেরকে মানুষ করো। সভ্য করো। কেন আমাদের মধ্যে সৌজন্যতাবোধও থাকবে না? সবকিছুুতে রাজনীতি টেনে গুজব আর গুজব ছড়ানো হবে? 

মাঝে মাঝে মনে হয় বাঙালি সত্যে নয়, গুজব আর ষড়যন্ত্র শব্দে মজা পায়। দেশে যখন রাজনীতি থাকে না তখন এ ধরনের গুজবের ডালপালা কিছু লোক ছড়িয়ে দেয়। সর্বশেষ রংপুরে গুজব ছড়িয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো একটি নিরীহ হিন্দু বাড়ি। এর আগে রামুতে এমন করা হয়েছিল। মফস্বলে বসবাসকারী বেশির ভাগ হিন্দু পরিবারই গরিব ও নিরীহ। তারা সহজে ঝামেলায় জড়ান না। অথচ তারাই বার বার হামলার শিকার হন। দুঃখজনক। এই লজ্জা আমাদের সবার। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পর রংপুরের বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কঠোরভাবেই সরকারকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে সব ধরনের গুজব ও মিথ্যাচার সম্পর্কে। কারণ গুজব শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তা নয়, শহরের সচেতন মানুষও এর থেকে বাদ যান না।

এ নিয়ে আমার পুরনো দিনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে। মাত্র দায়িত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখনই একদিন ফোন করলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিদায়ী কর্মকর্তারা। তারিখটা মনে করতে পারছি না। তারা বললেন, একটি আমন্ত্রণ। জানতে চাইলাম কিসের আমন্ত্রণ? বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকর্তারা বললেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দেব। খাব। আমরা যারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি তারা সবাই। বললাম, মহা আনন্দের খবর। আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। খোঁজ নিলাম আর কারা দাওয়াত পেয়েছেন? জানতে পারলাম, সিনিয়র সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, জগ্লুল আহমেদ চৌধূরী, ফরিদ হোসেন, শাহজাহান সরদার, সাইফুল আলম, পীর হাবিবুর রহমান, জনকণ্ঠের ওবায়দুল কবীর, প্রথম আলোর প্রণব সাহা, রাশেদ চৌধুরী, মোস্তফা ফিরোজ, শামীম আহমেদসহ ২৫ জনের মতো। সবাই ছিলেনও। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, সহকারী একান্ত সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান, প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ফোন করে করে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। পরে এর মধ্যে যুক্ত হন আবু আলম শহীদ খান ও আবুল কালাম আজাদসহ আরও কয়েকজন। আওয়ামী লীগের এমপি মির্জা আজমসহ কয়েকজন রাজনীতিকও অনুষ্ঠানে আসেন আড্ডা দিতে। আমার কাছে সেই দিন সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন লন্ডনের সানু মিয়া, নায়ক রিয়াজসহ আরও দুই শিল্পী। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে চলে আসেন পান্ডা গার্ডেনে। অনুষ্ঠানে কোনো বক্তৃতা বিবৃতি কিছুই ছিল না। শুধুই খাওয়া ও আড্ডা। যে যার মতো আড্ডা দিল। কারও সঙ্গে কারও বিশেষ গোপন  আলাপচারিতার কিছুই ছিল না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কে বেশি কথা বলে?

পান্ডা গার্ডেন রেস্টুরেন্টটির মালিক ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টো। তিনি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ছিলেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মূল নেতা। ২০০১ সালে ছিলেন বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম প্রধান। আমি রেস্টুরেন্টে প্রবেশের মুখে দেখলাম একটি টেবিলে বসে আছেন দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী সিরাজ। তার সঙ্গে সিনিয়র রিপোর্টার রেজা রায়হান। সিরাজ ভাইর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সবসময় ভালো ছিল। মারা যাওয়ার আগে তার শেষ লেখা প্রকাশ হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনে। ভালো মন্দে তার সঙ্গে অনেক কথা হতো। আমি ভেবেছিলাম তিনিও আমন্ত্রিত অতিথি। তাকে বললাম, ভালো হলো আপনাকে দেখে। তিনি বললেন, তারা  আমন্ত্রিত নন। আলাদাভাবে খেতে এসেছেন। সিরাজ ভাইর সঙ্গে অন্য সাংবাদিকরাও সালাম বিনিময় করেছিলেন। জমপেশ আড্ডা হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিদায় নিলাম সবাই যে যার মতো। সানু মিয়াকে নামালাম শান্তিনগরে। নায়ক রিয়াজ চলে গেলেন তার বাড়ি। পরদিন দৈনিক দিনকাল পড়ে থ হয়ে গেলাম। দিনকাল রিপোর্ট করেছে, পান্ডা গার্ডেনে গভীর চক্রান্ত হয়েছে। এই চক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তাদের। সেখানে এত সাংবাদিক ছিলেন তার কোনো তথ্য নেই। বুঝলাম না ২০/৩০ জন সাংবাদিক ডেকে এনে কেউ ষড়যন্ত্র করে কীভাবে? দীর্ঘদিন এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তদন্তও শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই পেল না। তদন্তে বের হলো এটা ছিল সাংবাদিকদের একটা গেট টুগেদার। যার হোস্ট ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লেখালেখি হয়নি। নানামুখী কাজে আসলে লেখালেখি আর হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরে অনেক গুজবে পুরনো গল্পটা মনে পড়ে গেল।

অতি সহজে আমরা গল্প তৈরি করে ফেলতে পারি। আড্ডাবাজিকে বানিয়ে ফেলতে পারি ষড়যন্ত্র। আবার মূল ষড়যন্ত্রকে আড়াল করে ফেলি মুহূর্তে। কথায় কথায় সবাই ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে অনেক নেতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা এখনো ছড়ান। এতদিন পর আমার এখনো প্রশ্ন, ওয়ান-ইলেভেন হচ্ছে এই তথ্য কি আওয়ামী লীগের কাছে ছিল না? আওয়ামী লীগ কি বঙ্গভবনে শপথে যায়নি? কথা যারা বলছেন, শেখ হাসিনা , খালেদা জিয়াকে আটকের পর তারা কী করেছেন? প্রতিবাদটা করলেন কে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৩ নভেম্বরের আগে কেউ কথা বলেছিলেন কি? ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ইতিহাস মনে রেখে সামনে চললে সমস্যা নেই। ২০০১ সালের পর সারা দেশে কী হয়েছিল?  এখন কি কারও তা মনে আছে? সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা নামাতে হয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। ক্ষমতায় থাকার সময় কেউই বাস্তবতায় থাকে না। থাকতে চায় না। ক্ষমতার সময় উড়ে এস জুড়ে বসা সুবিধাভোগীরা অনেক কিছু আড়াল করে রাখে। ২০০১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত কয়টি পরিবারকে মন্ত্রী-এমপিরা মূল্যায়ন করেছেন? আসলে এত সময় কোথায় ক্ষমতাবানদের। দাপুটে মন্ত্রী-এমপিরা ব্যস্ত নিজেদের পরিবার পরিজনকে মূল্যায়ন করা নিয়ে। সবাই আখের গোছাচ্ছেন। এই টাকা আগামী নির্বাচনে ব্যয় করবেন তো? এখন একই পরিবারে এমপি, দলীয় পদ, ব্যবসা বাণিজ্য, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান। এমনকি অনেকে নিজ পরিবারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদটাও ছাড়তে নারাজ। এই সংস্কৃতি আওয়ামী লীগে ছিল না। আর ছিল না বলেই অতীতে দলীয় সংঘাত ছিল কম। এখন অনেক বেড়েছে। এখন রাজনীতি শুধুই ভোগের। চাওয়া পাওয়ার হিসাবে পেশাজীবীরাও পিছিয়ে নেই। একই ব্যক্তি বার বার সুবিধাভোগী পদে পদায়ন হন। আবার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্য, লাইসেন্স নেওয়াতেও তারা পিছিয়ে নেই।

ত্যাগী নেতা-কর্মীরা অনেক কথা বলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, যারা সব পেয়েছে, তারাই আগামীতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনুক। এই বিরোধের নিষ্পত্তি জরুরি। বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে হবে যারা মনোনয়ন পাবেন তাদের। নইলে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ আওয়ামী লীগই করবে। এখানে বিএনপি-জামায়াতের দরকার নাও হতে পারে। হয়তো তখন গালাগাল বিএনপি-জামায়াতকে করতে পারবেন। ষড়যন্ত্রের গন্ধ বের করবেন।  তাতে লাভ নেই। যারা হঠাৎ বিশাল অর্থবিত্তের মালিক  বনেছেন তারা দলে কত ব্যয় করছেন তার হিসাব দেওয়ার সময় এসেছে। এই হিসাব যত হবে কর্মীদের মনে শান্তি তত আগে আসবে। দলেই দুঃসময়ের কর্মীরা অভিমানী হয়। আওয়ামী লীগের দরকার কথায় কথায় ষড়যন্ত্র না খুঁজে কাজ করা। কাজ করলে তার মূল্যায়ন জনগণ কিংবা কর্মীরা দিতে ভুল করেন না। আর ক্ষমতায় ৯ বছর ধরে টানা আওয়ামী লীগ। ষড়যন্ত্র অন্যদের মধ্যে খুঁজে কী হবে! নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি যত করবেন তত সমস্যা বাড়বে। দূরত্ব তৈরি হবে দলে। আর অতি উৎসাহী হাইব্রিডরা সংকটকালে তারা কেটে পড়বে। এখনই অনেক সুর বদল হতে শুরু করেছে।  যে সব সরকারি কর্মকর্তা উচ্চরবে যত বেশি কথা বলেছেন, তারা তত বেশি আগে ভাগে সরে পড়বেন। তাই অতি কথন বন্ধ করুন। মানুষের চাওয়া পাওয়ার মূল্যায়ন করুন।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর